মিলেমিশে: চলছে প্রস্তুতি। নিজস্ব চিত্র
নাওয়াখাওয়া ভুলে কালীপুজোর প্রস্তুতিতে ব্যস্ত তাজু শেখ, সিদ্দিক শেখরা। সোনামুখীর সত্যপীরতলায় এমনটাই চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। শুধু পুজোয় নয়, সেখানে সম্প্রীতি সমস্ত উৎসবে। সত্যকালী পুজো কমিটির সম্পাদক অজয় বিট বলেন, ‘‘এই মন্দিরের চাতালেই সিদ্দিক চাচা মহরমের তাজিয়া বানান। আমরাও হাত লাগাই। মহরমের লাঠি খেলায় যোগ দিই।’’
সোনামুখী শহরের দশ নম্বর ওয়ার্ডে সত্যপীরতলা। প্রায় একশো বছর ধরে সেখানে সত্যকালীর পুজো হয়ে আসছে। জনশ্রুতি রয়েছে, এক কালে এই এলাকা ছিল জঙ্গলঘেরা। তখন এখানে সত্যপীর থাকতেন। সেই পীরের মাজার আর কালীমন্দির এখনও মিলেমিশে ধরে রেখেছে সম্প্রীতির পরম্পরা। মহরম আর দীপাবলি এখানে বাঁধা এক সুরে। প্রায় দেড়শো পরিবারের বাস সত্যপীর তলায়। তার মধ্যে তিরিশটি পরিবার মুসলমান ধর্মাবলম্বী। এখানে আজানের সঙ্গে মিলে যায় পুজোর শাঁখের আওয়াজ। বাসিন্দারা মূলত ব্যবসায়ী। সবাই মিলে চাঁদা তুলে এ বারের পুজোর বাজেট করেছেন ১ লক্ষ টাকা। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবাই কালীপুজো যোগ দেন। পাত পেড়ে সবাই মিলে ভোগ খাওয়া হয়। কর্মসূত্রে এলার যাঁরা বাইরে থাকেন, তাঁরা এই ক’দিন ফিরে আসেন বাড়িতে। যেমন রুবেল শেখ। বোলপুরে গাড়ির মিস্ত্রির কাজ করেন। ছুটি নিয়ে চলে এসেছেন। নেহাতই এমনটা যাঁরা পারেন না, তাঁরাও পুজোর চাঁদাটুকু মনে করে পাঠিয়ে দেন।
শুধু সম্প্রীতি নয়, সত্যকালী পুজোয় রয়েছে সচেতনতাও। এখানে শব্দবাজির বালাই নেই। কদম ঝাড় তৈরি হয়, কিন্তু তাতে শুধুই রঙের বাহার থাকে। মিরাজু শেখ, মৃণ্ময় চেলরা জানান, এ বার তেমনই পাঁচটা কদম ঝাড় বানানো হয়েছে।
আসলে, সোনামুখী শহরটাই কালীপুজোর। জনশ্রুতি রয়েছে বর্গী আক্রমণ থেকে শালি নদী আর শাল জঙ্গলের মাঝের এই শহরকে রক্ষা করেছিলেন দেবী। শহরের বাসিন্দা তথা বি জে হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মনোরঞ্জন চোংরে বলেন, ‘‘সোনামুখীর বেশির ভাগ মানুষ তন্তুবায় সম্প্রদায়ের। দুর্গাপুজোর সময়টায় নাওয়াখাওয়া ভুলে কাজ করেন তাঁরা। কালীপুজোয় তাই আনন্দের সেই খামতিটা পুষিয়ে নেন।’’
সোনামুখীতে কালীপুজো হয় পাঁচ দিন ধরে। শহরের অগুনতি পুজোর মধ্যে ১৯টি প্রশাসনের থেকে দস্তুর মতো অনুমতি নিয়ে হয়। এক পুজোর সঙ্গে অন্য পুজোর চলে ঠান্ডা রেষারেষি— আলোর রোশনাইয়ে কে কাকে টেক্কা দিতে পারে। তবে সেটা ফল্গুর মতো। আসলে সমস্তটাই উৎসবের আনন্দটাকে কী ভাবে আরও বাড়িয়ে তোলা যায়, তারই চেষ্টা। ‘‘প্রথম তিন দিন প্রত্যেক পুজো কমিটি শোভাযাত্রা করে একে অন্যের মণ্ডপে পুজো দিতে যায়’’, বলছিলেন সোনামুখীর পুরপ্রধান সুরজিৎ মুখোপাধ্যায়। তিনি জানান, কোনও ছুটি না নিয়ে পুজোর ক’দিন পুরকর্মীরা অক্লান্ত কাজ করে যান। পুরসভার পক্ষ থেকে শহরের অলিগলিতে আলো লাগানো হয়। নিকাশি নিয়ে যাতে কোনও সমস্যা না হয়, লক্ষ রাখা হয় সে দিকে। তবে আলো আর আতসবাজির উৎসবে দুঃশ্চিন্তাটা থেকেই যায় দমকল নিয়ে। এই ব্যাপারে সোনামুখীর এখনও ভরসা ৩৬ কিলোমিটার দূরের বিষ্ণুপুর। তবে পুরপ্রধান জানাচ্ছেন, পরের বছর থেকে ছবিটা বদলাবে। শহরের মধ্যে দেড় বিঘা জমি দমকল কেন্দ্র গড়ার জন্য দেওয়া হয়েছে।
এই শহরে প্রাচীন পুজোগুলির মধ্যে অন্যতম হল বড় কালী, মাইতো কালী, হট্নগর কালী, রক্ষাকালী। এ ছাড়াও রয়েছেন খ্যাপা কালী, পাগলা কালী, ভদ্রকালী, পায়রা কালী, ঘুঘু কালী, মামলা কালী, সার্ভিস কালী। মাইতো কালী পুজোর একটা বিশেষত্ব হচ্ছে খুন্তিনাচ। পুজোর তৃতীয় দিনে হাজার হাজার মানুষকে ভোগ খাওয়ানো হয়। তার পরে বেরোয় শোভাযাত্রা। শহর জুড়ে ঢাক, ঢোল, নাগরাজি বাজিয়ে ভোগ রান্নার হাতা, খুন্তি, বালতি নিয়ে চলে নাচ। পঞ্চম দিনে কোচডি গ্রাম থেকে আসেন বেহারারা। প্রায় চল্লিশ জন মিলে কাঁধে করে মন্দির থেকে প্রতিমা বের করে এনে শহর পরিক্রমা করেন তাঁরা।
বড় কালী পুজো কমিটির সম্পাদক তন্ময় আঁকুড়ে, মাইতো কালী পুজোর সম্পাদক নেপাল দে মুদি, হট্নগর কালী পুজো কমিটির প্রবীণ সদস্য নিতাই ঘোষালরা বলেন, ‘‘এই শহরটাই সম্প্রীতির শহর। কালীপুজোয় সমস্ত ভেদাভেদ তুচ্ছ হয়ে যায়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy