Advertisement
০৫ মে ২০২৪
বেগুনকোদর হাইস্কুল

যেতে দেব না, পড়ুয়াদের ঘেরাটোপে প্রধান শিক্ষক

ছাত্রছাত্রীদের জানিয়েছিলেন আর বেশিদিন এই স্কুলে তিনি থাকছেন না। তাঁর বদলির আবেদন মঞ্জুর হয়েছে। চলে যাচ্ছেন তিনি বাঁকুড়ায় বাড়ির কাছাকাছি একটি স্কুলে।

ভালবেসে। প্রধান শিক্ষককে আটকে দিল পড়ুয়ারা।—নিজস্ব চিত্র

ভালবেসে। প্রধান শিক্ষককে আটকে দিল পড়ুয়ারা।—নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
ঝালদা শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০১৬ ০৩:৫০
Share: Save:

ছাত্রছাত্রীদের জানিয়েছিলেন আর বেশিদিন এই স্কুলে তিনি থাকছেন না। তাঁর বদলির আবেদন মঞ্জুর হয়েছে। চলে যাচ্ছেন তিনি বাঁকুড়ায় বাড়ির কাছাকাছি একটি স্কুলে।

কিন্তু প্রিয় ‘হেডস্যারে’র বদলি মানতে পাচ্ছে না ছাত্রছাত্রীরা। শুক্রবার স্কুলে প্রার্থনা শেষ হতেই তাই সমস্ত পড়ুয়া ‘যেতে নাহি দিব’ দাবি তুলে প্রধানশিক্ষককে কার্যত ঘেরাও করে ফেলল। পুরোদিন বন্ধ থাকল সমস্ত ক্লাস। ছাত্রছাত্রীদের ‘ঘেরাও’ কোনও রকমে কাটিয়ে প্রধান শিক্ষক চলে যান নিজের অফিসে। কিন্তু রেহাই পাননি। নাছোড় পড়ুয়ারা ‘হেডস্যারে’র পিছু-পিছু হাজির সেখানেও। শেষ পর্যন্ত তিনি স্কুল ছাড়বেন না, ছাত্রছাত্রীদের এ কথা জানানোর পরে ঘেরাও মুক্ত হলেন প্রধানশিক্ষক।

রাজ্য জুড়ে যেখানে শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের তিক্ততা নানা ঘটনায় বারবার সামনে এসে পড়ছে, সেখানে শুক্রবার এই অভাবনীয় ঘটনার সাক্ষী থাকল পুরুলিয়ার ঝালদা ২ ব্লকের বেগুনকোদর হাইস্কুল। প্রধান শিক্ষক দেবদাস অধিকারীর বদলি রুখতে এ দিন তাঁকে এ ভাবেই আটকে রেখে প্রতিশ্রুতি আদায় করল স্কুলের পড়ুয়ারা। আর ঘটনা শুনে জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক (মাধ্যমিক) রাধারানি মুখোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া, ‘‘এটা যে কোনও শিক্ষকেরই জীবনে অনেক বড় পাওনা।’’

বাঁকুড়ার বড়জোড়া থানার মেটালি গ্রামের বাসিন্দা বছর পঞ্চান্নর দেবদাস আধিকারী গত ১১ বছর ধরে পুরুলিয়ার ঝালদা ২ ব্লকের বেগুনকোদর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে রয়েছেন। অবসর থেকে কয়েকটা বছর দূরে দাঁড়িয়ে স্থির করেছিলেন গ্রামের বাড়ির কাছাকাছি কোনও স্কুলে তিনি চলে যাবেন। সেই মতো বদলির আবেদন করেছিলেন। মঞ্জুরও হয়। বড়জোড়া ব্লকেরই ঘুটগড়িয়া হাইস্কুলে তাঁর বদলির নির্দেশ আসে। আগামী মঙ্গলবার সেখানে কাজে যোগ দেওয়ার কথা দেবদাসবাবুর। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের মনের কথা তখন হয়তো ঠিকমতো পড়তে পারেননি দেবদাসবাবু। বদলির খবর ছড়িয়ে পড়তেই বেঁকে বসেন পড়ুয়ারা। এ দিন সকালে তাই প্রধানশিক্ষককে কার্যত ঘেরাও করে বসে তারা। দাবি তোলে, বেগুনকোদর হাইস্কুল ছেড়ে তাঁকে অন্যত্র যেতে দেওয়া হবে না। সে দাবি এতই জোরালো যে দেবদাসবাবুকে শেষ পর্যন্ত থেকে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছাড় পেতে হল।

কিন্তু কেন পড়ুয়ারা প্রধান শিক্ষকের বদলি আটকাতে এ ভাবে মরিয়া হয়ে উঠল? বেগুনকোদর হাইস্কুলের পড়ুয়ারাই জানাচ্ছে, দায়িত্ব নেওয়ার পরে গত এক দশকে এই স্কুলের হাল অনেকটাই পাল্টে দিয়েছিলেন দেবদাসবাবু। বিশেষ করে স্কুলে একটা অনুশাসন শুরু হয়েছে। নিয়মিত পঠনপাঠনের পরিবেশটা ফিরিয়ে এনেছেন তিনি। সহমর্মিতার ছোঁয়া নিয়ে পড়ুয়াদের যে কোনও সমস্যায় পাশে দাঁড়ান প্রধানশিক্ষক। দ্বাদশ শ্রেণির কৃষ্ণকান্ত কুমার, নবম শ্রেণির শ্বেতা চট্টোপাধ্যায় বা সপ্তম শ্রেণির সুজয় নাগদের একটাই কথা, ‘‘হেডস্যার আসার পরেই স্কুলের পরিস্থিতি অনেক বদলে গিয়েছে। এখন নিয়মিত ক্লাস হয়। আমারা যে কোনও সমস্যা হলে সরাসরি হেডস্যারের কাছে গিয়ে কথা বলতে পারি। তিনিও খুব কাছের মানুষের মতো সমস্যা শুনে প্রতিকার করেন। এমন কাছের মানুষকে কেউ ছাড়ে না কি!’’

অভিভাবকেরাও জানাচ্ছেন, এমন মানুষকে স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে পাওয়া তাঁদের একটা বড় প্রাপ্তি। দেবদাসবাবুর সময়ে স্কুলের পঠনপাঠনের পরিবেশের অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। বিশেষ করে গরমের ছুটিতে মাধ্যমিকে পরিক্ষার্থীদের জন্য স্কুলে বিশেষ ক্লাস হয়। সিলেবাস শেষ করার জন্য অনেক সময়ে বাড়তি বা বিশেষ ক্লাসও শুরু হয়েছে এখানে। যদিও বাড়তি ক্লাস নেওয়ার জন্য তাঁর সহকর্মী অন্যান্য শিক্ষকদের ভূমিকাটাই মুখ্য বলে জানাচ্ছেন দেবদাসবাবু। তিনি নিজে বিশেষ কিছু করেছেন বলেও মানতে চাইছেন না। তাঁর কথায়, ‘‘বেগুনকোদর হাইস্কুলের বরাবরই একটা সুনাম রয়েছে। প্রধান শিক্ষক হিসাবে সেই সুনামটা শুধু বজায় রাখার চেষ্টা করেছি। এই কাজ কখনই কোনও প্রধান শিক্ষকের পক্ষে একা করা সম্ভব নয়। পরিচালন সমিতি থেকে শুরু করে সহশিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী— সকলেরই সহযোগিতায় স্কুলের সুনামের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে।”

তবে এ দিন যে ভাবে ছাত্রছাত্রীরা তাঁর বদলি রুখতে তাঁকেই ঘেরাও করেছিলেন তাতে কার্যত আপ্লুত ওই প্রধানশিক্ষক। তাঁর কথায়, ‘‘স্কুলের সবার সহযোগিতা নিয়ে প্রধান শিক্ষক হিসাবে যে দায়িত্ব পালন করার কথা, তার বেশি তো কিছু করিনি। চেষ্টা করেছি সবসময় ছাত্রদের পাশে থাকতে, তাদের সমস্যা মেটাতে। এ দিন পড়ুয়ারা সকলে মিলে যে ভাবে আমাকে স্কুলে থাকার অনুরোধ জানিয়েছে, কর্মজীবনে এটাই আমার সেরা প্রাপ্তি।”

জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শকও (মাধ্যমিক) মনে করেন, এর থেকে বড় প্রাপ্তি একজন শিক্ষকের আর কিছু হতে পারে না। তিনি বলেন, ‘‘বেগুনকোদর হাইস্কুলের পড়ুয়ারা ভালবেসে ওই প্রধান শিক্ষককে ধরে রাখতে চাইছে, এটা ওঁর কাছে ছাত্রছাত্রীদের ভালবাসার দাবি। আমরা বলতে পারি না তিনি থেকে যান। তবে ছাত্রছাত্রীদের ভালবাসার দাবির মর্যাদা উনি রাখবেন কি না সেই সিদ্ধান্ত ওঁকেই নিতে হবে।’’

ছাত্রছাত্রীদের ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে তিনি স্কুলে থাকবেন বলে কথা দিয়েছেন ঠিকই। তবে শেষ পর্যন্ত এই স্কুলে থাকতে পারবেন কি না তা নিয়ে নিজেই দোলাচলে ভুগছেন দেবদাসবাবু। এ দিন বিকালে তিনি বলেন, ‘‘ছাত্রছাত্রীদের এমন অনুরোধ ঠেলে ফেলে অন্য স্কুলে যেতে মন চাইছে না। কিন্তু বদলির নির্দেশ চলে এসেছে। চারদিন পরেই অন্য স্কুলে যোগ দিতে হবে। না হলে চাকরি সংক্রান্ত সমস্যা তৈরি হতে পারে। দেখি শেষ পর্যন্ত কী হয়।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

teacher students
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE