অশান্তি: সিউড়ি হাসপাতালে নিহত তৃণমূল কর্মী। কান্নায় নির্বাক তাঁর পরিবার।
আদিবাসী সমবায় সমিতির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শাসক-বিরোধী সংঘাতে ফের অশান্ত বীরভূম। পাড়ুইয়ের পরে রাজনগর।
চলল গুলি, বোমা। গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হল বলরাম মণ্ডল (৩৮) নামে এক সক্রিয় তৃণমূল কর্মীর। তাঁর বাড়ি রাজনগর থানার ভবানীপুরে। ঘটনায় আহত কমপক্ষে আরও জনা চারেক তৃণমূল নেতা-কর্মী। ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল প্রায় এক ডজন মোটরবাইকে। সোমবার ঘটনাটি ঘটেছে রাজনগরের গাংমুড়ি-জয়পুর পঞ্চায়েতের রাজারকেন্দ গ্রামে। তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের দাবি, ‘‘ঘটনার জন্য মিলিত ভাবে দায়ী বিজেপি ও সিপিএম।’’ সিপিএম-বিজেপি অভিযোগ অস্বীকার করে হামলার জন্য তৃণমূলকেই দায়ী করেছে। দিনের শেষে অবশ্য তৃণমূল সমর্থিত প্রার্থীরাই ওই সমবায়ে জয়ী হয়েছেন।
ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ মোট ১২টি ক্ষতিগ্রস্ত মোটরবাইক এবং স্পঞ্জে মোড়ানো চৌকো আকারের এক ধরনের বোমা উদ্ধার করেছে। বীরভূমের পুলিশ সুপার নীলকান্ত সুধীর কুমার বলেন, ‘‘সংঘর্ষে এক জন মারা গিয়েছেন। ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া বোমা কী ধরনের, তা জানতে বম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াডকে খবর দেওয়া হয়েছে। তারা পরীক্ষা করে দেখবে।’’ তবে, এত বড় ঘটনা নিয়ে কোনও পক্ষই সোমবার রাত অবধি লিখিত অভিযোগ করেনি বলে পুলিশ জানিয়েছে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে খবর, আদিবাসী গ্রামের বাসিন্দাদের আর্থ-সামজিক উন্নয়নের লক্ষ্যেই তৈরি হয় রাজনগর আদিবাসী ল্যাম্পস (লার্জ সাইজড এগ্রিকালচার মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি)। এই আদিবাসী সমবায়টি রয়েছে আলিগড়ে। রাজনগর ব্লকের ব্লকের পাঁচটি পঞ্চায়েত এলাকায় বসবাসকারী আদিবাসী গ্রামের মোট ১৭২২ জন সদস্য রয়েছে ওই সোসাইটির আওতায়। এত দিন পর্যন্ত ল্যাম্পসটি বামেদের দখলে ছিল। সমবায়ে মোট আসন ৬৮টি। এ বার মনোনয়ন জমা পড়ে ১৩৬টি। শাসক-বিরোধী সমানে সমানে লড়াই ছিল।
দু’পক্ষের সংঘর্ষের পরে মাঠের মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছে ভাঙা বাইক।
দিন কয়েক আগেই পাড়ুই এলাকায় সিপিএম-বিজেপি সংঘর্ষ বেধেছিল ল্যাম্পসের নির্বাচন ঘিরে। সোমবার রাজনগরের ল্যাম্পসের নির্বাচন ঘিরেও সকাল থেকে উত্তেজনা ছড়ায়। ভোটকেন্দ্র হয়েছিল আলিগড় সিসালফার্ম উচ্চ বিদ্যালয়ে। ভোটকেন্দ্রের বাইরেও বোমাবাজি হয়। কিন্তু, সংঘর্ষের মূল ঘটনাটি ঘটে ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে থেকে ৫-৬ কিমি দূরে রাজারকেন্দ গ্রামের মুখেই।
বিরোধীদের অভিযোগ, এ দিন সকাল থেকেই বিভিন্ন আদিবাসী গ্রাম, যেখানে বিরোধীরা শক্তিশালী, সেই সব জায়গায় ভোটারদের আটকাতে বাইক-বাহিনী এবং সশস্ত্র বহিরাগতদের এনে জড়ো করেছিল তৃণমূল। সকাল থেকেই দুষ্কৃতীরা বোমাবাজি শুরু করে। বেলা ১০টা-১১টা নাগাদ মূল প্রতিরোধ হয় রাজারকেন্দ গ্রামে। দুষ্কৃতী ও তৃণমূল কর্মীদের উপরে পাল্টা আক্রমণ হয়। মুড়িমুড়কির বোমা পড়তে থাকে। গুলি ও তিরও চলতে থাকে। তখনই ডান বগলের নীচে গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়েন বলরাম। সিউড়ি সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তাঁর মৃত্যু হয়। স্থানীয় সূত্রের খবর, প্রতিরোধের মুখে পড়ে তৃণমূলের লোকজন পালিয়ে যায়। কিন্তু, অনেকগুলি মোটরবাইক নিয়ে যেতে পারেনি। সেগুলিতেই ভাঙচুর চালিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। পরে পুলিশ বাহিনী গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়।
এ দিন দুপুরে আলিগড়ে গিয়ে দেখা যায়, এলাকার দখল নিয়েছে পুলিশ। ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের বাইরে বোমবাজি যে হয়েছে সেটা স্পষ্ট। গ্রামে ঢোকার মুখে ছবি আরও মারত্মক। গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের সামনের মাঠে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে ভাঙা এবং আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত বাইকগুলি। পুলিশ সেগুলি পিক-আপ ভ্যানে তুলছে। রাজারকেন্দ-সহ আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রাম কার্যত পুরুষ-শূন্য। কিছু মহিলার দাবি, তাঁরা ভোট দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, তৃণমূল আটকায়। তার জেরেই সংঘর্ষ বাধে। এর বেশি কেউ কিছু বলতে চাননি। তবে, পাঁচ-ছ’টি গ্রামের আদিবাসী লোকজন যে প্রতিরোধের জন্য জড়ো হয়েছিলেন, তা পুলিশ জানতে পেরেছে। তৃণমূলের দাবি, এত দিন ক্ষমতায় থাকলেও এ বার রুখতে পারা যাবে না বুঝেই মিলিত ভাবে হামলার প্রস্ততি নিয়েছিল বিজেপি এবং সিপিএম। আগেই বাইরে থেকে অস্ত্রশস্ত্র লোকজন জুটিয়ে পরিকল্পিত আক্রমণ হয়েছে। এই হামলায় লাগোয়া ঝাড়খণ্ডের মাওবাদী যোগ থাকতে পারে বলেও ইঙ্গিত করেছেন অনুব্রত। বিজেপির জেলা সভাপতি রামকৃষ্ণ রায় বলেন, ‘‘নিজেদের গুলিতেই ওরা মারা গিয়েছে।’’ একই দাবি সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সাধন ঘোষের। তাঁর আরও প্রশ্ন, নিহত ব্যক্তি সমবায়ের ভোটার নন। তাঁর গ্রাম আলিগড় থেকে অন্তত ৬ কিলোমিটার দূরে। তাহলে তিনি এ দিন রাজারকেন্দ গ্রামে কী করছিলেন? এর থেকেই স্পষ্ট, তৃণমূল বহিরাগত জড়ো করেছিল—দাবি সাধনবাবুর। যা শুনে রাজনগরের প্রভাবশালী তৃণমূল নেতা তথা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সুকুমার সাধু বলছেন, ‘‘আমাদের ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসতে বাধা দিচ্ছিল সিপিএম-বিজেপির দুষ্কৃতী বাহিনী। নির্বিঘ্নে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসতেই বলরাম-সহ আমাদের কিছু নেতা-কর্মী ওই গ্রামে যান। তখনই ওঁদের উপরে গেরিলা কায়দায় আক্রমণ চালানো হয়।’’
ভোটের ফল অবশ্য তৃণমূলের পক্ষেই গিয়েছে। মোট ৬৮টি আসনের ৫১টি তৃণমূল এবং বাকি ১৭টি বিরোধীরা পেয়েছে।
—নিজস্ব চিত্র
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy