হাতে-কলমে: প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন স্বনির্ভর দলের মহিলারা। নিজস্ব চিত্র
ভুট্টার ছাল, অশ্বত্থ বা পলাশ গাছের পাতা, শুকনো আতা, তালের ফুল, শিরীষের বাকল— পুরুলিয়ার জঙ্গলমহলের বিভিন্ন এলাকায় অবহেলায় পড়ে থাকা এ রকমের বনজ সম্পদ এ বার শোভা পাবে সুদৃশ বৈঠকখানায়। দেশের তো বটেই, বিদেশেও হতে পারে। জঙ্গলে ইতিউতি পড়ে থাকা বনজ সম্পদকে কী ভাবে দৃষ্টিনন্দন গৃহসজ্জার জিনিস বানিয়ে ফেলা যায়, তার প্রশিক্ষণ নিতে দক্ষিণ ভারতে পাড়ি দিচ্ছেন পুরুলিয়ার স্বনির্ভর দলের কয়েক জন মহিলা।
এই ব্যাপারে স্বনির্ভর দলের মহিলাদের প্রাথমিক ধারণা দিতে ইতিমধ্যেই জেলা স্বনির্ভর গোষ্ঠী ও স্বনিযুক্তি প্রকল্প দফতরের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দফতরের আধিকারিক অমল আচার্য জানান, গৃহসজ্জার নানা কিসিমের নান্দনিক ধারণা থাকলে কাজে সুবিধা হবে। গোড়ার প্রশিক্ষণে সেই চেষ্টাই করা হচ্ছে। কিছু দিন আগেই পুঞ্চা ব্লকে জঙ্গল লাগোয়া গ্রামের স্বনির্ভর দলের ৪০ জন মহিলাকে এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, ফের আগামী সপ্তাহে একটি কর্মশালা হবে হুড়ায়।
প্রশিক্ষক রবীন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘পদ্মের বীজ যাকে এই এলাকায় টাটি ভেট বলা হয়, মেহগনির বীজ, ডাবের খোলা, ফুলকপির গোড়া, আমড়ার বীজ, ভুট্টার দানা তুলে নেওয়ার পরে যে ডাঁটা পড়ে থাকে— কিছুই আসলে ফেলনা নয়। ধুঁধুলের ছোবা, তালের বীজ দিয়ে এমন এমন শৌখিন জিনিস তৈরি করে ফেলা যায়, যা দেশ-বিদেশের ঝাঁ চকচকে শহুরে ঘরদোরেও ভোল বদলে দিতে পারে।’’ তিনি জানান, বিদেশের বাজারে এই সমস্ত জিনিসের ভাল কদর রয়েছে।
তবে এই কাজে অনেক কিছু মাথায় রাখতে হয় বলে জানাচ্ছেন রবীনবাবু। বনে পড়ে থাকার সময়ে বোঝা যায় না, কিন্তু ওই জিনসগুলিই আসলে এক এক টুকরো বন। আর সেটাই ধরে রাখাটা হল শিল্পীর কাজ। প্রাকৃতিক রঙ ধরে রেখে, অল্প রঙের আঁচড়ে সেগুলিকে অনন্য করে তুলতে হয়। এমনই অনন্য যে দামি রঙ বা ধাতু দিয়ে সেই সৌন্দর্যকে ধরা যায় না। রবীনবাবু মনে করিয়ে দিচ্ছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কুটুম-কাটাম’-এর কথা। পোকায় খাওয়া এক টুকরো গাছের ডাল আর তালের আঁটি দিয়ে তিনি বানিয়ে ফেলতেন মানুষের মূর্তি। একটুও বাড়তি রং দেওয়া হত না তাতে। প্রকৃতি যেমন ভাবে বানিয়েছে, ঠিক তেমনটাই। বাড়তি বলতে শিল্পীর দেখার চোখটুকু।
স্বনির্ভর দলের মহিলারা অবশ্য রঙের ব্যবহার করবেন। কী ভাবে আর কতটা— সেই সমস্তই শিখতে শুরু করেছেন পিঁড়রা গ্রামের শকুন্তলা মাহাতো, জামবাদের নুরজাহান বিবি, বাবুইজোড়ের রেখারানি মাহাতো, বড়গোড়ার নমিতা সোরেন, কোণাপাড়ার শিশুবালা মাহাতোরা। তাঁরা বলেন, ‘‘পদ্মের টাঁটি, তালের ফুল, শুকনো মাদাল (আতা)— এ সব দেখতে দেখতেই তো বড় হলাম। এখন এগুলো দিয়ে শহরের ঘরের সঙ্গে মানানসই জিনিস কী ভাবে বানানো যায় সেটাই শিখছি।’’
প্রশিক্ষক বলেন, ‘‘প্রকৃতিকে ওঁদের মতো ভাল ভাবে আর কেই বা চেনে! বিভিন্ন শিল্প সামগ্রীর ছবি এক ঝলক দেখেই ওঁরা বলে দিচ্ছেন কী দিয়ে বানানো হয়েছে। কোনও জিনিস হয়তো উত্তরবঙ্গের বনজ উপকরণে তৈরি। সেটা এখানে পাওয়া যায় না। কিন্তু এখানে মেলে এমন কোন জিনিসটা ব্যবহার করে ওই একই শিল্পদ্রব্য বানিয়ে ফেলা যায়, সেটাও ওঁরা বলতে পারছেন। এখন দরকার শুধু কিছু কৌশল শিখে নেওয়ার।’’
আরও ভাল ভাবে সেই কৌশল শিখতে চলতি মাসের শেষে স্বনির্ভর দলের পাঁচ সদস্য পাড়ি দেবেন তামিলনাড়ুর তুতিকোরিনে। স্বনির্ভর গোষ্ঠী ও স্বনিযুক্তি প্রকল্প দফতরের আধিকারিক অমলবাবু জানান, একটি সংস্থার সঙ্গে তাঁদের কথা হয়েছে। ওই সংস্থাই মহিলাদের কাছে থেকে শিল্প সামগ্রী কিনে নেবে। ওই সংস্থাই প্রশিক্ষণের জন্য পাঁচ জনকে তামিলনাড়ুতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে। যাঁরা প্রশিক্ষণ নিয়ে আসবেন, তাঁরাই বাকিদের শেখাবেন।
জেলাশাসক অলকেশপ্রসাদ রায় বলেন, ‘‘গৃহসজ্জার কাজে এ ধরণের জিনিসপত্রের কদর রয়েছে। বিদেশেও ভাল চাহিদা আছে। বিকল্প অর্থনীতির ভিত মজবুত করতেই আমরা এই ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছি।’’
বিষয়টি নিয়ে আশাবাদী পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদ মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতোও। তিনি বলেন, ‘‘নতুন ধরনের পেশায় স্বনির্ভর মহিলাদের নিয়ে আসতে চাইছি আমরা। পরীক্ষামূলক ভাবে এই প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। বাজার মিললে ভবিষ্যতে জেলার জঙ্গল লগোয়া অন্য ব্লকগুলিতেও এই ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy