Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
সাগর-হত্যার এক বছর

এখনও আতঙ্কে পরিবার, ভরসা কেবল সিবিআই

পরপর গুলি খেয়ে ওই রান্নাঘরেই লুটিয়ে পড়েছিলেন বৃদ্ধ। বহু দিন জমাট রক্ত লেগে থাকা মলিন ওই মেঝের মতোই কিছুটা হতাশা গ্রাস করেছে পরিবারকে। কিন্তু হাল ছাড়তে রাজি নন কেউ-ই। পাড়ুইয়ের বাঁধনব গ্রামে ঠিক এক বছর আগে আজকের দিনেই খুন হয়েছিলেন সাগর ঘোষ। গত এক বছর ধরে নিরীহ ওই বৃদ্ধের হত্যার বিচার পেতে পরিবার বহু লড়াই চালিয়েছে। অভিশপ্ত সেই রাতের আতঙ্ক তাঁরা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি।

সুবিচারের অপেক্ষায়। সোমবার বাঁধনবগ্রামে সরস্বতীদেবীর ছবিটি তুলেছেন বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।

সুবিচারের অপেক্ষায়। সোমবার বাঁধনবগ্রামে সরস্বতীদেবীর ছবিটি তুলেছেন বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।

মহেন্দ্র জেনা
পাড়ুই শেষ আপডেট: ২২ জুলাই ২০১৪ ০০:৫৯
Share: Save:

পরপর গুলি খেয়ে ওই রান্নাঘরেই লুটিয়ে পড়েছিলেন বৃদ্ধ। বহু দিন জমাট রক্ত লেগে থাকা মলিন ওই মেঝের মতোই কিছুটা হতাশা গ্রাস করেছে পরিবারকে। কিন্তু হাল ছাড়তে রাজি নন কেউ-ই।

পাড়ুইয়ের বাঁধনব গ্রামে ঠিক এক বছর আগে আজকের দিনেই খুন হয়েছিলেন সাগর ঘোষ। গত এক বছর ধরে নিরীহ ওই বৃদ্ধের হত্যার বিচার পেতে পরিবার বহু লড়াই চালিয়েছে। অভিশপ্ত সেই রাতের আতঙ্ক তাঁরা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। জেলা পুলিশ, সিআইডি পেরিয়ে সিট, কেউ-ই ওই পরিবারকে সুবিচার দেননি বলে অভিযোগ। এই পরিস্থিতিতে পরিবারের একমাত্র ভরসার জায়গা বলতে হাইকোর্ট। সিট-এর চার্জশিট থেকে দুই মূল অভিযুক্তের নাম বাদ পড়ার পরে তাঁদের আশা, একমাত্র সিবিআই তদন্তেই সাগর-হত্যার প্রকৃত অপরাধীরা শাস্তি পাবেন।

প্রসঙ্গত, পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগের রাতে বীরভূমের পাড়ুই থানার কসবা পঞ্চায়েতে নিজের বাঁধনবগ্রামের বাড়িতে গুলিবিদ্ধ হন ওই নির্বাচনের নির্দল প্রার্থী হৃদয় ঘোষের বাবা, অবসরপ্রাপ্ত বিদ্যালয় কর্মী সাগরচন্দ্র ঘোষ। দিন দু’য়েক হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঁজা লড়ার পরে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। খুনের অভিযোগ ওঠে রাজ্যের শাসক দলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল এবং তাঁর অনুগামীদের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) ওই মামলার চার্জশিটে অনুব্রত-সহ মূল অভিযুক্তদের মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নামই বাদ দিয়েছে।

সোমবার ঘটনার রাতের কথা তুলতেই চুপ করে গেলেন নিহত সাগরবাবুর স্ত্রী সরস্বতী ঘোষ। চৌকাঠ ধরে দীর্ঘ সময় নির্বাক দাঁড়িয়েই রইলেন। এক সময় শুকনো মুখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চাইলেন। শূন্য বেতের মোড়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অভিশপ্ত সেই রাতের কথা বলতে শুরু করলেন। বলতে বলতেই শিউড়ে উঠলেন, “হৃদয়ের মেয়ে দাদু বলতে পাগল ছিল। ওঁর কাছেই সব সময় থাকত। আমার নাতনিটা একেবারে নিসঙ্গ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু যাঁরা লোকটাকে খুন করাল, তাঁদের কবে শাস্তি হবে!”

বাংলা তিথি মেনে অবশ্য গত মঙ্গলবারই সাগরবাবুর প্রথম শ্রাদ্ধবার্ষিকী পালন করেছে পরিবার। নিজের দুই মেয়ে এবং নিকট আত্মীয়দের নিয়ে কোনও মতে সরস্বতীদেবী সেরেছেন সেই কাজ। আজকের দিনে সকলেরই মন ভার। আজ, মঙ্গলবার কলকাতা উচ্চ আদালতে খুনের ঘটনার হলফনামা নিয়ে শুনানি। সরস্বতীদেবী বলেন, “খুনিরা বহাল তবিয়তেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাড়ির আশেপাশে বোমাবাজি করছে। সন্দেহভাজন মোটরবাইক আরোহীরা রাতবিরেতে ঘোরাফেরা করছে। মাঝে মধ্যেই এলাকায় বোমাবাজি করা হচ্ছে।” পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ বৃদ্ধার প্রশ্ন, “এরল পরেও বলবেন, আমরা নিরাপদে আছি? কতটা সুরক্ষিত আমাদের এই পরিবার?” ওই পরিবারের দাবি, এত কিছুর পরেও, শান্তি ফেরেনি কসবা পঞ্চায়েতে। কসবা আছে সেই কসবাতেই। সদ্য বিজেপিতে যোগ দেওয়া কসবার পঞ্চায়েত প্রধান শঙ্করী দাসও বলেন, “এলাকায় কিছু বহিরাগত এসে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। পুলিশ প্রশাসনের দ্বারস্থ হব।” পুলিশ রয়েছে সাগরবাবুদের বাড়িতেও। তবু অজানা আতঙ্ক যেন তাঁদের তাড়া করছে।

আগামী বৃহস্পতিবারই সাগরবাবুর মৃত্যুবার্ষিকী (২০১৩ সালের ২৪ জুলাই হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল)। ওই দিনই আবার সিট-এর চার্জশিট নিয়ে নিজেদের বক্তব্য জানাতে সিউড়ি আদালতে হাজির হওয়ার সমন পেয়েছে সরস্বতীদেবী। ওই তদন্তে তিনি অবশ্য মোটেও সন্তুষ্ট নন। তাঁর ক্ষোভ, “মূল অপরাধীদের আড়াল করার জন্য সিট তদন্তের নামে প্রহসন করেছে।” তবে, বিচার ব্যবস্থার উপর এখনও আস্থা আছে ওই পরিবারের। সরস্বতীদেবী বলেন, “অপরাধীরা পার পাবে না। ঈশ্বর আর আদালতের উপরে বিশ্বাস আছে। এক দিন ঠিক বিচার পাব। এখন সিবিআই-ই আমাদের একমাত্র ভরসা” অন্য দিকে, হৃদয়বাবু জানান, মঙ্গলবার উচ্চ আদালতে সাগরবাবুর খুনের ঘটনায় হলফনামা নিয়ে শুনানিতে যাবেন। গ্রামে দুষ্কৃতীরা বোমাবাজি জারি রাখলেও বাবার খুনিদের শাস্তি দেওয়ার লড়াই তিনি চালিয়ে যাবেন।

এ দিকে, রবিবার বিকেলেই আবার ওই পঞ্চায়েতের কেশবপুর গ্রামে জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠী একটি বৈঠক করেছে বলে খবর। তৃণমূল সূত্রের খবর, কসবা পঞ্চায়েতের সদস্যেরা বিজেপিতে যোগ দেওয়ায় কপালে ভাঁজ পড়েছে নেতাদের। দলে ভাঙন আটকাতে তাই ওই গোষ্ঠী আলোচনায় বসে বলে জানা গিয়েছে। কেশবপুরের ওই বৈঠকে অনুব্রত গোষ্ঠীর নরেশ বাউড়ি, সুবাস পাল, মহুলার শেখ দুলাল, সাত্তোরের আখতার আলিরা সভা করেছেন। সেই খবরে আতঙ্কে সরস্বতীদেবীও। ছেলে হৃদয়ের বাড়ি ফিরতে দেরি হলে, তাঁর সেই চিন্তা আরও বাড়ে।

বাইরে জোর বৃষ্টি নামায় ভিতরে বসার জায়গা করে দিতে দিতে বলছিলেন, “শুনলাম ওরা আবার মিটিং করেছে। চিন্তা হয় জানেন, একটা মানুষকে তো চোখের সামনে চলে যেতে দেখলাম!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

mahendra jena parui sagar-murder case
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE