Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
জনরোষের নামে খুনের ছক

তৃণমূলকে দুষছে নিহতের পরিবার

মুখ্যমন্ত্রীর সভায় যাওয়ার অন্যতম রাস্তায় বিস্ফোরক মেলার পরে, জনরোষের নাম করে আসলে খুনই করা হয়েছে সিউড়ির শেখ হীরালালকে শনিবার এই দাবি করল নিহতের পরিবার এবং সিপিএম। তাদের অভিযোগ, এক সিপিএম কর্মী খুনের মামলায় অন্যতম সাক্ষী ছিলেন কেন্দুয়া পঞ্চায়েতের কেউবোনা-ডাঙালপাড়া গ্রামের বাসিন্দা হীরালাল। যে তৃণমূল কর্মীরা তাঁকে মেরেছে, তাদের অনেকেই ওই খুনের মামলাটিতেও অভিযুক্ত।

নিহত হীরালাল শেখের শেষযাত্রায় শোকার্ত পরিজনেরা। সিউড়ির কেউবোনা ডাঙালপাড়ায় তোলা তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি।

নিহত হীরালাল শেখের শেষযাত্রায় শোকার্ত পরিজনেরা। সিউড়ির কেউবোনা ডাঙালপাড়ায় তোলা তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি।

দয়াল সেনগুপ্ত
সিউড়ি শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:৪৪
Share: Save:

মুখ্যমন্ত্রীর সভায় যাওয়ার অন্যতম রাস্তায় বিস্ফোরক মেলার পরে, জনরোষের নাম করে আসলে খুনই করা হয়েছে সিউড়ির শেখ হীরালালকে শনিবার এই দাবি করল নিহতের পরিবার এবং সিপিএম।

তাদের অভিযোগ, এক সিপিএম কর্মী খুনের মামলায় অন্যতম সাক্ষী ছিলেন কেন্দুয়া পঞ্চায়েতের কেউবোনা-ডাঙালপাড়া গ্রামের বাসিন্দা হীরালাল। যে তৃণমূল কর্মীরা তাঁকে মেরেছে, তাদের অনেকেই ওই খুনের মামলাটিতেও অভিযুক্ত। শুক্রবার ‘পরিকল্পিত ভাবে’ই তারা হীরালালকে খুন করেছে।

হীরালাল খুনে দুই তৃণমূল কর্মী গ্রেফতার হলেও তাঁদের বিরুদ্ধে অনিচ্ছাকৃত খুনের মামলা রুজু করায় পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এ নিয়ে ইতিমধ্যেই সরব হয়েছে বামেরা। একই সঙ্গে যে ‘ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস’ (আইইডি) উদ্ধারের পরে, ‘মমতাকে খুনের গভীর ষড়যন্ত্র চলছে’ বলে হইচই শুরু করেছে তৃণমূল, সেই আইইডি-ও শাসক দলের কর্মীরাই রেখেছেন বলে পাল্টা অভিযোগ জানিয়েছে তারা। প্রসঙ্গত, আইইডি উদ্ধারের ঘটনায় এক তৃণমূল কর্মীর অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ যে পাঁচ জনকে গ্রেফতার করেছে, তারা সবাই সিপিএম কর্মী।

কলকাতায় এ দিন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী প্ররোচনা সৃষ্টি করেছেন। তৃণমূল নেতা-কর্মীদের উত্তেজিত করেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর উত্তেজনার ফসল, আমাদের এক কমরেডের অকালে ঝরে যাওয়া।” হীরালাল-খুনের পরিপ্রেক্ষিতে আজ, রবিবার রাজ্য জুড়ে প্রতিবাদ-দিবস পালন করবে সিপিএম। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীও বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী উত্তেজনা তৈরি করায় এক জন খুন হয়ে গেলেন। নিহতের পরিবারের কাছে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষমা চাওয়া উচিত।’’

বস্তুত, গত কাল সিউড়িতে শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রীর সভা শুরু হওয়ার কিছু আগে সিউড়ি-বোলপুর পিচ রাস্তায় সলখানা গ্রামের কাছে একটি কালভার্টের নীচে যে ভাবে আইইডি উদ্ধার এবং নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। অনেকেই বলছেন, কিছু তৃণমূল সমর্থক যে ভাবে রাস্তায় প্লাস্টিকে মোড়া প্যাকেট পড়ে থাকতে দেখলেন এবং পুলিশ ও ‘অ্যান্টি সাবোতাজ টিম’-এর সদস্যদের সামনে কোনও রকম সাবধানতা না নিয়েই সেটি খুলে ফেললেন, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়।

ওই বিস্ফোরক উদ্ধারের পরেই যে ভাবে রাস্তা দিয়ে যাওয়া শেখ হীরালালকে বাইক থেকে নামিয়ে মারধর করা হয়, তার পিছনেও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা রয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। বিমানবাবু বা সিপিএমের বীরভূম জেলা সম্পাদক দিলীপ গঙ্গোপাধ্যায় শুধু নন, নিহত হীরালালের দাদা তথা কেন্দুয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রাক্তন সিপিএম প্রধান শেখ আনারুলও এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। দিলীপবাবুর কথায়, “তৃণমূলের লোকেরাই কালভার্টের পাশে আইইডি পড়ে থাকতে দেখলেন, পুলিশের আগেই জেনে গেলেন, সেটা সিপিএমের কোন কোন কর্মী সেখানে রেখেছে, পুলিশ পৌঁছনোর আগেই তাঁরা বিপজ্জনক বিস্ফোরকের মোড়ক খুলে ফেললেন এর পরে আমাদের বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না, গল্পটা কারা সাজিয়েছে।”

গণপ্রহারে হীরালালের মৃত্যুর পিছনে সম্পূর্ণ অন্য চক্রান্ত রয়েছে বলেই দাবি আনারুলের। ওই ঘটনায় শেখ নূর হক, শেখ জিয়াউর রহমান, শেখ ইজরাইল, শেখ হাকিব, শেখ আনিস, শেখ নূর আলম, শেখ মানিক, শেখ সেন্টু এই আট জনের বিরুদ্ধে সিউড়ি থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন তিনি। আনারুলের বক্তব্য, ২০১১-র অগস্টে স্থানীয় সিপিএম কর্মী শেখ জিয়াকে খুনের ঘটনায় অন্যতম প্রধান সাক্ষী ছিলেন তাঁর ভাই। শেখ মানিক এবং শেখ সেন্টু ছাড়া বাকি ছ’জন সেই মামলায় অভিযুক্ত। তবে তাঁরা জামিনে মুক্ত রয়েছেন। আনারুল এবং সিপিএমের সিউড়ি জোনাল কমিটির সম্পাদক দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়ের অভিযোগ, “শেখ জিয়া খুনের মামলাটি শীঘ্রই উঠবে। তার আগে হীরালালকে পরিকল্পনা করে খুন করা হল।”

আনারুলের অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ শেখ নূর হক এবং শেখ জিয়াউর রহমানকে ধরেছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে ধৃতদের বিরুদ্ধে পুলিশ ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারায় (অনিচ্ছাকৃত খুন) মামলা করায়। এ নিয়ে সরব সিপিএমের জেলা নেতৃত্বও। বীরভূমের পুলিশ সুপার রশিদ মুনির খানের অবশ্য ব্যাখ্যা, “তদন্তে জানা গিয়েছে, হীরালালকে খুন করার মতলবে মারধর করা হয়নি। তাই ৩০৪ ধারায় মামলা করা হয়েছে।”

শুক্রবারের ঘটনা প্রসঙ্গে আনারুল বলেন, বেলা আড়াইটে নাগাদ তাঁরা দু’ভাই কেউবোনা গ্রামের এক জনের কাছে গরু বিক্রির টাকা আনতে যাচ্ছিলেন। বিস্ফোরক উদ্ধার হয়েছে যেখানে, সেখান থেকে তাঁদের গ্রামের দূরত্ব প্রায় দেড় কিলোমিটার। আনারুলের কথায়, “সলখানার দিক থেকে তৃণমূলের কিছু নেতা-কর্মী আমাদেরই দলের এক কর্মীকে ধাওয়া করে আসছিল। তাদের কয়েক জন আমাকে মোটরবাইক থামাতে বাধ্য করে। লাঠি, টাঙ্গি, ভোজালি, লোহার রড, পিস্তল নিয়ে ওরা চড়াও হয় ভাইয়ের উপরে। ভাইয়ের মাথায়, গলায় ধারালো অস্ত্রের কোপ এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গায় এলোপাথাড়ি রড, লাঠির বাড়ি মারে। চিৎকারে লোকজন জড়ো হলে ওরা পালায়।”

আইইডি উদ্ধারের ঘটনা এবং গণপ্রহারের পরে শেখ জালালউদ্দিন নামে স্থানীয় এক তৃণমূল কর্মী থানায় গিয়ে নূর আলম, শেখ রিন্টু, কারিবুল হোসেন-সহ ছ’জন সিপিএম সমর্থকের বিরুদ্ধে আইইডি রেখে নাশকতার চেষ্টার অভিযোগ দায়ের করেন। এর মধ্যে পাঁচ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিচারক তিন জনকে তিন দিন পুলিশ হেফাজতে এবং দু’জনকে তিন দিন জেল-হাজতে রাখার নির্দেশ দেন। আদালতে কারিবুলদের দাবি করতে শোনা যায়, “এটা সম্পূর্ণ তৃণমূলের সাজানো ঘটনা।”

তৃণমূলের জেলা নেতারা এ দিন দাবি করেন, যে কালভার্টের নীচে আইইডি পাওয়া গিয়েছে, তার আশেপাশেই ধৃতদের অনেকের বাড়ি ও দোকান। বিস্ফোরক দেখতে পাওয়ার পরে তৃণমূলের লোকেরা জানতে চেয়েছিলেন এলাকার বাসিন্দাদের চোখ এড়িয়ে কী ভাবে ওই আইইডি রাখা হল। সদুত্তর পাওয়া যায়নি। তারই ভিত্তিতে থানায় অভিযোগ জানানো হয়। আর পুলিশের বক্তব্য, প্রাথমিক তদন্তে তারা জেনেছে, ধৃতেরা ঘটনার কথা জানতেন। তাই তাঁদের ধরা হয়েছে। কিন্তু পুলিশ বা শাসক দলের এই দাবি উড়িয়ে বিমানবাবুর বক্তব্য, “আমাদের দলের সরাসরি কেন, দূরবর্তী কোনও সমর্থক এ কাজের সঙ্গে যুক্ত নন।”

আর অধীর চৌধুরীর কটাক্ষ, “মুখ্যমন্ত্রী এখন ই-টু ফ্যাক্টরে ভুগছেন! একটা ‘ই’ইলেকশন কমিশন। অন্যটা ‘এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট। এই দুইয়ের চাপে নির্বাচনে তাঁর দলের যে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য উনি মানুষের সহানুভূতি চাইছেন। তাই তাঁকে খুন করার ষড়যন্ত্র চলছে বলে বাহানা করছেন।”

সিউড়িতে ময়না-তদন্তের পরে এ দিন দুপুরে গ্রামে পৌঁছয় হীরালালের দেহ। বাড়িতে তিন মেয়েকে আঁকড়ে বসেছিলেন হীরালালের স্ত্রী রেক্সোনা বিবি। বিড়বিড় করছিলেন, “বিনা দোষে ওকে মেরে ফেলল।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

hiralal sheikh suri
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE