চলছে প্রতিমা তৈরি। সোমবার ছবিটি তুলেছেন সোমনাথ মুস্তাফি।
ওঁরা রোজা রাখেন। নমাজও পড়েন। আবার দুর্গাপুজোয় হাতও লাগান। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এমন নজিরই গড়েছে নানুরের পাপুড়ি গ্রাম।
এক সময় রাজ্য রাজনীতিতে সংবাদ শিরোনামে বার বার উঠে এসেছে পাপুড়ি গ্রামের নাম। রাজনৈতিক ক্ষমতা তথা গ্রাম দখলকে কেন্দ্র করে সিপিএম-তৃণমূল সংঘর্ষ ছিল নিতদিনের ব্যাপার। গোলা-গুলি, দু’একটা খুন-জখম গ্রামের মানুষের কেমন যেন গা’সওয়া হয়ে গিয়েছিল। কখনও দিনের পর দিন গ্রাম ছাড়া থাকতে হয়েছে তৃণমূল নেতাকর্মীদের। একই ঘটনা ঘটেছে সিপিএম কর্মী-সমর্থকদের ক্ষেত্রেও। দিন এমনও গিয়েছে ঘর ছাড়াদের ফেরাতে উভয় পক্ষকে নিয়ে ভোজে বসতে হয়েছে প্রশাসনের উচ্চ পদস্থ কর্তাদেরও। রাজনৈতিক অস্থিরতাময় সেই গ্রামটিই এখন সব কিছু দূরে সরিয়ে রেখে মেতে উঠেছে দুর্গাপুজো নিয়ে।
গ্রামে এতদিন কোনও দুর্গাপুজো ছিল না। তাই পুজোর আগেই মা দুর্গার মতোই ছেলে-মেয়েদের নিয়ে বাপেরবাড়ি চলে যেতেন গৃহবধূরা। বাড়ি আগলে পুজোর ক’টা দিন একাকী সময় কাটত পুরুষদের। ইচ্ছে থাকলেও পুজো প্রচলনের সাধ্য ছিল না সন হাজরা, শ্যামচাঁদ বাগদিদের। গ্রামে প্রায় ১১০০ পরিবারের বাস। ২৫০টি পরিবার হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত। ওই পরিবারগুলির মধ্যে ৯৫ শতাংশই দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী তফসিলি সম্প্রদায়ভুক্ত। তাই ইচ্ছে থাকলেও পুজো করার মতো সামর্থ ছিল না তাঁদের। দীর্ঘদিনের সেই ইচ্ছেটাই পূরণ করে দিয়েছেন গ্রামের সংখ্যালঘু মানুষজন। গতবছর থেকে তাঁদেরই সহযোগিতায় গ্রামে চালু হয়েছে পুজো। ওই গ্রামেই বাড়ি কেতুগ্রামের তৃণমূল বিধায়ক শেখ শাহনাওয়াজের। মূলত তাঁরই ভাই কাজল শেখের নেতৃত্বে ওই পুজোয় সামিল হয়েছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষজন।
সামিল হওয়া মানে নিছক চাঁদা দিয়ে দায় সারা নয়। পাড়ার মেয়ের বিয়ে পার করার মতোই হইহই করে নেমে পড়েছেন সকলে। প্রতিমা শিল্পীকে তাড়া দেওয়া, মণ্ডপ বাঁধা, বিচিত্রানুষ্ঠানের স্থান নির্বাচন থেকে শুরু করে নবমীর পঙ্ক্তিভোজের মেনুও শ্যামল ঘোষ, অপূর্ব দাসদের সঙ্গে আলোচনায় ঠিক করছেন ডালিম শেখ, সুকুর শেখরা। সুকুরদের বক্তব্য, “সবদিক লক্ষ্য না রাখলে চলে! হিন্দুভাইরা তো পেটের তাগিদে সকালে বেরিয়ে সন্ধ্যায় ফেরেন। কোন কিছুর ত্রুটি হলে তো গ্রামেরই বদনাম হবে। তখন কাজলভাই’র বকা খেতে হবে।” নাসির শেখদের এহেন আন্তরিকতায় আবেগে আপ্লুত সন হাজরা, অশোক গুঁইরা। তাঁদের কথায়, “ওঁরা না থাকলে পুজো চালু করার কথা ভাবতেও পারতাম না। পুজোর ক’টা দিন স্ত্রী- ছেলেমেয়েদের ছেড়ে থাকতে খুব কষ্ট হত। কাজলভাইয়ের জন্য গত বছর থেকে আমাদের সেই কষ্ট দূর হয়েছে।”
পুজো চালু হওয়ায় খুশির হাওয়া মহিলা মহলেও। আল্পনা ঘোষ, সুলেখা দে, টুম্পা দে’রা বলেন, “আমাদের দীর্ঘদিনের ইচ্ছে ছিল গ্রামে একটি পুজো চালু হোক। সংখ্যালঘু ভাইবোনেদের সহযোগিতায় গত বছর সেই ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। কী ভাল যে লাগছে তা বলে বোঝাতে পারব না।” পুজো চালু করার ব্যাপারে সংখ্যালঘু মহিলাদের অবদানও কম নয়। মালা বিবি, মেহেনিকা বিবি, আফরুন্নেষা বিবিরা বলেন, “একই পুকুর ঘাটে বাসন মাজা, কাপড় কাচা কিংবা স্নান করার সময় নানা সুখদুঃখের কথা হয়। তখনই ওঁদের মুখে গ্রামে পুজো না থাকায় আক্ষেপ শুনেছিলাম। তারপর পুরুষদের বলেছিলাম, দেখ কিছু করা যায় কি না। পুজো চালু হওয়ায় আমরাও আনন্দ উপভোগ করি।” কম যায় না কচিকাঁচারাও। দশম শ্রেণির মনিকা ঘোষ, ষষ্ঠ শ্রেণির জাহির শেখদের কথায়, “এখন আর আমাদের অন্য গ্রামে পুজো দেখতে যেতে হয় না। সারাদিন হুটোপাটি করে কাটিয়ে দিই। কী যে মজা হয়।”
আর কাজল? তিনি বললেন, “আমাদের নানা পরব হয়। আমরা আনন্দ করি। পুজোর সময় দেখতাম হিন্দু ভাইবোনেরা মনমরা হয়ে রয়েছে। তখনই ঠিক করি পুজো চালু করতে হবে। সেই মতো বৈঠক ডেকে গ্রামবাসীদের বলি, প্রয়োজনে পরবের বাজেট ছেঁটে পুজোর ব্যবস্থা করতে হবে। সকলেই একমত হয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। এখন তো আক্ষরিক সর্বজনীন হয়ে গিয়েছে এই পুজো।”
গ্রামবাসীদের কথায়, “পুজো-পরব মূলত আমাদের কাছে উৎসব। পুজো মণ্ডপের অদূরেই রয়েছে মসজিদ। কিন্তু এক ধর্ম অন্য ধর্মের উপর কোনও ছায়া ফেলে না। যখন মসজিদে আজান হয় তখন ধর্মীয় সৌজন্যেই বন্ধ রাখা হয় ঢাক। আরতির সময় থেমে যায় মসজিদের মাইক।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy