Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ধনুক হাতে ভেল্কি সত্তরের চুনারামের

প্রতিযোগিতা শেষে ঘোষকের মুখে ফের চুনারামবাবুর নাম। পাঁচ জেলার প্রতিযোগীদের মধ্যে তিনি দ্বিতীয় স্থান দখল করেছেন। আর এক দফা হাততালি পড়ল সত্তর বছরের এই বৃদ্ধের জন্য।

দুই-প্রজন্ম: প্রথম রাজীব সোরেন ও দ্বিতীয় চুনারাম সোরেন। ছবি: সুজিত মাহাতো

দুই-প্রজন্ম: প্রথম রাজীব সোরেন ও দ্বিতীয় চুনারাম সোরেন। ছবি: সুজিত মাহাতো

প্রশান্ত পাল
পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০১৭ ০২:২৫
Share: Save:

জঙ্গলমহল কাপের তিরন্দাজি প্রতিযোগিতার ফাইনাল। এক এক করে নাম ডাকা হচ্ছে, ধনুক বাগিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম ও বীরভূম জেলার প্রতিযোগীরা। ঘোষক ডাকলেন— চুনারাম সোরেন...। দেখা গেল, ভিড়ের মধ্যে থেকে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা এক ব্যক্তি এক গাল সাদা দাড়ি দুলিয়ে ধনুক নিয়ে এগিয়ে আসছেন। দর্শকদের মধ্যে ততক্ষণে গুঞ্জন শুরু হয়েছে— ‘‘ইনি কে?’’ কারও কারও মুখে ফিচেল হাসি— ‘‘এই বয়সে তির ছুড়বেন না কি?’’ সেটাই হল। ধনুকের ছিলায় তির লাগিয়ে লক্ষ্যস্থির করলেন চুনারামবাবু। তির বিঁধে গেল নির্দিষ্ট লক্ষ্যে। একবার নয়, পরপর ন’টি তিরই বিঁধল টার্গেটে বা তার সামান্য পাশে। ততক্ষণে দর্শকদের অনেকের হাসি থেমে গিয়ে বিস্ময়ে কখন মুখ হাঁ হয়ে গিয়েছে। মঙ্গলবার বেলায় ধনুক নিয়ে যখন চুনারামবাবু ফিরে আসছেন, তখন পুরুলিয়া এমএসএ ময়দান হাততালিতে ভরে উঠেছে।

প্রতিযোগিতা শেষে ঘোষকের মুখে ফের চুনারামবাবুর নাম। পাঁচ জেলার প্রতিযোগীদের মধ্যে তিনি দ্বিতীয় স্থান দখল করেছেন। আর এক দফা হাততালি পড়ল সত্তর বছরের এই বৃদ্ধের জন্য। এই প্রতিযোগিতার মঞ্চে আরও এক বিস্ময় সপ্তম শ্রেণির পড়ুয়া তিরন্দাজ রাজীব মাহাতো। সে এই প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে। পুরুলিয়া জেলা পুলিশ সুপার জয় বিশ্বাস বলেন, ‘‘এখানে একই প্রতিযোগিতায় সপ্তম শ্রেণির পড়ুয়া প্রথম হলেন, আর দ্বিতীয় হলেন সত্তর বছরের বৃদ্ধ। জঙ্গলমহল কাপ হল বলেই মানুষ এই বৈচিত্র্য দেখতে পেলেন।’’

বোরো থানার বাঘাবাইদ গ্রামের চুনারাম পুলিশের আয়োজিত জঙ্গলমহল কাপের তিরন্দাজি প্রতিযোগিতায় ধনুক তুলে নিয়েছিলেন খানিকটা কৌতূহলবশতই। এক সময়ে শখে বনে ঢুকে তির-ধনুক হাতে ঘুরে বেড়াতেন তিনি। কিন্তু কোনও দিন ভাবেননি, সেই ধনুকই তাঁকে এত বড় সম্মান এনে দেবে। তাঁর কথায়, ‘‘তিরন্দাজির পুরস্কার একবার অবশ্য পেয়েছিলাম। তখন জোয়ান বয়স। সেই কংগ্রেস আমলের কথা। এখন ডান চোখে দেখতে পাই না। তাই এই বয়সেও হাত, চোখ যে সঙ্গ দেবে, ভাবতে পারিনি।’’

নিজেদের এলাকার এই সম্মানপ্রাপ্তিতে উচ্ছ্বসিত বোরো থানা এলাকার এক পুলিশ কর্মীর মন্তব্য, ‘‘এ তো চুনারামবাবুর সেই আসা, দেখা আর জয় করার মতো ব্যাপার। এক চোখ খারাপ। তা সত্ত্বেও থানাস্তর থেকে জেলাস্তরের প্রতিযোগিতায় সুনাম কুড়িয়েছেন চুনারামবাবু। আর এ বার চূড়ান্ত পর্যায়ের প্রতিযোগিতাতেও তিনি দেখিয়ে দিলেন তাঁর কেরামতি।’’

সাই-এর (স্পোর্টস অথোরিটি অব ইন্ডিয়া) প্রশিক্ষিত পুরুলিয়ার তিরন্দাজ মতিলাল শবর ছিলেন মাঠে। তাঁর কথায়, ‘‘এই বয়সে চুনরামবাবু যা করে দেখালেন, তা অন্য তিরন্দাজদের কাছে অনুপ্রেরণা। এখনও তাঁর যা স্কিল, বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতে হয়।’’

চুনারামের অবশ্য এতে বিশেষ হেলদোল নেই। তিনি বলেন, ‘‘এই সব প্রতিযোগিতার ধনুকে আমার সে রকম অভ্যাস নেই। বাঁশের ধনুক হলে আরেকটু ভাল হতো।’’ স্কোরবোর্ড জানাচ্ছে, প্রথম স্থানাধিকারীর পয়েন্ট যেখানে ৬৮,সেখানে চুনারামবাবু স্কোর করেছেন ৫৫। চুনারামবাবু বলছেন, ‘‘আমাদের দিন গিয়েছে। নতুন প্রজন্মের থেকে ভাল তিরন্দাজ উঠে এলে ভাল লাগবে।’’

নতুন প্রজন্ম অবশ্য চুনারামবাবুকে হতাশ করেনি। তাঁর বিভাগে প্রথম হয়েছে বরাবাজার থানার গোবিন্দপুরের বাসিন্দা সপ্তম শ্রেণির পড়ুয়া রাজীব মাহাতো। পুলিশের উদ্যোগে বরাবাজারে ‘লক্ষ্য’ নামে তিরন্দাজির একটি শিবির চলছে বেশ কয়েক মাস ধরে। রাজীব সেখানকারই ছাত্র।

এই কিশোরকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন পুলিশ কর্তারা। এক পুলিশ কর্তা জানান, রাজীবের ছোড়া ন’টি তিরের মধ্যে আটটিই বুলে (টার্গেট বোর্ডের মাঝে) লেগেছে। রাজীবের কথায়, ‘‘আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি।’ চুনারামবাবু বলছেন, ‘‘রাজীবদের মতো অনেক প্রতিভাবান রয়েছে। দরকার শুধু খুঁজে আনা।’’ এসপি-রও বক্তব্য, ‘‘সেটাই জঙ্গলমহল কাপের লক্ষ্য।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Archery tournament Elderly Archer
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE