Advertisement
১০ মে ২০২৪

বাড়তি দিনেও বাধার নালিশ, ব্লক অফিসের বাইরে বোমা

তিনি লাঠি চালানোর অভিযোগ মানতে চাননি। এমনকী শাসকদলের কেউ বোমাবাজি করছে বলেও তিনি মানতে চাননি।

পিস্তল হাতে: সোনামুখী ব্লক অফিস থেকে এক কিলোমিটার দূরে নফরডাঙার কাছে। নিজস্ব চিত্র

পিস্তল হাতে: সোনামুখী ব্লক অফিস থেকে এক কিলোমিটার দূরে নফরডাঙার কাছে। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০১৮ ১০:১৮
Share: Save:

ছবিটা বদলাল না। সোমবার, পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন জমা দেওয়ার বর্ধিত দিনেও জেলার ব্লক ও মহকুমাশাসকের দফতরগুলির সামনে দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য দেখা গেল। অভিযোগ উঠল বিরোধীদের হামলার। তবে তৃণমূলের কটাক্ষ, বিরোধী দলগুলি প্রার্থী জোড়ার না করতে পারার লজ্জা ঢাকতে এই সমস্ত অভিযোগ তুলছে।

বাঁকুড়া শহর
সোমবার মহকুমাশাসকের দফতরে জেলা পরিষদের আসনগুলির জন্য মনোনয়ন জমা নেওয়া হচ্ছিল। বাঁকুড়া জেলাশাসকের দফতর চত্বরেই সদর মহকুমাশাসকের অফিস। এ দিন জেলাশাসকের দফতরে ঢোকার মূল দরজার বাইরের রাস্তায় ছিল দুষ্কৃতীদের জমায়েত। দফতরের পিছনে জেলা গ্রন্থাগারের সামনেও।

এসইউসির কয়েকজন প্রার্থী মনোনয়ন জমা করতে যাচ্ছিলেন। দলের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য স্বপন নাগ বলেন, ‘‘আমাদের তিন জন প্রার্থী দুষ্কৃতীদের নজর এড়িয়ে কোনও মতে মহকুমাশাসকের দফতরের চত্বরে পৌঁছেছিলেন। সেখানে তৃণমূলের লোকজন তাঁদের মারধর করে বের করে দেয়।’’ তবে বিজেপি বা বামেদের মহকুমাশাসকের দফতর চত্বরে দেখা যায়নি। বাড়তি একটা দিন পাওয়া গেলেও কেন মনোনয়ন জমা দিতে গেলেন না? সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য কিঙ্কর পোশাক বলেন, ‘‘আগের দফায় ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েতের প্রার্থীরা একসঙ্গে মহকুমাশাসকের দফতরে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু এ বার মহকুমাশাসকের অফিসে শুধু জেলা পরিষদের মনোনয়ন জমা দেওয়া যাচ্ছিল। কয়েকজন মাত্র প্রার্থীকে নিয়ে প্রতিরোধ সম্ভব নয় ভেবেই ঝুঁকি নিইনি।’’ বিজেপির রাজ্য নেতা সুভাষ সরকার অবশ্য বলেছেন, ‘‘দলের সমস্ত প্রার্থীরাই মহকুমাশাসকের দফতরে মনোনয়ন জমা দিতে গিয়েছিলেন। দুষ্কৃতীরা তাঁদের ঢুকতে দেয়নি। আমরা এ নিয়ে জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে অভিযোগ জানিয়েছি।’’

মহকুমাশাসকের দফতর চত্বরে জেলা তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক জয়দীপ চট্টোপাধ্যায় এবং যুব তৃণমূলের সভাপতি শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়দের দেখা গিয়েছে দলীয় কর্মীদের সঙ্গে বসে থাকতে। তাঁদের দাবি, তৃণমূলের কেউ কোনও বিরোধী প্রার্থীকে বাধা দেয়নি। তৃণমূলের জেলা সভাপতি অরূপ খানের কটাক্ষ, ‘‘সিপিএম আর বিজেপির সংগঠন বলে কিছু নেই। তা না হলে দলীয় প্রার্থীরা মনোনয়ন জমা দিতে আসতেন। প্রার্থী জোগাড় করতে না পারার লজ্জা ঢাকতে বারবার তৃণমূলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে ওঁদের নেতারা মুখ বাঁচানোর চেষ্টা করছেন।’’

ছাতনা
সকাল থেকেই ছাতনা ব্লক অফিস চত্বরে ছিল উত্তেজনা। বিজেপির দাবি, মনোনয়ন জমা করার জন্য তাঁদের প্রার্থীরা ব্লক অফিসের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন। দলের নেতাদের অভিযোগ, সেই সময়ে তাঁদের উপরে তৃণমূল-আশ্রিত দুষ্কৃতীরা চড়াও হয়। প্রতিরোধ করা হলে বোমাবাজি করতে করতে এলাকা ছাড়ে দুষ্কৃতীরা। খবর পেয়ে এলাকায় আরও পুলিশ পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পুলিশ জানিয়েছে, বোমাবাজির ঘটনায় কেউ জখম হননি।

ব্লক অফিস খোলার পরে বিজেপি প্রার্থীরা ভিতরে যান। সেই সময়ে আবার তাঁদের উপরে দুষ্কৃতীরা চড়াও হয় বলে অভিযোগ। বিজেপির এক মহিলা প্রার্থী দেড় বছরের সন্তানকে কোলে নিয়ে এসেছিলেন বিডিও অফিসে। ঝামেলার মধ্যে তিনি আটকে পড়লে কোনও মতে পুলিশ তাঁকে ব্লক অফিস চত্বর থেকে বের করে আনে। এর পরে বিশাল পুলিশ বাহিনী অফিসের ভিতরে ঢুকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে লাঠিচার্জ শুরু করে। ঘটনাস্থলে থাকা কিছু গাড়িতেও ভাঙচুর হয়। তবে দিনের শেষে বিজেপির ছাতনা মণ্ডল সভাপতি অশোক বিদ পঞ্চায়েত সমিতির একটি আসনে মনোননয়ন জমা করেছেন। তাঁর দাবি, মারধরের পরেই তিনি ব্লক অফিসে সংজ্ঞা হারিয়ে পড়ে যান। প্রশাসনের কর্মীদের একাংশ তাঁকে একটি ঘরে নিয়ে গিয়ে রাখেন। জ্ঞান ফিরতে ফিরতে ঝামেলা মিটে গিয়েছিল। তখনই মনোনয়ন জমা করেন।

ছাতনায় হামলার অভিযোগ তুলেছে বামেরাও। দুপুরে বামপ্রার্থীরা হেঁটে যাচ্ছিলেন মনোনয়ন জমা করতে। তাঁদের অভিযোগ, পথে তৃণমূল-আশ্রিত দুষ্কৃতীরা বোমা, পাথর ইত্যাদি নিয়ে হামলা চালায়। আরএসপির জেলা সম্পাদক গঙ্গা গোস্বামীর অভিযোগ, ‘‘তৃণমূল-আশ্রিত দুষ্কৃতীদের কাছে বন্দুকও ছিল। ওরা কয়েক রাউন্ড গুলিও চালিয়েছে।’’ তাঁর দাবি, এই ঘটনায় বাম প্রার্থীদের অনেকেই জখম হয়েছেন। ঘটনার পরে তাঁরা থানায় গিয়ে বিক্ষোভ দেখান। ছাতনা বাইপাস মোড়ে বাঁকুড়া-শালতোড়া রাস্তা ঘণ্টাখানেকের জন্য অবরোধও করা হয়। তবে বাম এবং বিজেপি প্রার্থীদের উপরে তৃণমূলের কেউ কোনও রকমের হামলা করেননি বলে শাসকদলের তরফে দাবি করা হয়েছে।

ওন্দা
৬০ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশে ওন্দা ব্লক অফিস। তার এক দিকে ওন্দা বাজার। সেখানে লাঠি, রড ও ধারাল অস্ত্র হাতে দুষ্কৃতীদের জমায়েত দেখা গিয়েছে। অন্য দিকেও মেরেকেটে দুশো মিটার দূরে ছিল একই রকমের জটলা। পুলিশকে কোনও পদক্ষেপ করতে দেখা যায়নি। বিরোধীদের অভিযোগ, জাতীয় সড়কে মোটরসাইকেল, গাড়ি, এমনকী বাস থামিয়েও দুষ্কৃতীরা তল্লাশি চালিয়েছে। বিজেপির তরফে দাবি করা হয়েছে, সশস্ত্র জমায়েত দেখে তাঁদের প্রার্থীরা মনোনয়ন জমা না করেই ফিরে আসেন। এর পরেই থানায় গিয়ে বিক্ষোভ দেখানো হয়। প্রায় আধঘণ্টা ধরে অবরোধ চলে জাতীয় সড়কে। বিজেপির ওন্দা মণ্ডল সভাপতি কল্যাণ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘দুষ্কৃতীরা বোমা, বন্দুক, তলোয়ার নিয়ে রাস্তার উপরে দাঁড়িয়েছিল। দেখে আমরা পুলিশের কাছে নিরাপত্তা চাইতে যাই। কিন্তু পুলিশ আমাদের দাবি শোনেইনি। প্রতিবাদে বিক্ষোভ এবং পথ অবরোধ করা হয়েছে।’’ তবে দিনের শেষে পুলিশ জানিয়েছে, এই ব্যাপারে‌ কোনও অভিযোগ আসেনি।

বড়জোড়া
সিপিএমের অভিযোগ, প্রার্থীরা মনোনয়ন জমা করতে বড়জোড়া ব্লক অফিসে যাওয়ার পথে দুষ্কৃতীদের হামলার মুখে পড়েন। অনেক প্রার্থীকেই বাস থেকে নামিয়ে মারধর করা হয়। সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য সুজয় চৌধুরী বলেন, ‘‘সন্ত্রাসের বাধা টপকে প্রার্থীরা এরিয়া কমিটির অফিসে পৌঁছে গিয়েছিলেন। আমরা ঐক্যবদ্ধ ভাবে ব্লক দফতরের দিকে যাচ্ছিলাম। দেখেই তৃণমূলের লোকজন বোমাবাজি শুরু করে। এর পরে ঝুঁকি না নিয়ে ফিরে যাই।’’ এ দিন গঙ্গাজলঘাটি, মেজিয়া, শালতোড়া ব্লকেও বিরোধী প্রার্থীদের অভিযোগ উঠেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই অভিযোগ অস্বীকার করেছে তৃণমূল।

সোনামুখী
বিরোধীদের অভিযোগ, এ দিন সকাল থেকেই সোনামুখী ব্লক অফিসের সামনে জমায়েত করেছিলেন তৃণমূল কর্মীরা। সিপিএমের বিধায়ক অজিত রায়ের দাবি, ‘‘এই ব্লকে বিরোধীরা একটিও মনোনয়ন করতে পারেনি। তাই এ দিন বামফ্রন্ট্রের প্রার্থীদের মনোনয়ন করাব বলে ১০টি পঞ্চায়েতের প্রার্থীদের নিয়ে ব্লক অফিসে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ব্লক অফিসের কিছুটা আগেই তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা এক মহিলা প্রার্থীকে মারধর করে তাঁর ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। পুলিশকে জানালেও কিছুই করেনি।’’ এর পরেই তাঁরা সোনামুখী চৌমাথায় অবরোধে বসে পড়েন। ঘণ্টাখানেকের জন্য আটকে যায় বাঁকুড়া-বর্ধমান ও বিষ্ণুপুর-দুর্গাপুর রাস্তা। বিধায়কের অভিযোগ, পুলিশ আশ্বাস দিলেও শেষ পর্যন্ত দুষ্কৃতীদের সরাতে পারেনি। তাঁরা থানায় গিয়ে বিক্ষোভ দেখান। কিন্তু মনোনয়ন দেওয়া আর হয়নি।

সোনামুখী ব্লক অফিস থেকে এক কিলোমিটার দূরে নফরডাঙার কাছে, বিষ্ণুপুর-দুর্গাপুর রাস্তায় বিজেপি কর্মীরা এ দিন সকালে জমায়েত করেছিলেন। বিষ্ণুপুর সাংগঠনিক জেলার মহিলা মোর্চার সভাপতি শম্পা গোস্বামীর অভিযোগ, ‘‘আমরা সবে মনোননয় করতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। সেই সময় হঠাৎ শাসকদলের আশ্রিত দুষ্কৃতীরা বোমা ছুড়তে ছুড়তে আমাদের দিকে তেড়ে আসে। কয়েকজন আবার পিস্তল উঁচিয়ে হুঙ্কার দিচ্ছিল। তাদের পিছু পিছু পুলিশ এসে উল্টে আমাদের কর্মীদেরই লাঠিপেটা করে।’’

যদিও এসডিপিও (বিষ্ণুপুর) সুকোমলকান্তি দাসের দাবি, ‘‘বিজেপি কর্মীরা পুলিশ কর্মীদের দিকে বেপরোয়া ইট ছুড়ছিল। এক জন এএসআই এবং ইএফআর বাহিনীর একটি গাড়ির চালক ইটের ঘায়ে জখম হন। গাড়িও ভাঙচুর করা হয়। সে জন্য তিন জন বিজেপি কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’’ তিনি লাঠি চালানোর অভিযোগ মানতে চাননি। এমনকী শাসকদলের কেউ বোমাবাজি করছে বলেও তিনি মানতে চাননি।

সোনামুখীর পুরপ্রধান তথা তৃণমূলের জেলা নেতা সুরজিৎ মুখোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘আমাদের লোকেরা ব্লক অফিসে জমায়েত করেছিলেন, গণতন্ত্রের উৎসবের আনন্দে। বিরোধীরা প্রার্থীই পায়নি বলে নানা গল্প ফাঁদছে। বরং ওরা বোমা, অস্ত্র নিয়ে ঘুরছে বলে খবর ছিল। পুলিশকে জানিয়েছিলাম।’’

দিনের শেষে জেলা কংগ্রেসের সভাপতি নীলমাধব গুপ্তও দাবি করেছেন, বেশ কিছু জায়গায় তাঁদের প্রার্থীরা মনোনয়ন জমা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু দুষ্কৃতীদের বাধায় ফিরে আসতে হয়েছে। বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার সুখেন্দুর হীরা বলেন, ‘‘বাঁকুড়ায় বিজেপির জেলা অফিসে হামলা এবং ছাতনায় সংঘর্ষের অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়া আর কোনও অভিযোগ পাইনি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

nomination
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE