Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

পড়ুয়ার মতো স্কুলে কাটালেন বন্দিরাও

সাজাপ্রাপ্ত আসামীকে সংশোধন করে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার জন্যেই জেল এখন সংশোধানাগার।

একমনে: দুবরাজপুরের চিনপাই উচ্চবিদ্যালয়ে। শনিবার। নিজস্ব চিত্র

একমনে: দুবরাজপুরের চিনপাই উচ্চবিদ্যালয়ে। শনিবার। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
দুবরাজপুর শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭ ০২:০২
Share: Save:

কারাগারের চার দেওয়ালে থেকে পড়াশোনা করে ডিগ্রি পেলেও, ওঁদের অধিকাংশই যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত। সেই পড়াশোনা শেখাটাই যে আর পাঁচটা পড়ুয়ার মতো করে স্কুলে একটা দিন কাটাবার সুযোগ করে দেবে, ভাবতেও পারেননি ওঁরা। সেটাই সত্যি হল শনিবার। এ দিন সকালে দুবরাজপুরের চিনপাই উচ্চবিদ্যালয়ে ‘এক্সপোজার ভিজিটে’ এসেছিলেন সিউড়ি জেলা সংশোধনাগারের আট আসামী। তাঁদের উপলব্ধি, ‘‘জেল থেকে সংশোধানগার নাম পরিবর্তনের সার্থকতা আজ সত্যিই অনুভব করলাম।’’ আয়োজক স্কুল, জেল কর্তৃপক্ষ, প্রশাসনের কর্তারা বলছেন, ‘‘একটা ঐতিহাসিক দিনের সাক্ষী থাকলাম আমরাও।’’

সাজাপ্রাপ্ত আসামীকে সংশোধন করে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার জন্যেই জেল এখন সংশোধানাগার। শনিবারের এক্সপোজার ভিজিট সেই লক্ষ্যেরই একটা ধাপ। জেলা সংশোধনাগারের এমন চেষ্টা এই প্রথমও। এ দিন সকাল পৌনে এগারোটা নাগাদ সিউড়ি জেলা সংশোধনাগার থেকে স্কুলে আনা হয় আট বন্দিকে। তবে প্রিজন ভ্যানে নয়, বাসে। সতর্কতা হিসেবে স্কুলে ও বন্দিদের সঙ্গে পুলিশের কড়া নিরাপত্তার বেষ্টনী ছিল। কিন্তু, তার বাইরে আর পাঁচ জনের সঙ্গে যে ব্যবহার করা হয়, এ দিন সংশোধনাগারের আবাসিকদের সঙ্গেও ছিল একই ব্যবহার। বিদ্যালয়ে ওঁদের আসার অপেক্ষায় ছিলেন, সিউড়ির মহকুমাশাসক কৌশিক সিংহ, জেল কল্যাণ আধিকারিক পম্পা চক্রবর্তী, রবীন্দ্রমুক্ত বিদ্যালয় সংসদের সভাপতি ফাল্গুণী মুখোপাধ্যায়, দুবরাজপুরের বিডিও বনমালি রায়, বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীরা।

প্রথমেই স্কুলের মিউজিয়াম ঘুরে দেখেন সাজাপ্রাপ্ত মুস্তাক আহমেদ, রাজকুমার চিত্রকর, ইয়ানব শেখ, বৈদ্যনাথ ধীবর, হারু মুর্মুরা। যাঁরা প্রত্যেকেই পড়াশোনা করছেন। কেউ মাধ্যমিক, কেউ উচ্চমাধ্যমিক, কেউবা স্নাতক স্তরে। প্রধান শিক্ষক বিদ্যুৎ মজুমদার, অভিজিৎ দাস ও কাকলি ঘোষেরা তাঁদের জীববিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, ভূগোলের নানা প্রশ্নের উত্তর দেন। এরপরেই স্কুলের সভকক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। কেন তাঁদের এখানে আনা হল, প্রকৃত উদ্দেশ্য কী এমন নানা বিষয়ে বক্তব্য রাখেন এসডিও, বিডিও, রবীন্দ্রমুক্ত বিদ্যালয় সংসদের সভাপতি থেকে জেলকল্যাণ আধিকারিক, সবাই।

মহকুমাশাসক কৌশিক সিংহ বলছেন, ‘‘বিদ্যালয় থেকে পড়ুয়ারা শিক্ষামূলক ভ্রমণে যায়। তাতে মনের ব্যাপ্তি বাড়ে। সংশোধানগারের আবাসিকেরাও পড়াশোনা করছেন। এখানে আনার উদ্দেশ্যও একই।’’ রবীন্দ্রমুক্ত বিদ্যালয় সংসদের সভাপতি ফাল্গুণীবাবু বলছেন, ‘‘প্রকৃত শিক্ষাই পারে অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরাতে। ক্ষণিকের ভুলে কেউ অন্যায় করলেও শিক্ষাই পারে অন্ধকার রাস্তা থেকে মূল পথে ফেরার সুযোগ করে দিতে। একই সুর এবং জেল কল্যাণ আধিকারিক পম্পা চক্রবর্তীর।

প্রশ্ন হল, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তদের আজীবন সাজা খাটতে হয়। তা হলে এঁদের ক্ষেত্রে সেই ব্যতিক্রম ঘটবে কী ভাবে? জেল কর্তারা মনে করাচ্ছেন, গত বছর, ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন সংশোধনাগার থেকে একসঙ্গে ১০৫ জন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামীকে মুক্ত করা হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে অনেকে হাতের কাজ শিখেছিলেন। পড়াশোনা করে ডিগ্রি অর্জনও করেছিলেন। ৪৯ জনকে কাজের সুযোগও করে দেওয়া হয়। ‘স্টেট রেমিশন বোর্ড’ অনুমোদন দিলে কয়েক’টি বিশেষ ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামীকে যাবজ্জীবনের ন্যূনতম সাজার মেয়াদ পূর্ণ করার পরে তাঁদের মুক্ত করা যায়। জেলা সংশোধনাগারের সুপারিনটেনডেন্ট আবদুল্লা কামাল বলছেন, ‘‘ওঁরা ওই সুবিধাটা পেতেই পারেন। তাই এই উদ্যোগ।’’

কেন চিনপাই উচ্চ বিদ্যালয়, তারও কারণ রয়েছে। জানা গিয়েছে, পরিকাঠামোর দিকে থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ চিনপাই উচ্চবিদ্যালয়। রবীন্দ্রমুক্ত বিদ্যালয়ের জেলার অন্যতম কেন্দ্রও বটে। এ বার মুক্ত বিদ্যালয় থেকে উচ্চমাধ্যমিক দেবেন বন্দি ইয়ানব শেখ, মুস্তাক আহমেদরা। এ দিনের অনুষ্ঠান শেষে তারা বলছেন, ‘‘কিছুতেই পড়াশোনা ছাড়তে চাই না।’’ একই দাবি মাধ্যমিক পাশ করা রাজকুমার চিত্রকরেরও। তাঁদের জীবন একেবারেই যে বৃথা নয়, তা বোঝাতে এ দিনের অনুষ্ঠানে হাজির করা হয়েছিল হরিদাস গোপ নামের এক যুবককে। যিনি বেশ কয়েক বছর সাজা খেটে গত মে মাসে সিউড়ি সংশোধনাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। হরিদাস সংশোধনাগারে থেকেই মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এবং নেতাজি মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে (অনার্স সহ) স্নাতক হয়েছেন।
মুক্তির পরে প্রস্তুতি চলছে এমএ-তে ভর্তি হওয়ার। এমন একটা আয়োজনে খুশি চিনপাই উচ্চ বিদ্যালয়ের পড়ুয়ারাও। একাদশ শ্রেণির অদিতি সরকার, রিঙ্কি বাউড়ি, আরজিনা খাতুনরাও বলছে, ‘‘এমনটাও যে হতে পারে ভাবিনি কখনও।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE