Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

দক্ষিণের কড়চা

সর্বাঙ্গে সাহেবি-জড়ানো যে বাঙালি সারা বছর নিউ ইয়ার, ভ্যালেন্টাইন আর ক্রিসমাসে মাখামাখি হয়ে থাকে সে-ই যেন আজ, দিনের মহিমায় আপাদমস্তক বাঙালি৷ অবিশ্যি বাঙালির বাঙালিত্ব এখন কিঞ্চিৎ সংকুচিত, অর্থাৎ আ-নোলামস্তক৷ গুন্টার গ্রাস মাথায় থাকুন, জিভ দেখেই এখন বাঙালি চেনা যায়৷ বিশেষ করে এই নববর্ষে৷

শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৫ ০০:১০
Share: Save:

রসনার নবহর্ষ
পয়লা পাতে

সর্বাঙ্গে সাহেবি-জড়ানো যে বাঙালি সারা বছর নিউ ইয়ার, ভ্যালেন্টাইন আর ক্রিসমাসে মাখামাখি হয়ে থাকে সে-ই যেন আজ, দিনের মহিমায় আপাদমস্তক বাঙালি৷ অবিশ্যি বাঙালির বাঙালিত্ব এখন কিঞ্চিৎ সংকুচিত, অর্থাৎ আ-নোলামস্তক৷

গুন্টার গ্রাস মাথায় থাকুন, জিভ দেখেই এখন বাঙালি চেনা যায়৷ বিশেষ করে এই নববর্ষে৷ সারা বছর মাখন-পাঁওরুটি কিংবা সিরিয়ালে প্রাতরাশী বাঙালির ঘরে আজ ধন্য লুচি, তোমার মহিমা ত্রিভুবনে৷ আর হবে না-ই বা কেন? রবীন্দ্রনাথের মানসী পড়ুন, সেই যে বঙ্গবীর বলছে, ‘সাহেব মেরেছি, বঙ্গবাসীর কলঙ্ক গেছে ঘুচি/ মেজবৌ কোথা, ডেকে দাও তারে কোথা ছোকা কোথা লুচি৷’

কবি সুকান্ত যতই বলুন পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি, ও কথা ভোটের বাজারে মঞ্চের গরমে সেঁকা হয় ভাল, কিন্তু পূর্ণিমা চাঁদ যে আসলে লুচি বা নুচিই সেটা পয়লা বৈশাখী বাঙালির চেয়ে আর কে-ই বা ভাল বোঝে!

এবং মাছ৷ তার গভীর জলে হানা দিয়ে একটি অমূল্য মানিকই রচনা করে ফেললেন শাঁটুলবাবু, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত৷ সাহেবরা যে রান্না জানে না, সে কথা পদ্যেই জানিয়ে গিয়েছেন বাঙালিয়ানার আদিকবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত— ‘বাঙালির মত তারা রন্ধন না জানে৷/ আধসিদ্ধ করে শুধু টেবিলেতে আনে৷৷/ মশলার গন্ধ গায় কিছুমাত্র নাই৷/ অঙ্গে করে আলিঙ্গন কমলিনী রাই৷৷’ কিন্তু বাঙালির সকল অঙ্গটি যে এই একটি দিন বাঙালিয়ানার অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনে ভরে ওঠে৷ তাই বচ্ছরকার দিনটি বাঙালির পাতে মৎস্য-শাসিত৷ শিল্পটিল্প এখন শিকেয় তুলে রাখা হয়েছে, অতএব গুপ্তকবির বাংলাই এখনও শাশ্বত সোনার বাংলা, ‘ভাত মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙালী সকল৷/ ধানভরা ভূমি তাই মাছভরা জল৷৷’ অবিশ্যি অজামাংসের চাইতেও মাছের দাম যে ভাবে বেড়ে চলেছে তাতে মাছভরা জল কবে চোখভরা জল হয়ে উঠবে তাই বা কে জানে! এই যে শোনা যাচ্ছে, পয়লায় বাঙালির পাতে রোশনাই আনতে বনগাঁ বর্ডার পেরিয়ে বাঙাল ইলিশের ঝাঁক এ দেশে ঢুকেছে, তা পাতে পাড়তে যখের ধনের সন্ধান পাওয়া ছাড়া গতি কী?

কিন্তু না, রোগাসোগা পিলে-সর্বস্ব বঙ্গতনয় ভূরিভোজের জন্য ব্যাঙের আধুলি বাজি লাগাতে বাঙালি কবেই বা ডরেছে? ডাগর চোখের বঙ্গবালা এমনিই মুগ্ধ বিস্ময়ে তার পানে চেয়ে থাকে কি? মুখ তেতো করা সব তত্ত্বকথা বরং থাক এখন। আজ বঙ্গজীবনের নববর্ষ, বঙ্গরসনার নবহর্ষও বটে৷

বই পাকে বৈশাখে

আম পাকে বৈশাখে...৷ একদা বঙ্গের নতুন বইগুলিও পেকে উঠত বৈশাখের আগেই৷ বই পাকা? কথাটায় কানে একটু খটকা লাগলেও এক সময়ে এই পয়লা বৈশাখ কলেজ স্ট্রিটে বইপাড়ায় গিয়ে অকস্মাৎ শেলফের কোনও বই ধরে টান মারতে গেলেই প্রকাশক হাঁ হাঁ করে উঠতেন, ওটা নয় ওটা নয়, অন্য কপি দিচ্ছি, ওটা কাঁচা আছে এখনও! অর্থাৎ বাঁধাইয়ের আঠা শুকোয়নি৷ এখন অবশ্য বাঙালির বই পাকানোর অধিকাংশ উদ্যোগ, মাঘের শীতে, বইমেলায়৷ তবে এটা বিকেন্দ্রীকরণের যুগ৷ বাঙালির বই একান্ত ভাবে বইপাড়া-নির্ভর নয়৷ জেলায় কিছু প্রকাশক পয়লা বৈশাখের বই-প্রকাশ উদ্যোগ ধরে রেখেছেন৷ এই তো কৃষ্ণনগরের ধ্রুবপদ প্রকাশনীর শিবনাথ ভদ্র চৈত্রের গরমে বিস্তর ছুটোছুটি করলেন খালেদ চৌধুরীর প্রচ্ছদ নিয়ে তাঁর প্রকাশনা থেকে প্রকাশিতব্য অ্যালবামটির জন্য৷ অবশ্য শেষরক্ষে হয়নি৷ জানিয়েছেন, দু’এক দিন দেরি হচ্ছে বইটি প্রকাশে৷ তা হোক গে, আঠারো মাসে যে নববর্ষ তার প্রথম মাসটিই তো এই বৈশাখ, না কি? সঙ্গে পয়লা বৈশাখ মিত্র ও ঘোষ প্রকাশনার আড্ডায় এসে প্রকাশনার ‘খেয়ালখুশির খাতা’য় এঁকে দেওয়া ইন্দ্র দুগারের ছবি৷

স্কুলের সঞ্চয়

এত দিনেও যেটা করতে পারেনি মুর্শিদাবাদের জেলাসদর বহরমপুর, প্রত্যন্ত এলাকার দীনহীন গ্রামের স্কুল সেটাই করে দেখাল। সদরশহরে আর্ট গ্যালারির দাবি দীর্ঘ দিনের, পূরণের আশ্বাসটুকুও নেই। অথচ তফসিলি জাতি অধ্যুষিত গ্রামে কোদলা বিজয়কৃষ্ণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হল ৪০০ বর্গফুটের আর্ট গ্যালারি। স্কুলের বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী তথা শিক্ষকদের শিল্পকর্ম ছাড়াও তাতে রাখা হয়েছে নানা শিল্পীর দান করা শিল্পসামগ্রী। সেই তালিকায় রয়েছে জোড়া বলদে টানা টপ্পর দেওয়া গরুর গাড়ি, তাতে বসে মাথল মাথায় চালক, সবই পাটকাঠি দিয়ে তৈরি। শোলার তৈরি পালতোলা ও ময়ূরপক্ষী নৌকা। পোড়ামাটির যিশু মূর্তির সঙ্গেই রয়েছে আড়াই ফুট উচ্চতার কারুকার্যময় ফুলদানি। বাঁশের গুড়ি থেকে তৈরি হয়েছে আড়াই ফুট উঁচু মানবমূর্তি। রয়েছে যামিনী পালের তৈরি ছাঁচের লক্ষ্মী প্রতিমা। ২০ ইঞ্চি বাই ১৮ ইঞ্চি সাইজের চে গেভারা। জলে সাঁতার দেওয়া রয়্যাল বেঙ্গল-সহ ৩০টি ছবিও রয়েছে। প্লাস্টার অব প্যারিসে গড়া ১২ জন মণীষীর আবক্ষমূর্তিও রয়েছে।

বিশ্বভারতীর নববর্ষ

‘নববর্ষ এল আজি দুর্যোগের ঘন অন্ধকারে;/ আনেনি আশার বাণী,/ দেবে না সে করুণ প্রশ্রয়। প্রতিকূল ভাগ্য আসে/ হিংস্র বিভীষিকার আকারে;/ তখনি সে অকল্যাণ যখনি তাহারে করি ভয়।’ বর্ষশেষ আর বর্ষবরণের উৎসব শান্তিনিকেতন-বিশ্বভারতীতে নিছক উৎসবে পরিণত হতে দেননি রবীন্দ্রনাথ৷ গত কাল উপাসনা মন্দিরে বর্ষশেষের ভাষণ পাঠ করেন অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য৷ আজ বৈতালিকের পরে নববর্ষের ভাষণ উপাচার্য সুশান্ত দত্তগুপ্তের৷ পরে পুরনো ঘণ্টাতলায় বর্ষবরণ ও রবীন্দ্রভবনে নতুন বইপ্রকাশ৷ সন্ধেয় গৌরপ্রাঙ্গণে শিক্ষাসত্রের ছেলেমেয়েদের অভিনয়, ‘তাসের দেশ’। এর পরে নাট্যঘরে অলক চট্টোপাধ্যায়ের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত৷

ছন্দের ছাঁদে

পয়লা আর পঁচিশে— এই দুই বোশেখের দিন বাদে বাঙালির জীবনে বাংলা তারিখ আর কোথায়? ইংলিশ মিডিয়মের দাপটে কুচোকাচাদের মাতৃভাষা শিক্ষারও দফারফা। ‘রোজ সকালে বানান নিয়ে/ ভয়েতে দিন শুরু,/ বাংলা লেখার সময় এলে/ বুকটা দুরুদুরু।’ আঁচড়ে অবস্থাটা বেশ ধরেছেন দেবব্রত দত্ত, তাঁর একশো হাসির আনন্দ (দে’জ) নামের ছড়ার বইয়ে। মেদিনীপুরের মানুষ দেবব্রতর এটা প্রথম বই নয়, বেশ কিছু ছড়ার বই বেরিয়েছে তাঁর। নানা সম্মানও পেয়েছেন। অনেক লেখাতেই ছোট ছন্দের বুনোটে বাঁকা কথা সহজে বলতে পারেন তিনি। যেমন— ‘একখানা চোর ডালে ডালে/ একটা পুলিশ মাচায়,/ চোর-পুলিশের খেলা চলে/ গেরস্তকে নাচায়।’ যদিও কিছু জায়গায় যতিচিহ্নের প্রয়োগ অস্বস্তির কারণ। সুব্রত মাজির প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ বইটিকে নয়নাভিরাম করেছে।

ক্যামেরাওয়ালা

টিফিনের পয়সা জমিয়ে কেনা ক্যামেরায় তাঁর প্রথম ছবি, শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জে ঝাপসা রাজীব গাঁধী। সেই যে নেশা ধরল, চাকরি পেয়েও করতে পারলেন না অর্ণব ঘোষাল। জন্ম সিউড়িতে হলেও, বাবার রেলে চাকরির সূত্রে ছেলেবেলা কেটেছে বিহারের নানা প্রান্তে। একটু বড় হয়ে বীরভূমে ফিরে ভর্তি হন বোলপুর হাইস্কুলে। ১৯৯৯ সাল থেকে পাকাপাকি ভাবে শান্তিনিকেতনের বাসিন্দা। প্রায় দু’ দশকেরও বেশি ধরে রাঙামাটির প্রকৃতিকে লেন্সের ভিতর দিয়ে দেখে চলেছেন তিনি। তুলে চলেছেন কোপাই নদীর রোজনামচার ছবি। উদ্দেশ্য, ছোট্ট এই নদীটিকে নিয়ে কফিটেবিল বুক‌ করবেন। ছবির ফ্রেমের মধ্যেই তিনি খোঁজেন হাজার কথার জড়াজড়ি। তাঁর কোনও-কোনও ছবিতে তাই বোনা থাকে কথার কাঁথাসেলাই। শেষ বইমেলায় প্রকাশিত একটি ছবি-কবিতার বইয়ে তারই সুরধুনি। এর আগেও অর্ণবের তোলা ছবিতে সাজানো অন্য কবিদের বই প্রকাশিত হয়েছে। ছবি তোলার ফাঁকে আর তাঁর ভাল লাগে বুক ডিজাইন। শিল্পী যোগেন চৌধুরীর কথায় অর্ণবের ছবিতে ‘আলোছায়ার খেলা এবং অনুভব আকর্ষণীয়। ঘোরানো সিঁড়ির আয়োজন, ঘুমন্ত শিশু, ভাঙাচোরা দেওয়াল, জানলা, পরিত্যক্ত চপ্পল শিল্পিত রূপে ধরা দেয়।’’ সেই শিল্প নিয়েই ‘ভয়েজ অব জর্জিয়া’-র আমন্ত্রণে খুব শিগগির ‘পেইন্ট ফর জর্জিয়া’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক শিল্প উৎসবে যোগ দিতে যাচ্ছেন অর্ণব। সে দেশের তিন শহরে দশ দেশের দশ প্রখ্যাত শিল্পীর সঙ্গে তাঁর ছবিও প্রদর্শিত হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE