Advertisement
০৭ মে ২০২৪

অবহেলায় পড়ে হিলির পার্থসারথি মন্দির

প্রায় নব্বই বছর আগে অনাথ বাল্য বিধবা ও দুঃস্থ নারীদের জন্য একটি আশ্রম তৈরি করা হয়েছিল দক্ষিণ দিনাজপুরের হিলিতে। সেখানে ছিল পার্থসারথির একটি মন্দিরও। এখন সেই মন্দিরটি জীর্ণ হয়ে পড়েছে। ঘন গাছগাছালিতে ঘেরা প্রায় নির্জন এলাকাটি হিন্দু মিশনপাড়া বলে পরিচিত। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা হিলি সীমান্তের ওই পাড়ায় পুরনো ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে ভগ্নপ্রায় ওই মন্দির।

জীর্ণ মন্দির।

জীর্ণ মন্দির।

অনুপরতন মোহান্ত
হিলি শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০২:১১
Share: Save:

প্রায় নব্বই বছর আগে অনাথ বাল্য বিধবা ও দুঃস্থ নারীদের জন্য একটি আশ্রম তৈরি করা হয়েছিল দক্ষিণ দিনাজপুরের হিলিতে। সেখানে ছিল পার্থসারথির একটি মন্দিরও। এখন সেই মন্দিরটি জীর্ণ হয়ে পড়েছে। ঘন গাছগাছালিতে ঘেরা প্রায় নির্জন এলাকাটি হিন্দু মিশনপাড়া বলে পরিচিত। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা হিলি সীমান্তের ওই পাড়ায় পুরনো ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে ভগ্নপ্রায় ওই মন্দির। তাকে আগলে ধরে বেঁচে রয়েছেন ৬৬ বছরের এক বৃদ্ধা অর্চনা চক্রবর্তী। ওই প্রতিষ্ঠানের সর্বশেষ কেয়ারটেকার। কার্যত অসহায় অবস্থায় পড়ে রয়েছেন অর্চনাদেবী। দেবত্তোর সম্পত্তির সর্বশেষ সাড়ে ৫ বিঘা জমির মধ্যে অধিকাংশ হাত ছাড়া হয়ে গিয়েছে। সামান্য কিছু জমির ধানে বৃদ্ধা কোনও মতে জীবনধারণ করেন।
অথচ এক সময়ে এই মন্দির ঘিরে কর্মোদ্যোগ এলাকায় রীতিমতো চাঞ্চল্য ফেলে দিয়েছিল। হিলির প্রবীণ বাসিন্দা তথা শিক্ষক বীরেন্দ্রকৃষ্ণ সাহা জানালেন, স্বাধীনতার বহু আগে সে সময় শুদ্ধি আন্দোলনের মাধ্যমে অনাথ বাল্য বিধবা ও অপহৃতা নারীদের উদ্ধার ও সাবলম্বী করে সমাজে প্রতিষ্ঠার উপর জোর দেন তৎকালীন উদ্যোক্তারা। ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে হিলির পূর্ব আপতোর মৌজায় পার্থসারথি মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়। সে বছরই ৫ ও ৬ মার্চ দু’দিন ধরে অনুষ্ঠিত হয় মহাসম্মেলন।
তৎকালীন অবিভক্ত হিলির জমিদার প্রয়াত প্রমথনাথ দাসের সক্রিয় সহায়তায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ময়মনসিংহের তৎকালীন মহারাজা শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী। ওই দিন সন্ধ্যায় যুব সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। পরদিন গৌরাঙ্গ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন কাশিমবাজারের তৎকালীন মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী। প্রখ্যাত নাট্যকার মন্মথ রায় ওই বৈষ্ণব সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। ওই সম্মেলনে হিলির ওই এলাকায় এক লক্ষ লোকের সমাগম হয়েছিল। মহারাজা প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের নেতৃত্বে ১০০০ স্বেচ্ছাসেবক ওই অনুষ্ঠানে নিযুক্ত ছিলেন। সে বছর ২৪ মে মহারাজ পদ্মরাজ জৈন ওই সংস্থাকে ১০,০০০টাকা দান করেন। পরিত্যক্ত শিশু থেকে অবহেলিত নারীদের উদ্ধার ও তাদের ভরনপোষণের লক্ষে হিলির ওই এলাকায় মিশন আশ্রমের কাজকর্ম কিন্তু দেশ ভাগের পর ব্যাহত হয়ে পড়ে। প্রতিষ্ঠানের বহু জমি ওপার বাংলাদেশে চলে যায়। সমাজে অবলম্বনহীন নারী শিশুদের আশ্রমে পঠনপাঠনের ব্যবস্থায় তৎকালীন জোতদার জমিদারদের পৃষ্ঠপোশকতা কমতে শুরু করে। সামান্য চাষের জমি ও মুষ্টিভিক্ষার উপর নির্ভর করে শেষ পর্যন্ত একটা সময় মিশনের কর্মকাণ্ড স্তিমিত হয়ে পড়ে। সত্যানন্দজী মহারাজও লোকান্তরিত হন। একে একে আশ্রমের কর্মীরা অন্যত্র চলে গেলেও পড়ে আছেন ওই বৃদ্ধা অর্চনাদেবী। আর পুরনো ঐতিহ্যের সাক্ষী হিসাবে রয়েছে ওই হিন্দু মিশন পাড়ার ওই ভগ্নপ্রায় পার্থসারথি মন্দির।

অর্চনা চক্রবর্তী।

এখান থেকে মাত্র হাত তিরিশেক দূরে ওপারের রেলপথ। মন্দিরের দরজা দীর্ঘ দিন বন্ধ। অশীতিপর বৃদ্ধা ঠিক মতো হাঁটাচলা করতে পারেন না। মাটির দাওয়ায় বসে বৃদ্ধা বলেন, ‘‘এলাকার আদিবাসীরা চাষ করে যে টুকু ধান দেয়, তাতে কোনও রকম টিকে আছি’’। পাশের বাড়ির এক যুবক উকিল তাঁকে সাহায্য করেন। হিলির বিডিও মথিয়াস লেপচা বলেন, ‘‘ওই বৃদ্ধাকে যাতে বার্ধক্য ভাতা দেওয়া যায়, তার ব্যবস্থা করছি।’’

স্থানীয় শিক্ষক বীরেন্দ্রবাবু এবং সমাজসেবী অমূল্যরতন বিশ্বাসের কথায়, আজ সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে অনাথ ও দুঃস্থ শিশু নারীদের হোম ও আশ্রম রয়েছে। সেই পুরনো আমলে অবগুন্ঠিত সমাজে অনাথ ও বাল্য বিধবা নারী শিশুদের পুনর্বাসনের জন্য ওই উদ্যোগের কথা ভাবলে অবাক হতে হয়। বাসিন্দাদের মতে, ওই পার্থসারথি মন্দির ও এলাকাটি সরকারি উদ্যোগে সংস্কার ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা যায়। পর্যটকদের কাছে তা আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে। সেই সঙ্গে দক্ষিণ দিনাজপুরের পর্যটন ও পুরাতত্ত্বের মানচিত্রে নতুন এক আবিষ্কার হয়ে উঠবে হিন্দুমিশন পাড়া। বিডিও বলেন, ‘‘মন্দির সংস্কারের কাজে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে বি‌শেষজ্ঞদের পরামর্শ চাওয়া হবে।’’

ছবি দু’টি তুলেছেন অমিত মোহান্ত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE