Advertisement
১১ মে ২০২৪

উত্তরের চিঠি

উষ্ণায়নে হারাচ্ছে আম লাভজনক কাঁঠাল চাষ

শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০১৪ ০২:০৮
Share: Save:

উষ্ণায়নে হারাচ্ছে আম লাভজনক কাঁঠাল চাষ

আগাম বিক্রিতে নাম খারাপের আশঙ্কা, (২৮ মে) এবং ভাল আম কিনতে (২ জুন) প্রসঙ্গে এই চিঠি। আগাম বিক্রিতে আমের সুনাম নষ্ট হচ্ছে মালদহে। কিন্তু মালদহের আম গোপালভোগ, ক্ষীরসাপাতি (যা হিমসাগর নামে পরিচিত), ল্যাংড়া, সুরমাকজলি, কজলি এই আমগুলো পরিপক্ব হওয়ার যথেষ্ট আগেই গাছ থেকে নির্বিচারে তুলে (স্থানীয় ভাষায় আম ভাঙা) যথেচ্ছ কার্বাইড প্রয়োগ করার প্রথা তো দীর্ঘ দিনের। ভিন দেশি আম কলকাতার বাজারে যেটা মে মাস থেকে আমদানি শুরু হয়ে যায়, তার ছবি খবরের কাগজে দেখা মাত্র মালদহের লোভী, কাণ্ডজ্ঞানহীন পাইকারি এবং খুচরো বিক্রেতারা প্রায় উন্মাদের মতো গোপালভোগ এবং ক্ষীরসাপাতি আম ভাঙা শুরু করে দেয়। হিসেব বলছে জুনের প্রথম সপ্তাহের আগে গোপালভোগ আম তোলাই উচিত নয়। আমে রং ধরা পর্যন্ত পাইকারদের ও খুচরো ব্যবসায়ীদের অপেক্ষা করা প্রয়োজন। কিন্তু রং ধরা তো দূরের কথা, কাঁচা আমই বেধড়ক ভাবে পেড়ে বাজারে নিয়ে আসা হচ্ছে। ঋতুচক্রের নিয়মে গোপালভোগ আমই সবার আগে পাকার কথা। জুনের দ্বিতীয় বা তৃতীয় সপ্তাহে ক্ষীরসাপাতি পরিপক্ব হওয়ার কথা। জুলাই এর ১৫ থেকে অগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত হাল্কা হলুদ রং ধরা ল্যাংড়া গাছে ঝুলে থাকলে তার স্বাদ হবে অপূর্ব। ল্যাংড়ার বৈশিষ্ট্য হল স্বাদ এবং গন্ধের সমাহারে প্রকৃতি একে তৈরি করেছে। এই আম পরিপক্ব হলেই যে তার অভূতপূর্ব গন্ধ ছড়ায় তাই নয়, এর মুকুলের গন্ধও অসম্ভব সুন্দর। ক্ষীরসাপাতির মুকুলের রং হাল্কা খয়েরি রং এর হয়ে থাকে। বাকি সব আমেরই মুকুল হয়ে থাকে মোটামুটি হলুদ রঙের।

পরিপক্ব গোপালভোগ কিংবা ক্ষীরসপাতির স্বাদ এতটাই উঁচু মানের যে মালদহের কোনও আমকেই একক ভাবে উত্‌কৃষ্টের আসনে বসানো মুশকিল। মালদায় যাকে গুটি আম বলা হয় অর্থাত্‌ যে আম কলমে উত্‌পাদিত হয় না সেই আমও যদি পরিপক্ব হয়, তবে তার স্বাদও ঈর্ষণীয় হবে। মূল কথা যেমন তেমন ভাবে আমকে ‘ভাঙা’ উচিত নয়। কিন্তু মালদহের আম আরও বড় সমস্যায় পড়েছে। বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে চৈত্র-বৈশাখ মাসে অর্থাত্‌ এপ্রিলে বৃষ্টি এবং কালবৈশাখী প্রায় উধাও হওয়ার পথে। বিগত ৫/৭ বছরে মালদহে গরম এক উত্‌কট চেহারা নিয়েছে। সূর্যের তাপ এত তীব্র হচ্ছে যে আম পরিণত সাইজেই পৌঁছতে পারছে না। আম ক্ষুদ্রাকৃতি হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে বৃষ্টি এবং তাপ সংগঠিত না হলে আম সরস হবে না। আমের শাঁস হবে না। এ বছরে ক্ষীরসাপাতি আম লিচুর থেকে কিছুটা বড় হয়েছে যা দেখে চাষির মাথায় হাত।

বিশ্ব উষ্ণায়ন শুধু যে আমকেই ক্ষুদ্রাকৃতি করে দিচ্ছে এবং প্রকৃতির এই ‘অমৃত ফল’কে স্বাদহীন করে তুলছে তাই নয়, সামগ্রিক ভাবে খাদ্যশস্যেও টান ধরিয়েছে। তাই বিশ্ব উষ্ণায়নের তীব্রতা ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাতকে খেয়াল করে রাষ্ট্রসঙ্ঘ ও বিশ্বব্যাঙ্ক উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ভীষণ ভাবে কাঁঠাল ফলের চাষে মনোযোগী হতে নির্দেশ দিয়েছে।

গরিবের খাদ্য হিসেবে চিহ্নিত কাঁঠাল নিয়ে ভদ্রসমাজ নাক উঁচু করলেও বেঙ্গালুরুর ইউনিভার্সিটি অব এগ্রিকালচার অ্যান্ড সায়েন্স-এর পুষ্টিবিদ শ্যামলা রেড্ডি বলেছেন যে দিনের একটা বেলায় কেউ যদি ১০ থেকে ১২ কোয়া কাঁঠাল খায়, পরের বেলায় তাকে তেমন খাবারই গ্রহণ করতে হবে না। ফুট ট্যাঙ্ক যারা সাসটেইনেবল এগ্রিকালচার নিয়ে গবেষণা করছেন, সেই সংস্থার বিশেষজ্ঞ ড্যানিয়েল নিরেনবার্গ বলেছেন, কাঁঠাল গাছ খরা প্রতিরোধী অর্থাত্‌ প্রচণ্ড তাপেও এই গাছ বৃদ্ধি পায়, তা ছাড়া এই গাছের বড় ধরনের পরিচর্যা প্রয়োজন হয় না। কাঁঠালের রসে পর্যাপ্ত, লোহা, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়ামের গুণও পাওয়া যায়। শর্করা জাতীয় খাদ্যের তুলনায় কাঁঠাল অত্যন্ত পুষ্টিকর ও কার্যকর। কাঁঠালের রস এতটাই মিষ্টি যে মুড়ি ও রুটি দিয়ে যথেষ্ট তৃপ্তির সঙ্গে এটাকে খাওয়া যায়। কাঁঠালের বীজ, এঁচোড়, পাকা কাঁঠাল সব কিছুই ক্ষুধা নিবারণ করতে পারে এবং পুষ্টি জোগায়। বছর তিরিশ আগেও পশ্চিমবাংলায় প্রচুর কাঁঠাল গাছ দেখতে পাওয়া যেত। কাঠের জন্য নির্বিচারে এই গাছ কাটা হতে থাকে। কাঁঠাল গাছের হলুদ কাঠ দিয়ে যা কাঁঠাল কোয়ার রঙের মতো অত্যন্ত মূল্যবান দরজা-জানলা তৈরি হত। ইদানীং কালে কাঁঠাল গাছ এতটাই কমেছে যে প্রতি সিএফটি কাঁঠাল কাঠের দাম ২২০০ থেকে ২৭০০-র মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। যা সেগুন কাঠের সমতূল্য।

খাদ্য সঙ্কট নিরসনে কাঁঠাল গাছ রোপণের উপর বিশ্বব্যাঙ্ক এবং রাষ্ট্র সঙ্ঘ গুরুত্ব দিলেও, শ্রীলঙ্কা এবং ভিয়েতনামে কাঁঠাল ফলকে কেন্দ্র করে কিছু শিল্পসৃষ্টি হয়েছে। ভারতে কাঁঠাল চাষ নিয়ে তেমন কোনও হেলদোল চোখে পড়ছে না। বাংলাদেশের কাঁঠাল অত্যন্ত সুস্বাদু এবং যার ওজন পঞ্চাশ কেজি পর্যন্ত হতে পারে, বলেছেন শিকাগো বোটানিক গার্ডেনের প্ল্যান্ট বায়োলজির গবেষক নায়রি জায়রেগা। আগামী দিনে তাপপ্রবাহ আরও বেড়ে খাদ্যশস্যর উত্‌পাদনকে ব্যাহত করবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ইন্ট্যারন্যাশনাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ, তারাও নিদান দিয়েছে কাঁঠাল চাষের বিষয়ে। কিন্তু আলফানসো, কোহিতুর, রানিপসন্দ, বেগমপসন্দ, সুরমা ফজলি, হিমসাগর নিয়ে যত কথা হয় কাঁঠালের কোয়া নিয়ে কথা নৈব নৈব চ। অথচ কাঁঠালের রস ঘুম নিয়ে আসতেও সাহায্য করে। কিন্তু কাঁঠাল নিয়ে আলোচনা মানা। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন আমসত্ত্ব দুধে ফেলি/ তাহাতে কদলি দলি/হাপুস হুপুস শব্দে/পিঁপড়া কাঁদিয়া যায় পাতে।

তবে ঘন গরম দুধে কাঁঠালের রস মিশিয়ে খেলে ক্ষুধাও মিটবে আবার চারশো টাকায় এক ডজন আলফানসো না কিনতে পারলেও আফসোস থাকবে না। অবশ্যই ল্যাংড়া আমের জগত্‌মোহিনী সৌরভ কাঁঠালের থাকে না, কিন্তু ক্ষুধা মিটবেই। উষ্ণায়নে ল্যাংড়া হারিয়ে গেলেও, তার রং নিয়ে কাঁঠাল গাছ বেঁচে থাকবে।

শান্তনু বসু, চাঁচল

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

uttar letter
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE