Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

বিষ ছড়াচ্ছে ডাম্পিং গ্রাউন্ডের ধোঁয়া

এই ধোঁয়া থেকেই বিষিয়ে যাচ্ছে বাতাস। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।এক অদ্ভুত ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছে শিলিগুড়ির আকাশ। ধীরে ধীরে বিষিয়ে যাচ্ছে বাতাসও। সেই ‘বিষ-ধোঁয়ার উত্‌স শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে খূব দূরে নয়। শিলিগুড়ির গা ঘেঁষে থাকা ইস্টার্ন বাইপাসের ‘ডাম্পিং গ্রাউন্ড’ লাগোয়া লোকালয়ে গেলেই দেখা যাবে কী ভাবে সেখানকার বাসিন্দাদের জীবন ক্রমশ বিষিয়ে যাচ্ছে। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত সেই ধোঁয়ার কুণ্ডলী ক্রমশ গ্রাসে যাঁদের জীবন-যাপন বিপন্ন।

কী হাল ডাম্পিং গ্রাউন্ডের? আরও ছবি দেখতে হলে অ্যাপ্‌ল অ্যাপ স্টোর (আইফোন/ আইপ্যাড) অথবা গুগল প্লে স্টোর থেকে ABP AP Appটি ডাউনলোড করে উপরের ছবিটি স্ক্যান করুন।

কী হাল ডাম্পিং গ্রাউন্ডের? আরও ছবি দেখতে হলে অ্যাপ্‌ল অ্যাপ স্টোর (আইফোন/ আইপ্যাড) অথবা গুগল প্লে স্টোর থেকে ABP AP Appটি ডাউনলোড করে উপরের ছবিটি স্ক্যান করুন।

কিশোর সাহা
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:০৪
Share: Save:

এক অদ্ভুত ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছে শিলিগুড়ির আকাশ। ধীরে ধীরে বিষিয়ে যাচ্ছে বাতাসও। সেই ‘বিষ-ধোঁয়ার উত্‌স শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে খূব দূরে নয়। শিলিগুড়ির গা ঘেঁষে থাকা ইস্টার্ন বাইপাসের ‘ডাম্পিং গ্রাউন্ড’ লাগোয়া লোকালয়ে গেলেই দেখা যাবে কী ভাবে সেখানকার বাসিন্দাদের জীবন ক্রমশ বিষিয়ে যাচ্ছে। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত সেই ধোঁয়ার কুণ্ডলী ক্রমশ গ্রাসে যাঁদের জীবন-যাপন বিপন্ন।

এ হেন পরিবেশ-পরিস্থিতির কথা নেতা-কর্তা, আমলা-মন্ত্রী, পরিবেশবিদ প্রায় সকলেই জানেন। অনেকেই উদ্বিগ্ন। কেউ ওই প্রসঙ্গ উঠলে ‘ভারী দুশ্চিন্তা’ও প্রকাশ করতে এতটুকুও দেরি করেন না। কিন্তু, অবস্থা কিছুতেই বদলায় না। বরং প্রতিদিনই যেন আরও ধোঁয়া-ধূসর হয়ে উঠছে শিলিগুড়ির সেবক রোড লাগোয়া ডাম্পিং গ্রাউন্ড সন্নিত জনপদ। যেখানে অন্তত ৪০ হাজার বাসিন্দার বসবাস। রয়েছে ১৯টি স্কুল-কলেজ। লেখাপড়ার সুবাদে যেখানে রোজ গড়ে আরও ১৯ হাজার পড়ুয়া-শিক্ষক-শিক্ষিকার যাতায়াত। ভুক্তভোগী যাঁরা প্রায় সকলেই। স্কুল পড়ুয়া বিনীতা, রাধিকা, গৌরব, রীতা, সহেলি, মিতা, সরিতা কিংবা শিক্ষক সুজিত বিশ্বাস সকলেরই চোখেমুখে একটাই প্রশ্ন, ‘ডাম্পিং গ্রাউন্ড কবে সরানো হবে? কবে বন্ধ হবে দূষণ?”

প্রশ্নের উত্তর মেলা অত সহজ নয় তা জানেন সকলেই। কারণ, ডাম্পিং গ্রাউন্ড রয়েছে ওই এলাকায় রাতারাতি হয়নি। শিলিগুড়ি পুরসভার নথি অনুযায়ী, প্রায় ৩২ বছর আগে ইস্টার্ন বাইপাসের ওই এলাকায় আবর্জনা ফেলা শুরু হয়। সব মিলিয়ে ২৮ একর জায়গা জুড়ে শহরের জঞ্জাল জমা হতো। তিন দশক আগে শহরের জনসংখ্যা চিল অনেক কম। হাতে গোনা কয়েকটি ওয়ার্ড ছিল। সব মিলিয়ে গড়ে রোজ ৫০-৬০ মেট্রিক টন আবর্জনা জড়ো হতো। ডাম্পিং গ্রাউন্ড লাগোয়া এলাকায় এত জনবসতি ছিল না। এত স্কুল-কলেজও ছিল না। ধীরে ধীরে জ্যোতিনগর, বৈকুণ্ঠপল্লির মতো এলাকা জনাকীর্ণ হয়ে ওঠে। ডন বস্কো স্কুল তো ছিলই। আশেপাশে আরও ১৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়।

ইতিমধ্যে শিলিগুড়ি শহরের জনসংখ্যা ৮ লক্ষ ছুঁয়েছে। শহরে এখন গড়ে রোজ আবর্জনা জমে গড়ে ৪৫০ মেট্রিক টন। ফুলকপি, বাঁধাকপি, আনারসের ফলনের সময়ে সেই পরিমাণ বেড়ে হয় রোজ ৫০০ মেট্রিক টন। উত্‌সবের সময়ে তা আরও বেড়ে হয় গড়ে রোজ ৫৫০ মেট্রিক টন। টন টন আবর্জনার গন্তব্য একটাই। সেই ডাম্পিং গ্রাউন্ড। যেখানে জঞ্জাল যাতে ছড়িয়ে না পড়ে কিংবা তা থেকে যাতে দূষণ না ছড়ায় সেটা নিশ্চিত করার ন্যূনতম কোনও বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা করতে পারেনি পুরসভা, প্রশাসন।

ফলে, যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। দিনভর গবাদি পশুর ঘোরাঘুরি। রাশি রাশি কাক-চিল-শকুনের ওড়াওড়ি। কুকুর-শুয়োরের দৌরাত্ম্য। জঞ্জাল ঘেঁটে বেঁচে থাকার রসদ কুড়োয় যে কুড়ানিরা তাদের হইহল্লা। আবর্জনার স্তূপে নানা মাদকের নেশার আসর বসানোর দৃশ্য। কোটি কোটি মশা-মাছি উড়ে বেড়ায় ২৪ ঘণ্টা ডাম্পিং গ্রাউন্ডে ও তার লাগোয়া এলাকার আনাচে-কানাচে। আবার ওই আবর্জনার স্তূপে আগুন ধরিয়ে তা পোড়ানোর রেওয়াজও চলছে।

সেই আগুন থেকেই ধোঁয়া। ধিকিধিকি করে তা জ্বলছেই। সেই ধোঁয়ায় চারদিক যেন অন্ধকার হয়ে যায়। ডনবস্কো স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র সম্রাট সান্যাল, মনোজ কিথানিয়ারা বললেন, “আমরা যখন পড়েছি, তখন পরিবেশ অন্যরকম ছিল। এতটা দূষণ ছিল না। এখন তো ভয়াবহ অবস্থা। স্কুলে ছাত্ররা বসতে পারে না। দুর্গন্ধে বমি করে ফেলে অনেকে। মশা-মাছি, ধোঁয়া, সব মিলিয়ে অসহনীয় পরিস্থিতি। মারাত্মক ধরনের রোগের প্রকোপ কোনদিন না ঘটে যায়।” সে জন্য মনোজ, সম্রাটের মতো প্রাক্তন ছাত্ররা ডাম্পিং গ্রাউন্ডের এই দূষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সামিল হয়েছেন।

বস্তুত, ডাম্পিং গ্রাউন্ডের দূষণ রুখতে দীর্ঘদিন ধরে সচেতনতা জাগরণ কমিটি আন্দোলন করছে। তার কর্মকর্তাদের একজন হলেন শিক্ষক সুজিত বিশ্বাস। তিনি বললেন, “বিষ-ধোঁয়ায় জীবন বিষিয়ে যাচ্ছে। কত রকমের রোগের প্রকোপ দেখা দিচ্ছে। সম্প্রতি দুটি শিশুর চোখ দিয়ে রক্ত পড়েছে। জ্বর-সর্দিকাশি, শ্বাসকষ্ট তো ঘরে-ঘরে। চর্মরোগের প্রকোপও বাড়ছে। ঘুম থেকে ওঠা থেকে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত যদি ধোঁয়া সঙ্গী হয় তা হলে সুস্থ ভাবে বাঁচা যায়!”

এর পরে তাঁর সংযোজন, “এটা শুধু ডাম্পিং গ্রাউন্ড লাগোয়া এলাকার ৫-৬০ হাজার মানুষের সমস্যা নয়। ক্রমশ বিষ ধোঁয়ার দূষণ ছড়াচ্ছে শিলিগুড়ির মূল শহরেও। মনে রাখতে হবে, শহরের উত্তরে রয়েছে ডাম্পিং গ্রাউন্ড। সব নদী, ঝোরার জলই কিন্তু, উত্তর থেকে দক্ষিণে যাচ্ছে। কাজেই ডাম্পিং গ্রাউন্ড লাগোয়া এলাকায় যদি বড় মাপের কোনও রোগের প্রকোপ ছড়ায় তা হলে মূল শহরও কিন্তু রক্ষা পাবে না।”

ঘটনা হল, ডাম্পিং গ্রাউন্ড বিজ্ঞানসম্মত না হলে তা থেকে অনেক রোগই ছড়াতে পারে। বিশেষজ্ঞদের সমীক্ষা অনুযায়ী, জঞ্জালের স্তূপ থেকে অন্তত ৪০ টি রোগ হতে পারে।

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

siliguri amar shohor kishore saha
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE