Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

বাস বেড়েছে, তবে হাল ফেরেনি স্ট্যান্ডের

সারা দিনে একটি বাস। পরিচিত ছিল জে কে সিংহের বাস বলে। সে বাসের মালিক-চালকরা গাড়ি নিয়ে নানা এলাকায় ঘুরে যাত্রী কেউ আছেন কি না, সেই খোঁজও নিতেন। ট্রেন বলতে ছিল কু-ঝিক-ঝিক ইঞ্জিনের খেলনা গাড়ি। যাতে উঠলে গন্তব্যে পৌঁছনোর সময়ের কোনও ঠিক-ঠিকানা থাকত না। যেখানে বাস-ট্রেনের এমন হাল, সেখানে যানবাহন বলতে অন্যতম ভরসা ছিল গরু-মোষের গাড়ি। তার অবশ্য সন্ধ্যার পরে চলার উপায় ছিল না। কারণ, এলাকায় বিদ্যুৎ ছিল না। সূর্যাস্তের পরে লন্ঠন, হ্যাজাকই ছিল আলোর উৎস।

রাস্তার উপরেই ইসলামপুর পুরনো বাসস্ট্যান্ড। বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি।

রাস্তার উপরেই ইসলামপুর পুরনো বাসস্ট্যান্ড। বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি।

কিশোর সাহা
ইসলামপুর শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:২৯
Share: Save:

সারা দিনে একটি বাস। পরিচিত ছিল জে কে সিংহের বাস বলে। সে বাসের মালিক-চালকরা গাড়ি নিয়ে নানা এলাকায় ঘুরে যাত্রী কেউ আছেন কি না, সেই খোঁজও নিতেন। ট্রেন বলতে ছিল কু-ঝিক-ঝিক ইঞ্জিনের খেলনা গাড়ি। যাতে উঠলে গন্তব্যে পৌঁছনোর সময়ের কোনও ঠিক-ঠিকানা থাকত না। যেখানে বাস-ট্রেনের এমন হাল, সেখানে যানবাহন বলতে অন্যতম ভরসা ছিল গরু-মোষের গাড়ি। তার অবশ্য সন্ধ্যার পরে চলার উপায় ছিল না। কারণ, এলাকায় বিদ্যুৎ ছিল না। সূর্যাস্তের পরে লন্ঠন, হ্যাজাকই ছিল আলোর উৎস।

সংক্ষেপে এটাই ছিল পঞ্চাশ-ষাটের দশকের ইসলামপুর। অন্তত ইসলামপুরের প্রবীণদের অনেকের স্মৃতি সে কথাই বলছে। সেই স্মৃতিচারণে উঠে আসছে গণ্ডগ্রাম থেকে শহরের চেহারা নেওয়ার পথের অনেক কথাই। নানা সুখ-দুঃখের ছবির সন্ধান মিলছে। শহরের নবতিপর বাসিন্দাদের কয়েকজনের জন্য আলাপচারিতায় শোনা যাচ্ছে অনেক তথ্যও। কী ভাবে গণ্ডগ্রাম থেকে আস্ত একটা শহর হয়ে উঠল ইসলামপুর, তা-র সাক্ষী ওই প্রবীণরা। যেমন, নব্বইয়ের কোঠা পেরোনো প্রেমবিহারী ঠাকুরের কথাই ধরা যাক। ইসলামপুর হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। অবসর নিয়েছেন অনেকদিন। এখন ৯২ বছর বয়সেও একটি বেসরকারি প্রাথমিক স্কুলের কর্ণধার হিসেবে শক্ত হাতে হাল ধরে রেখেছেন। ফি বছর যেখানকার ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই অন্য স্কুলে গিয়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখে।

সেই প্রেমবিহারীবাবু যখন স্মৃতিচারণায় ডুবে যান। নিখুঁত ছবির মতো বর্ণনা দেন। তখন অতীতের ইসলামপুর যেন চোখের সামনে ভাসে। সেই বিবরণ অনুযায়ী, এক সময় বিহারের অধীনে ছিল ইসলামপুর। তখন জেলা সদর বলতে কিসানগঞ্জই ভরসা। যোগাযোগও হতো সব বিহারকেন্দ্রীক। প্রেমবিহারীবাবু তখনকার একমাত্র স্কুলের দায়িত্বের সুবাদে ইসলামপুরে পা দিয়েছিলেন। স্কুলটি তখনও অনুমোদন পায়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের সুপারিশে যখন বাংলা ও বিহারের নানা এলাকার সংযুক্তি ও বিযুক্তি হল, সেই সময়ে ১৯৫৬ সালে ইসলামপুর বিহার থেকে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হয়। সাবেক পশ্চিম দিনাজপুরে ছিল জায়গাটি। পরে উত্তর দিনাজপুরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মহকুমা শহর হয়ে ওঠে।

প্রেমবিহারীবাবুর কথায়, “যতদূর মনে পড়ছে, ষাটের দশকের সেই সময়টায় আমাদের এলাকায় স্নাতক ছিল হাতে গোনা। একজনের কথাই এখন আমার মনে পড়ছে। তিনি হলেন কৃষ্ণমোহন মন্ডল। যিনি এমবিবিএস উত্তীর্ণ হওয়ার পরে বড় কোনও শহরে না গিয়ে ইসলামপুরেই থেকেছেন। কৃষ্ণমোহনবাবু এখন প্রয়াত। কিন্তু তাঁর ছেলে ও নাতি দু’জনেই ডাক্তার। এবং ইসলামপুরেই রয়েছেন। এখন তো ইসলামপুরের অনেক ছাত্রছাত্রী ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিচারক হয়েছেন। ইসলামপুর থেকে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের পদস্থ আমলা হয়েছেন, এমন কৃতির সংখ্যাও কম নয়।” তাঁর পাশে বসে দুই শিক্ষক অমিত ভট্টাচার্য, বিজন দে জানিয়ে দেন, সমাজের সব ক্ষেত্রেই ইসলামপুরের ছেলেমেয়েরা এখন পাল্লা দিচ্ছে। প্রথম সারিতে জায়গাও করে নিচ্ছেন অনেকে।

এমন গর্বের বিষয় যেমন রয়েছে। তেমনই আক্ষেপও কম নেই ইসলামপুর শহরের বাসিন্দাদের। ১৯৯২ সালে পুরসভা গঠিত হলেও আজও পুর এলাকার সব কটি ওয়ার্ডে (১৭টি) পরিস্রুত পানীয় জল বাড়ি-বাড়ি সরবরাহের ব্যবস্থা হয়নি। ফলে, এখনও কুয়ো ও নলকূপই মূল ভরসা বেশির ভাগ বাসিন্দার। কিন্তু ষাটের দশকে যে জলস্তর ছিল ও জলের মান যেমন ছিল এখন যে তেমন নেই সেটা অনেকেই মানছেন। তাই নিরাপদ পানীয় জলের চাহিদা বেড়ে চলেছে। তাতেই এখন জাঁকিয়ে বসছে তথাকথিত বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবসা।

ব্যবসায়িক এলাকায় তো বটেই, পাড়া-পাড়ায় দিনভর ঘুরছে জলের পাত্র বোঝাই ছোট মাপের একাধিক গাড়ি। ১০, ২০ লিটারের জলের পাত্র সরবরাহ হচ্ছে বাড়ি-বাড়ি। দোকানে-দোকানে। দাম যা-ই হোক না কেন, পুরসভা, জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের পরিকাঠামো থাকতেও কেন শহরবাসীকে বাড়তি দামে জল কিনে খেতে হবে, সেটাই বুঝতে পারছেন না বাসিন্দাদের অনেকেই। ইসলামপুরের ব্যবসায়ীদের একটি সংগঠনের একাধিক সদস্য বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, অতীতে কংগ্রেসের আমলে পানীয় জলের ব্যবস্থা করা হবে বলে ঘোষণা করেও কাজ হয়নি। বামেরা সাড়ে তিন দশক ধরে রাজ্য চালালেও ইসলামপুরের পানীয় জল সরবরাহের হাল ফেরানোর ব্যাপারে উদ্যোগী হননি। তৃণমূল জমানার ৩ বছর কাটলেও পানীয় জল সরবরাহের বেহাল দশা ঘোচাতে কাউকে উদ্যোগী হতে দেখেননি বাসিন্দারা। তাই হয়তো এলাকার প্রবীণদের অনেকে একান্তে আক্ষেপ করে বলেন, ‘নেতা পাল্টায়। মন্ত্রী পাল্টায়। আমলা পাল্টায়। কিন্তু ইসলামপুরের পানীয় জলের বেহাল দশা কেন যে কিছুতেই পাল্টায় না, সেটাই বুঝতে পারি না।’

একই অবস্থা ইসলামপুরের পুরানো বাসস্ট্যান্ডের। সেখানকার ছবিটাও যেন কিছুতেই বদলানোর নয়। ভুক্তভোগী বাসিন্দারা জানান, বাম আমল থেকে তৃণমূল জমানা, সেই ভোগান্তি চলছেই। বিশেষত, বর্ষায় ওই বাসস্ট্যান্ডে চলাফেরা দায় হয়ে পড়ে। নতুন বাসস্ট্যান্ড তুলনায় ভাল। সেখানেও অবশ্য জল-কাদার হাত থেকে নিস্তার মেলে না যাত্রীদের। সাবধানে চলতে হয়।

অবশ্য ইসলামপুরের বাসিন্দারা বাড়ির বাইরে বার হলে অতি মাত্রায় সতর্ক থাকেন। তা ছাড়া তাঁদের উপায় নেই।

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE