২০১১ সালের গোড়ায় মন্ত্রী গৌতম দেবের সঙ্গে মিলন দত্ত। —ফাইল চিত্র
সারদার সুতোয় জড়িয়ে কোণঠাসা তৃণমূলে, দলীয় নীতির বিরুদ্ধে সরব হওয়া নেতা-কর্মীর সংখ্যা প্রতি দিন বাড়ছে। এই বিড়ম্বনার মাঝে, ‘বড়দের’ দিকে আঙুল তুলে ছোট এবং মাঝারি মাপের নেতাদের ক্রমান্বয়ে ‘বিদ্রোহী’ হয়ে ওঠার ঘটনারও বিরাম নেই।
সেই তালিকায় শেষ সংযোজন দলের দার্জিলিং জেলার কোর কমিটির সদস্য তথা শিলিগুড়ি টাউন তৃণমূলের সভাপতি মিলন দত্ত। তাঁর ‘লক্ষ্য’ উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব।
জেলা পরিষদ সদস্য তথা পূর্বস্থলীর দাপুটে নেতা বিপুল দাসের বিরুদ্ধে মাস কয়েক আগে তোলাবাজির অভিযোগ তুলে শীর্ষ নেতাদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন পূর্বস্থলীর (উত্তর) বিধায়ক তপন চট্ট্যোপাধ্যায়। দিন কয়েক আগে বীরভূমের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন সিউড়ির বিধায়ক স্বপনকান্তি ঘোষ।
দলীয় নেতাদের একাংশের ‘মর্জিমাফিক’ দল চালানোর অভিযোগ তুললেও, মিলনবাবুর তিরের লক্ষ্য যে গৌতম দেব, তা স্বীকার করে নিয়েছেন দলীয় নেতাদের অনেকেই।
তাঁর বিবিধ কাজকর্ম নিয়ে বিরোধীরা বরাবরই সমালোচনায় মুখর। এ বার দলের মধ্যেও প্রশ্নের মুখে পড়ে উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী অবশ্য বলছেন, “জরুরি বৈঠকে যোগ দিতে কলকাতায় এসেছি। ফিরে গিয়ে আলোচনা করব।” তিনি অবশ্য আস্বস্ত করছেন, মিলনের সঙ্গে কথা বলে ‘সমস্যা মিটিয়ে নেওয়া’র।
গত বুধবার, দলের নেতাদের একাংশের বিরুদ্ধে ‘মর্জিমাফিক’ কাজের অভিযোগ এনে দলের সমস্ত পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার কথাও ঘোষণা করেছেন মিলন। গৌতমবাবুকে এসএমএস মারফত তা জানিয়েও দিয়েছেন তিনি। মিলনের সেই এসএমএস বার্তা বলছে—‘যদি দলের কাজ করতে গিয়ে বার বার মানসম্মান না-থাকে তা হলে আমার পক্ষে কোনও পদে থাকা সম্ভব নয়। যদি এখনও আমার কোনও পদ থেকে থাকে তা হলে আমি তা থেকে ইস্তফা দিলাম।’
প্রকাশ্যে অবশ্য মিলনের সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, “এটা দলের ভেতরের ব্যাপার। এখনই কিছু বলতে চাই না। দেখি কী হয়!” শিলিগুড়িতে মিলন অবশ্য প্রথম নন। গত বছর, দার্জিলিং জেলার অন্যতম প্রবীণ নেতা অরবিন্দ ঘোষও দলের শীর্ষ নেতাদের একাংশের আচরণ ও খামখেয়ালিপনার অভিযোগ তুলে দল থেকে ইস্তফা দিয়েছেন।
দার্জিলিং জেলা নেতাদের অনেকেই মনে করছেন, মিলনের অভিযোগের তির গৌতমবাবুর দিকেই। তাই শিলিগুড়িতে পুরভোটের ঠিক আগে তাঁর এই ‘এসএমএস-বিদ্রোহ’।
এ ব্যাপারে রাশ টানতে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শিলিগুড়ির দলীয় কার্যালয়ে জরুরি বৈঠকও করেছেন গৌতমবাবু। সেখানে অবশ্য ওই ‘বিদ্রোহী’ নেতা যাননি।
দার্জিলিং জেলা নেতাদের বেশ কয়েক জনের দাবি, গৌতমবাবু ও তাঁর অনুগামী কয়েক জন নেতাকে ঘিরে যে ক্ষোভের পাহাড় জমেছে, তা সহজে প্রশমিত হওয়ার নয়। বিশেষত, কোন পরিস্থিতিতে ১৯৯৮ সাল থেকে তৃণমূলের সক্রিয় কর্মী মিলনবাবু ‘মান-সম্মান’ খোয়ানোর কথা তুলে খোদ জেলা সভাপতিকে এসএমএস পাঠিয়েছেন তা নিয়ে দলীয় পর্যায়ে তদন্ত হওয়া দরকার। কেন দলের নেতাদের একাংশের বিরুদ্ধে মর্জিমাফিক কাজের অভিযোগ উঠছে, কেনই বা নানা দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা সত্ত্বেও দলের নেতাদের একাংশের বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে না, উঠেছে সে প্রশ্নও।
তৃণমূলের অন্দরের খবর, ঘটনার সূত্রপাত জানুয়ারির মাঝামাঝি। এসজেডিএ-এর তরফে শিলিগুড়িতে কী ধরনের উন্নয়ন হচ্ছে, তা তুলে ধরে সমাজের নানা স্তরের প্রতিনিধিদের মত নিয়ে একটি নাগরিক কনভেনশনের দায়িত্ব পেয়েছিলেন মিলন। সেই মতো পুরসভার ৬টি ওয়ার্ডে লিফলেট বিলি করে, বাড়ি-বাড়ি গিয়ে প্রচার করে বাছাই প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণও জানিয়ে ছিলেন তিনি। কিন্তু, ১৫ জানুয়ারি গৌতমবাবু জানিয়ে দেন, ওই অনুষ্ঠানে তিনি থাকতে পারবেন না। পরে কবে তা হবে তাও স্পষ্ট করে তিনি জানাতে পারেননি। ফলে, এলাকায় চরম অস্বস্তিতে পড়েন মিলন।
এর দিন কয়েক পরে শিলিগুড়ির চম্পাসারি এলাকায় বেশ কয়েকটা দোকান আগুনে পুড়ে যায়। অনুরোধ করেও সেখানে মন্ত্রীকে নিয়ে যেতে পারেননি মিলন। অথচ প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য ঘটনাস্থলে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্থদের পাশে দাঁড়ান। ২৬ জানুয়ারি উত্তরবঙ্গ উৎসবের সমাপ্তি অনুষ্ঠানের সময়ে দলের নেতা-কর্মীদের গৌতমবাবু জানান, তিনি পর দিন সকাল সাড়ে ৯টায় চম্পাসারিতে গিয়ে দগ্ধ-দোকান দেখবেন। সেই মতো বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ব্যবসায়ীদের নিয়ে মিলনবাবু দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরে তাঁরা জানতে পারেন, মন্ত্রী সরকারি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আলিপুরদুয়ারে চলে গিয়েছেন। এ সব ঘটনাবলিই কি নেতাদের ‘মর্জিমাফিক’ কাজকর্ম? মিলন এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছুই বলতে চাননি। তবে এ সব ঘটনায় তাঁর যে ‘মুখ পুড়েছে’ তা জানিয়েছেন তাঁর অনুগামীরা।
এ বার সেই ‘বিদ্রোহ’র আঁচই সামাল দিতে হচ্ছে দলের শীর্ষ নেতাদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy