শিলিগুড়িতে বেহাল মহানন্দা নদী। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।
যা কি না প্রকৃতির আশীর্বাদ। নেতা-কর্তা-নাগরিকদের একাংশের উদাসীনতায় তা-ই এখন ধীরে ধীরে অভিশাপে পরিণত হতে চলেছে। অন্তত, শিলিগুড়ি শহরের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা মহানন্দা নদী সম্পর্কে এমনই ভাবছেন পরিবেশপ্রেমীরা।
এটাও ভাবছেন, একটা নদীকে কী ভাবে নষ্ট করা যেতে পারে তারই যেন অন্যতম দৃষ্টান্ত হয়ে পারে শিলিগুড়ির মহানন্দা।
প্রায় সাড়ে তিন দশকের বাম জমানা থেকে সাড়ে ৩ বছরের তৃণমূল আমলে পরিস্থিতির খুব একটা হেরফের দেখা যাচ্ছে না। শহরবাসীদের অভিযোগ, নেতা-কর্তা-আমলাদের সদিচ্ছা নেই বলেই মহানন্দা ধীরে ধীরে দেশের অন্যতম দূষিত নদী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার দিকে এগোচ্ছে।
অথচ পাহাড়ি ঝোরার জলে পুষ্ট মহানন্দা কিন্তু এমন ছিল না। স্বাধীনতার পরেও মহানন্দা ছিল ঝকঝকে নদী। নদীর ধারে গেলে মন ভালো হয়ে যেত বলে জানাচ্ছেন প্রবীণদের অনেকেই। বিশেষত, নদীর গা ঘেঁষে তৈরি হওয়া মহানন্দাপাড়ার আদি বাসিন্দাদের মধ্যে যাঁরা এখনও রয়েছেন, তাঁদের কয়েকজন স্মৃতি হাতড়ে জানিয়েছেন, তখন বিকেলের পরে মহানন্দার তীরে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখার জন্য ভিড়ও হতো। এখন মহানন্দার ধারে যাঁরা বসবাস করেন, তাঁরা অনেক সময়ে নদীর মধ্যে জমে থাকা আবর্জনার দুর্গন্ধে ভাল করে ঘুমোতে পারেন না।
মহানন্দাপাড়ায় তিন পুরুষ ধরে রয়েছেন ঘোষ পরিবার। সেই পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রতিনিধি স্বপন ঘোষ বললেন, “ছোটবেলায় মহানন্দার চেহারা যা দেখেছি তার সঙ্গে এখন মিল নেই। আকাশ-পাতাল ফারাক। এখন গরমের সময়ে বাতাস বইলে নদীর বুক থেকে যে দুর্গন্ধ উঠে আসে তা অসহ্য। দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখতে হয়। তবুও বাতাসকে পুরোপুরি আটকানো যায় কি!”
দুর্গন্ধ অবশ্য হওয়ারই কথা। কারণ, নদীতে দিনভর শূয়োরের পালের ঘোরাঘুরি। ইতিউতি খাটাল গড়ে উঠেছে। ভোরে-সন্ধ্যেয় নদীর চর উন্মুক্ত শৌচাগার হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন কয়েকশো জন। ভাগাড় হিসেবেই ব্যবহার হয় নদীবক্ষ। ভেসে থাকতে দেখা যায় মৃত পশুর দেহাংশ। শিলিগুড়ির এয়ারভিউ মোড় লাগোয়া মহানন্দা নদী সেতুর নিতে গেলে দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হবে। সেই মহানন্দা একটু এগিয়ে বালাসনের সঙ্গে মিশেছে। ফুলবাড়িতে তিস্তা মহানন্দা লিঙ্ক ক্যানালও রয়েছে। সেখানেই গড়ে উঠেছে শিলিগুড়ি শহরে সরবরাহের সবচেয়ে বড় জল প্রকল্প। তাতেই বিশেষজ্ঞদের অনেকেই ভীষণ রকম উদ্বিগ্ন। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক শেখর চক্রবর্তী বলেন, “মহানন্দার যা চেহারা দেখি তাতে দূষণের মাত্রা যে মারাত্মক ভাবে বাড়ছে তা নিয়ে সংশয় নেই। এমনিতেই পেটের রোগের রোগীর সংখ্যা রোজই বেড়েছে। দূষণের মাত্রা না কমালে আগামী দিনে জলবাহিত রোগের প্রকোপ অতি মাত্রায় বেড়ে যেতে পারে।”
বস্তুত, মহানন্দার এখন যা হাল তাতে সরকারি তরফে দূষণ কমাতে উদ্যোগী না হলে বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশনের (ন্যাফ) সদস্য-সদস্যারাও। ন্যাফের মুখপাত্র অনিমেষ বসু বলেন, “এটা তো সত্যিই যে কোনও একটা শহরের মধ্যে দিয়ে একটা নদী বয়ে চলাটা বড় আশীর্বাদ। কিন্তু, আমরা সেই আশীর্বাদকে অভিশাপে পরিণত করে চলেছি। এখনও সময় আছে। পুলিশ-প্রশাসন-পুরসভাকে কাজে নামতে হবে। সাধারণ মানুষকেও নদী বাঁছানোর জন্য পথে নামতে হবে। আওয়াজ তুলতে হবে। না হলে শহরের মধ্যেকার সবচেয়ে খরস্রোতা নদীটি একদিন হাইড্রেনে পরিণত হয়ে যাবে।”
তা হলে মহানন্দা অ্যাকশন প্ল্যানে বহু কোটি টাকা বরাদ্দ করে লাভটা কী হয়েছে? বাম আমলে ওই প্রকল্পের কাজ অনেকটা হয়েছে বলে দাবি করা হয়। তবুও মহানন্দার দূষণ কমেনি। তৃণমূল জমানায় সেই প্রকল্পের কী হল?
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy