হতাশ। বালুরঘাটের জলঘর এলাকায় খেতেই পড়ে রয়েছে আলু। ছবি: অমিত মোহান্ত
ভাল ফলন হয়েছে। তাই পড়ে গিয়েছে দাম। এবং সে কারণেই মাথায় হাত আলুচাষিদের। পাইকারি বাজারে তিন টাকা কিলো। এই অবস্থায় চাষ করতে যা খরচ করেছিলেন, তার অর্ধেক তুলতেই হিমশিম অনেকে। বহু খেতেই আলু পড়ে পচনের অপেক্ষায়।
মালদহ
আলু বেচেই এক মেয়ে, এক ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন পুরাতন মালদহের কালীতলা গ্রামের বাসিন্দা অরুণ রাজবংশী। ছোট ছেলে অঞ্জনের বিয়ে ঠিক হয়েছিল ২ মার্চ। কিন্তু এ বারে আলুই বাদ সাধল। বাজারে দাম পড়ে গিয়েছে। চাষের খরচই তুললে পারেননি অরুণ। ফল? শেষ অবধি পিছিয়ে গিয়েছে ছোট ছেলের বিয়ে। অরুণের কথায়, ‘‘২৭ বিঘা জমিতে চাষ করে মাত্র সাত বিঘা জমির আলু তুলেছি। বাকি এখনও জমিতেই পড়ে। আর দু’সপ্তাহের মধ্যে আলু তুলতে না পারলে তা জমিতে পচে নষ্ট হয়ে যাবে।’’ কেন তুলতে পারছেন না? ‘‘বাজারে আলুর তো দামই নেই। কুইন্ট্যাল প্রতি ২৫০-২৭৫ টাকা দরে আলু বিকোচ্ছে বাজারে। হিমঘরে বন্ডও মিলছে না।’’ প্রতি বিঘায় গড়ে ৫০ কুইন্ট্যাল করে আলু হয়েছে অরুণের জমিতে। খরচ হয়েছে বিঘা প্রতি প্রায় হাজার চারেক টাকা। ‘‘এখন যা অবস্থা তাতে দু’বেলা টাকার জোগাড় করতেই নাজেহাল অবস্থা। বিয়ের ব্যবস্থা কী করে করব!’’
জলপাইগুড়ি
প্রায় দশ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছেন শোভারহাটের তামিজু্দ্দিন মহম্মদ৷ দিন কয়েক আগে তাঁর বোনের বিয়ে হয়। তাঁর কথায়, বোনের বিয়েতে অনেক ধার-দেনা রয়েছে৷ প্যান্ডেল-আসবাবপত্রের লোকেরা টাকা পাবেন৷ ‘‘ওঁদের বলেছিলাম, দু-তিন মাস পর আলু বিক্রি করে টাকা শোধ করব৷ কিন্তু এখন তো হিমঘরে আলু রাখতে পারব কি না, তাই জানি না৷’’ রাহুত নগরের দশরথ পোদ্দার বলেন, ‘‘এ বার কুড়ি বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছি৷ ঠিক করেছিলাম এর থেকে টাকা হাতে এলে বাড়িটা বানাব৷ কিন্তু রোজ হিমঘরে গিয়েও বন্ড পাচ্ছি না৷ মনে হচ্ছে আলু মাঠেই পচবে৷’’
কোচবিহার
লোকসানের অঙ্ক বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা। তাই খেতের আলু তোলার সাহস পাচ্ছে না দিনহাটার চাষি কাজল দাস। মাঠেই পড়ে আছে ফসল। যা পরিস্থিতি তাতে আদৌ এ বার ওই আলু বেচা যাবে কি না, তা নিয়ে চিন্তায় রাতের ঘুম উবে গিয়েছে তাঁর। কাজল জানান, চার বিঘা জমিতে প্রায় ৪৮ হাজার টাকা খরচ করে আলু চাষ করেছিলেন। কিন্তু বাজারে দাম নেই। শ্রমিকের খরচ, পরিবহণ খরচ দিয়ে আলু তুলে বাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে গেলে লোকসান বাড়বে। তিনি বলেন, “লোকসান বাড়িয়ে কী লাভ! তাই তুলছি না।” একই কারণে চিন্তায় দিনহাটার নয়ন দাস, মিলন দাস থেকে পুটিমারির সুনীল বর্মনদের মতো অনেক চাষি। সুনীল জানান, এক জন মজুর দিনে নেবেন ৩০০ টাকা। পাইকারি বাজারে আলুর দাম কেজি প্রতি ৩ টাকা। দিনে যদি ১০০ কেজি আলু তোলা হয়, তা হলে তো তা মজুরি দিতেই চলে যাবে। আলু টেনে বাজারে নিয়ে যাওয়ার খরচ কে দেবে? আর লাভই বা আসবে কোথা থেকে?
দক্ষিণ দিনাজপুর
বালুরঘাটের জলঘর এলাকার রবিয়া ওঁরাও এ বারে ১৫ কাঠা জমিতে আলু বুনেছিলেন। দর নেমেছে ৩০০ টাকা কুইন্ট্যালে। অবস্থা দেখে মাথায় হাত ওঁর। গত দুসপ্তাহ ধরে জমিতে আলু ফেলে রেখে মনমরা হয়ে বাড়িতে বসে ছিলেন তিনি। শেষমেশ ঋণ শোধের দায় এবং আলু তোলার মজুরির খরচ বাঁচাতে বাড়ির দুই মহিলা মাইনো ওঁরাও এবং সাবিত্রী মুর্মুকে আলু তুলতে নামিয়ে দিয়েছেন জমিতে। রবিয়ার কথায়, কুইন্ট্যাল প্রতি আলু বীজ ১৪০০ টাকায় কিনতে হয়েছিল। তার পর ওই ১৫ কাঠায় আলু বুনতে সেচ-সার-ওষুধে খরচ হয় আরও ৭ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে খরচ মোট ৯৮০০ টাকা। আলুর ফলন হয়েছে প্রায় ১৫ কুইন্ট্যাল। কুইন্ট্যাল প্রতি ৩০০ টাকা দরে এর দাম হবে ৪৫০০ টাকা। ‘‘পাঁচ হাজার টাকার উপরে ক্ষতির আশঙ্কা মাথায় নিয়ে ঘুমোতে যাচ্ছি রোজ!’’ বললেন তিনি।
উত্তর দিনাজপুর
দাম কমে যাওয়ার পর থেকেই রায়গঞ্জের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের স্নেহলতা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের মিড ডে মিলে আলুর ব্যবহার বেড়ে গিয়েছে। গত প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে স্কুল কর্তৃপক্ষ পড়ুয়াদের মিড ডে মিলে ভাতের সঙ্গে কোনও দিন আলুর ডালনা, আবার কোনও দিন সব্জির বদলে আলুভাজা দিচ্ছেন। মঙ্গলবারও হয়েছে আলু-ফুলকপির তরকারি। স্কুলের প্রধান শিক্ষক বললেন, ‘‘পড়ুয়া পিছু মেলে ৪ টাকা ১৩ পয়সা। তাতে সয়াবিন আর ডিমের কারি খাওয়াতে হিমশিম হয়ে যাচ্ছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy