টিভিতে চোখ ছিটমহলবাসীর।
সংসদের দুই কক্ষেই ছিটমহল বিনিময়ে স্থল সীমান্ত চুক্তি বিল গৃহীত হওয়ায় তিনবিঘায় কেন্দ্রীয় বিজয় উৎসব করবে ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি। আগামী ২৬ জুন দুই দেশের সীমান্ত লাগোয়া মেখলিগঞ্জের তিনবিঘায় কমিটির তরফে ওই কেন্দ্রীয় বিজয় উৎসবের দিন চূড়ান্ত করা হয়েছে। আমন্ত্রিতদের প্রাথমিক তালিকাও মোটামুটি চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছে। ওই তালিকায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কেন্দ্রীয় বিদেশ মন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ছাড়াও বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি তথা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেন মহম্মদ এরশাদ, সেদেশের বর্তমান বিদেশ মন্ত্রী আবুল হাসান মহম্মদ আলি প্রমুখের নাম রয়েছে। ইতিমধ্যে ওই বিজয় উৎসবের প্রস্তুতিও শুরু হয়েছে। দুই দেশের ছিটমহলের বাসিন্দাদের সীমান্তের দুই দিকে জমায়েত করার প্রচারাভিযান চলছে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে লোকসভায় বিলটি তোলা হয়। সন্ধ্যে নাগাদ বিলটি লোকসভায় গৃহীত হয়। বুধবার রাজ্যসভাতেও সর্বসম্মতভাবে ছিটমহল বিনিময়ে স্থল সীমান্ত চুক্তি বিল পাস হয়েছে। তাই সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে চলতি সপ্তাহেই ওই বিলটিতে রাষ্ট্রপতি সই করবেন বলেও আশা করছেন কমিটির কর্তারা। সবমিলিয়েই দীর্ঘ আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে বিজয় উৎসবে মাততে চাইছেন তাঁরা।
২৬ জুন কেন ওই কেন্দ্রীয় বিজয় উৎসবের পরিকল্পনা? অসুস্থ স্ত্রী সুভদ্রা রায়ের চিকিৎসার জন্য চেন্নাই গিয়েছেন ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহাল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সহকারী সম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত। তিনি বলেন, “১৯৯২ সালের ২৬ জুন দহগ্রাম-অঙ্গারপোতার সঙ্গে যোগাযোগে তিনবিঘা করিডোর চালুর মাধ্যমে প্রথম ছিটমহলের বাসিন্দাদের বন্দিদশা মুক্তির সূচনা হয়। এ বার ওই বৃত্ত সম্পূর্ণ হচ্ছে। তাই ওই দিনটিকেই আমরা সমগ্র ছিটমহলবাসীকে মুক্তির আনন্দে সামিল করতে ওই দিনটি বিজয় উৎসবের জন্য বেছে নিয়েছি।”
কমিটি সূত্রেই জানা গিয়েছে, চলতি মাসের মধ্যেই ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় বিদেশ মন্ত্রী, বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি, সেদেশের বিদেশ মন্ত্রী-সহ দুই দেশের পদস্থ নেতামন্ত্রীদের আমন্ত্রণ জানানোর কাজ শুরু করা হবে। রাজ্যের পূর্ত দফতরের পরিষদীয় সচিব তথা শাসকদল তৃণমূলের কোচবিহার জেলা সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন, “৫২ হাজারের বেশি ছিটমহলবাসীর ৬৮ বছরের নাগরিকত্বহীনতার যন্ত্রণা মুক্তির ব্যাপারে শুরু থেকেই উদ্যোগী ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রীর আন্তরিকতার জন্যই স্থল সীমান্ত চুক্তি বিলটি সংসদে উঠেছে, এমনকী গৃহীতও হয়েছে। আমরা মুখ্যমন্ত্রীকে কুর্ণিশ, কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।”
বুধবার ও বৃহস্পতিবার দুইদিনই সংসদের দুই কক্ষে ওই বিল আনার সাক্ষী থাকতে কাজ ভুলে টিভির সামনে বসেছিলেন দুই দেশের ছিটমহলের বাসিন্দারা। পোয়াতেরকুঠী ছিটমহলের বাসিন্দা সত্তরোর্ধ্ব মনসুর আলি, সাহেব আলি মিঁয়া, রেজাউল করিম, মাসুদ রাণা, সাদ্দাম হোসেনের বাড়িতে একসঙ্গে টিভি দেখেন। মশালডাঙায় টিভিতে মজেছিলেন জয়নাল আবেদিন, দাবিদ শেখ, বেলাল হোসেনরা। জয়নাল বলেন , “সংসদে বিল নিয়ে কি হয় তা দেখতে সবাই চাঁদা তুলে ডিশ অ্যান্টেনা কেনা হয়। নাজিরহাট থেকে সাদাকালো টিভি ও ব্যাটারি ভাড়া নিয়ে এসেছিলাম। দুপুর থেকে সবাই লোকসভা টিভিতেই মগ্ন ছিলাম। আগের দিন রাজ্যসভা টিভিতে চোখ রেখেছিলাম। সন্ধ্যে নাগাদ বিল পাস হতেই আনন্দে সবাই পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেন।” পোয়াতেরকুঠী ছিটমহলের বাসিন্দা সেকান আলির বাড়িতেও ব্যাটারি সংযোগের মাধ্যমে টিভি দেখার ব্যবস্থা হয়। পোয়াতেরকুঠী ছিটমহলের বাসিন্দা সাদ্দাম হোসেন বলেন, “বিশ্বকাপ ক্রিকেট ম্যাচের চাইতেও দু’দিন হাজারগুণ টানটান উত্তেজনার মধ্যে সবাই টিভির পর্দায় চোখ রাখেন। নাগরিকত্বহীনতার অভিশাপ থেকে মুক্তি মিলবে ভাবতেই শিহরিত হচ্ছি।” প্রবীণ বাসিন্দা মনসুর আলি বলেন, “আমার জীবদ্দশায় ছিটমহল বিনিময় দেখে যেতে পারব কিনা সংশয় হত। এ বার মনে হচ্ছে এতদিনের লড়াই বিফলে যায়নি। পঁচাত্তর বছর বয়সে অন্যদের সঙ্গে নাগরিত্বের স্বাদ পাব। এক দারুণ অনুভূতির ব্যাপার!”
ওই কমিটি সূত্রে জানা গিয়েছে, রাজ্যসভার পর লোকসভায় ওই বিলটি গৃহীত হওয়ায় ভারতের ১১১টি ও ও বাংলাদেশের ৫১টি মিলিয়ে ১৬২টি ছিটমহল দুই দেশের মধ্যে বিনিময় হবে। উভয় দেশের ছিটমহলের ৫১,৪৮৪ জন নাগরিকত্বহীন বাসিন্দা নাগরিকত্ব পাবেন। প্রতিষ্ঠিত হবে আইনের শাসন। ছিটমহল ইউনাইটেড কাউন্সিল নামে একটি সংগঠনের উপদেষ্টা দেবব্রত চাকি অবশ্য মঙ্গলবার বলেছেন, “যদি বাংলাদেশের ৭ হাজার একর ভূখণ্ডের সঙ্গে ভারতের ৭ হাজার একর ভূখণ্ডের বিনিময় হত তাহলে খুশি হতাম। যা হচ্ছে তা ৭ হাজারের সঙ্গে ১৭ হাজারের বিনিময়। ওই ক্ষতি স্বীকার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির নীরবতা বিস্ময়ের। ভারতীয়দের কতটা স্বার্থ সুরক্ষিত হয় সেটাই দেখার।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy