Advertisement
১১ মে ২০২৪

মেরে পাস মা হ্যায়...

প্রথম দশে ৬৬ জন। তার মধ্যে উত্তরের ১৮। সকলের পিছনেই রয়েছেন সেই এক জন। যিনি রাঁধেন, আবার ছেলেমেয়েকে পড়াশোনায় এগিয়ে দিতেও ক়ড়া নজর রাখেন। যে জন্য সফল পরীক্ষার্থীদের অনেকেই বলছে, বাবা তো আছেনই। কিন্তু মা না থাকলে কী যে হতো! এই খানে, একেবারে এই খানে এসে সকলেই যেন কোথাও দিওয়ার-এর শশী কপূরের সঙ্গে এক হয়ে গিয়েছে। এ দিন, মাতৃদিবসের ৪৮ ঘণ্টা পরে আনন্দবাজার শ্রদ্ধা জানাল তেমনই কয়েক জন মায়েদের।সেই ছোট্ট ছেলের মতো মাকে জড়িয়ে ধরছিল শৌভিক। মা রতিকাদেবীও বার বার জড়িয়ে ধরছিল তাঁকে। চুমু চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছিল তাঁর মুখ। কোলের সন্তানকে মা যেমন আদর করে, তাঁর থেকে কোনও পার্থক্য ছিল না। শৌভিক বলে, “আমার মায়ের জন্যই তো আমি আজ এত ভাল ফল করেছি। সেই ছোট বেলায় সবে যখন অক্ষর চিনতে শুরু করেছি, মা-তো আমার শিক্ষক।” শৌভিক জানায়, মা তাঁর প্রথম শিক্ষক।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১১ মে ২০১৬ ০৫:০২
Share: Save:

• কোচবিহার

সৌভিক বর্মন

মাথাভাঙা হাইস্কুল | ৬৮৩

সেই ছোট্ট ছেলের মতো মাকে জড়িয়ে ধরছিল শৌভিক। মা রতিকাদেবীও বার বার জড়িয়ে ধরছিল তাঁকে। চুমু চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছিল তাঁর মুখ। কোলের সন্তানকে মা যেমন আদর করে, তাঁর থেকে কোনও পার্থক্য ছিল না। শৌভিক বলে, “আমার মায়ের জন্যই তো আমি আজ এত ভাল ফল করেছি। সেই ছোট বেলায় সবে যখন অক্ষর চিনতে শুরু করেছি, মা-তো আমার শিক্ষক।” শৌভিক জানায়, মা তাঁর প্রথম শিক্ষক। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মায়ের চোখে তখন জল। রতিকাদেবী বলেন, “এই অশ্রু আনন্দের। ছেলের পাশে থেকে তাঁকে সব সময় পড়াশোনার সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। এই যা।” পাশ থেকে শৌভিকের দিদি বীরজা বলেন, “মা একটু কম বলল। ভাইকেই সব থেকে বেশি ভালবাসত। নিজের কাজ বাদ দিয়েও ভাইয়ের পড়ার দিকে তাঁর নজর ছিল বেশি।”

মাধ্যমিকে এ বারে রাজ্যে প্রথম হয়েছে মাথাভাঙার পচাগড়ের বাসিন্দা সৌভিক বর্মন। পরিবারের সদস্যরা জানান, ছোট বেলা থেকেই মায়ের ন্যাওটা ছিল সৌভিক। মাকে ছাড়া তাঁর একবিন্দু চলত না। ছোটবেলায় সারদা শিশুতীর্থে ভর্তি করানো হয় তাঁকে। সেই সময় রতিকাদেবী সব সময় তাঁর পাশে থেকেছেন। স্কুল থেকে কী পড়তে দিয়েছে, সেই কাজ হল কী না, তা নিয়ে বসে পড়তেন ছেলের সঙ্গে। একটা পড়া দিয়ে সেটা কতটা সেখা হল, তা জানতে নিজেই পরীক্ষা নিতে বসতেন। তাঁর বাবা পরেশবাবু হাইস্কুলের শিক্ষক। সব সময় সময় দিতে পারতেন না। রতিকাদেবী তখন রান্না ঘরে ছেলেকে নিয়ে বসতেন। একদিকে চলত রান্না। আরেকদিকে ছেলের পড়া সামলাতেন। সৌভিক বড় হয়েছে, ওই চরিত্র কিন্তু পাল্টায়নি। এখন সৌভিক নিজের ঘরে পড়তে বসত। রান্না বসিয়ে ঘন ঘন ওই ঘরে গিয়ে ছেলের পড়াশোনার খোঁজ নিতেন তিনি। সৌভিকও মাঝে মধ্যে রান্না ঘরে মায়ের কাছে যেত। মায়ের হাতে বই দিয়ে প্রশ্ন করতে বলত তাঁকে। উত্তর দিত সে। সৌভিক বলে, “আমার ভাল ফলে সবাই সাহায্য করেছে। কিন্তু মা তো মা। এটা না বললে সফলতার অনেক কিছু অপ্রকাশিত থেকে যাবে।” মায়ের প্রতি এটা তার শ্রদ্ধার্ঘ্য।

•বালুরঘাট

রাজদীপ গঙ্গোপাধ্যায়

বালুরঘাট হাইস্কুল | ৬৮০

সব সময় পাশে থেকে ওদের মা সঙ্গ দিয়ে উৎসাহ জুগিয়েছেন। বাড়িতে কম্পিউটার, ইন্টারনেট সংযোগ থেকে স্মার্টফোন, অত্যাধুনিক টেলিভিশন সবই ছিল ওদের হাতের মুঠোয়। মায়ের সান্নিধ্য ও সাহায্য পেয়ে ফেসবুক, হোয়্যাটস অ্যাপ ভুলে দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাট হাইস্কুলের দুই ছাত্র রত্নদীপ ভট্টাচার্য এবং রাজদীপ গঙ্গোপাধ্যায় এবারে মাধ্যমিকে ৬৮০ নম্বর পেয়ে রাজ্যের সম্ভাব্য মেধা তালিকায় চতুর্থ স্থানে রয়েছে। স্কুলের দুই মেধাবী ছাত্রের সাফল্যে স্কুলের শিক্ষকেরা উচ্ছ্বসিত। দুজনের বাড়ি শহরের চকভবানী এলাকার পাশাপাশি সংকেত এবং উত্তরায়ণ ক্লাব পাড়ায়। রাজদীপ বলছিল, মায়ের কড়া নজর ছিল বলেই এতটা ভাল ফল হয়েছে। বাবা তো আছেনই। কিন্তু সব সময় তাঁর পক্ষে নজর দেওয়া সম্ভব হয় না।

রাজদীপের এই সাফল্যের কাহিনিতে যে তিনি অনেকটা জুড়েই, সেটা মা বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন তাঁর হাসিতে। নির্মল আনন্দের হাসি ছড়িয়ে ছিল তাঁর মুখে। রাজদীপের বাবাও হাসছিলেন। যা দেখে এবং প্রশ্ন শুনে মা বললেন, সাফল্য তো একার হয় না। সকলের। সেই টিম ওয়ার্কে হালটা যে তাঁর হাতেই, সেটা আরও এক বার স্পষ্ট হয়ে গেল।

•বালুরঘাট

রত্নদীপ ভট্টাচার্য

বালুরঘাট হাইস্কুল | ৬৮০

রত্নদীপের বাবা কঙ্কন ভট্টাচার্য স্বাস্থ্য দফতরের কর্মী। মা মধুমিতাদেবী গৃহকত্রী। রাজদীপের বাবা রঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায় এবং মা সুমিতাদেবী—দু’জনেই হাইস্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষিকা। সুমিতাদেবী স্কুলের চাকরির সময়টুকু বাদে তাদের একমাত্র ছেলে রাজদীপকে বন্ধুর মতো বাকি সময় সঙ্গ দিয়ে গিয়েছেন। মা মধুমিতাদেবীকে সব সময় পাশে পেয়ে পঠনপাঠন চালিয়ে গিয়েছে রত্নদীপ। কেন? দু’জনের মা-ই হয়ে উঠেছিলেন ওই দুই পড়ুয়ার বন্ধু। ভুগোলের শিক্ষিকা সুমিতাদেবী বলেন, সন্তানের সঙ্গে বন্ধুর মত মিশেছি। সময় দিয়েছি। এক সঙ্গে আমরা সিনেমা দেখেছি। একইভাবে মধুমিতাদেবীও ছিলেন একমাত্র ছেলে রত্নদীপের ছায়াসঙ্গী। তাঁর কথায়, ‘‘ওর বাবাকে অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। ছেলের শখ আহ্লাদের সঙ্গী হয়ে প্রতিনিয়ত লেখাপড়ায় উৎসাহ দিয়েছি। ভালোমন্দ বুঝিয়েছি।’’ দুই মায়ের-ই বক্তব্য, চার দিকে নেট-যুগের চনমনে ও বহির্মনা পরিবেশ থেকে ছেলেদের সযত্নে সরিয়ে রেখে পড়াশোনায় মনোযোগী করে তোলাটা এখন অভিভাবকদের কাছে চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জের প্রথম পরীক্ষায় এই দুই কৃতি ছাত্রের মতো দুজনের মা-ও সফল।

মধুমিতাদেবী বলেন, ‘‘ক্যুইজ, ক্রিকেট ও গান অন্তঃপ্রাণ রত্নদীপ বাড়িতে এক টানা পড়ার ফাঁকে হটাৎ উঠে বারান্দায় গিয়ে ব্যাট হাতে স্যাডো প্র্যাক্টিস করতে থাকল। কখনও রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়ে ফের পড়ার টেবিলে। সেই সময় আমাকেও তার সঙ্গ দিতে হত।’’ আবার সুমিতাদেবীর কথায়, ‘‘ছোট থেকে রাজদীপ ফার্স্ট বয়। মাধ্যমিকের টেস্টে ৬৭৫ নম্বর পেয়ে স্কুলে দ্বিতীয় হওয়ায় ছেলে হতাশায় ভেঙে পড়েছিল। ওকে সব সময় বুঝিয়ে উৎসাহ দিতে থাকায় ছেলে মনের জোর ফিরে পায়। মাধ্যমিকে এই ফল আমরা আশা করেছিলাম।’’ রাজদীপ ৭ জন গৃহশিক্ষকের কাছে পড়েছে। পাশাপাশি বিজ্ঞানের শিক্ষক বাবা রঞ্জনবাবু পড়িয়েছেন ভৌতবিজ্ঞান। এবং মা পড়িয়েছেন ভূগোল। ফেলুদার ভক্ত রাজদীপ গোয়েন্দা গল্প পড়তে ও মাছ-মাংস, পোলাও খেতে ভালোবাসে। ভবিষ্যতে ডাক্তার হতে মেডিক্যাল নিয়ে পড়ার লক্ষ্য রয়েছে রাজদীপের।

খেলাধুলা থেকে ক্যুইজ ও গানেও সফল রত্নদীপ। গত বছর স্কুল ক্যুইজ প্রতিযোগিতায় রাজ্যে প্রথম হয় রত্নদীপ। রবীন্দ্রসঙ্গীতে থেকে স্কুল ক্রিকেটে সেরা ছাত্র সে। রত্নদীপও ৮ জন গৃহশিক্ষকের কাছে পড়েছে। ভবিষ্যতে প্রশাসনিক স্তরে আধিকারিক হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগোতে চায় রত্নদীপ। দুই রত্নগর্ভা মা-ও তাঁদের ছেলেদের ভবিষ্যতের ইচ্ছার সাফল্যে যোগ্য সঙ্গত দিতে তৈরি-ই রয়েছেন। জীবনের পরীক্ষাতেও তাঁরা পাশে থাকবেন।

•মালদহ

মেঘাশ্রিতা দাস

বার্লো বালিকা বিদ্যালয়, মালদহ | ৬৭৯

মধুরিমা ঘোষ

বার্লো বালিকা বিদ্যালয়, মালদহ | ৬৭৯

মাধ্যমিকের রাজ্য মেধা তালিকায় এক ঝাঁক ছাত্রছাত্রী রয়েছে মালদহের। ইংরেজবাজার শহরের বার্লো বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ বিদ্যামন্দিরের ছাত্রছাত্রীরা যেমন রয়েছে, ঠিক তেমনই জেলার গ্রামের স্কুলগুলির পড়ুয়ারাও ঢুকে পড়েছে রাজ্য মেধা তালিকায়। জেলাতে ভাল ফলের পাশাপাশি বেড়েছে পাশের হারও। তাতে খুশি শিক্ষা মহল। জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক (মাধ্যমিক) আশিস চৌধুরী বলেন, ‘‘গত বছরের থেকে এ বারে প্রায় তিন শতাংশ বেশি পরীক্ষার্থী পাশ করেছে। রাজ্যের মেধা তালিকায় মালদহেরই ছয় জন ছাত্র ছাত্রী রয়েছে।’’

নির্বাচনে নিজেদের ফল নিয়ে চাপা উত্তেজনা থাকলেও জেলার ছাত্র ছাত্রীদের সাফল্যে খুশি সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতা নেত্রীরা। কৃতী ছাত্র ছাত্রীদের সংবর্ধনা ও শুভেচ্ছাও জানিয়েছেন তাঁরা। কংগ্রেসের নেত্রী মৌসম নূর, সিপিএমের জেলা সম্পাদক অম্বর মিত্র এবং তৃণমূলের কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী, সাবিত্রী মিত্র, দুলাল সরকারের মতো নেতারা খুশি।

ইংরেজবাজারের বার্লো বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দুই ছাত্রী মেঘাশ্রিতা দাস ও মধুরিমা ঘোষ ৬৭৯ নম্বর পেয়ে যুগ্ম ভাবে পঞ্চম হয়েছে। মেঘাশ্রিতা ইংরেজবাজার শহরের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মকদমপুর এলাকার বাসিন্দা। তার বাবা মা দু’জনই শিক্ষকতা করেন। তবে মেঘাশ্রিতার ইচ্ছে রয়েছে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। তাই রাজস্থানের একটি কোচিং সেন্টারে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছে। এদিন নিজের বাড়িতে বসে মেয়েকে ফোনে ফলের কথা জানান বাবা অমিতকুমার দাস। তিনি বলেন, ‘‘মাধ্যমিক পরীক্ষায় দিয়েই কোচিং নিতে রাজস্থান চলে গিয়েছে মেয়ে। সেখানে আমার স্ত্রীও রয়েছেন। মেয়ের ইচ্ছে পূরণ করা আমাদের এক মাত্র লক্ষ্য।’’

ইংরেজবাজারেরই ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর কৃষ্ণপল্লি এলাকায় থাকে মধুরিমা। তার বাবা মনোরঞ্জনবাবুও পেশায় শিক্ষক। মা মানসীদেবী গৃহবধূ। তাঁদের দুই মেয়ের মধ্যে মধুরিমায় বড়ো। মেয়ের এমন সাফল্য খুশিতে ভাসছে ঘোষ পরিবার। মানসীদেবী বলেন, ‘‘এখনও নিজের হাতে খেতে পারে না। আমিই রোজ খাইয়ে দিতাম। মধুরিমা যখন রাত জেগে পড়ত তখন তার পাশেও বসে থাকতাম। এখন মনে হচ্ছে কষ্ট যেন সার্থক হল।’’ মধুরিমার ইচ্ছে রয়েছে চিকিৎসক হওয়ার।

জেলা শিক্ষা দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, এ বারে জেলায় মোট পরীক্ষার্থী ছিল ৪৯ হাজার ৪৮৬ জন। তার মধ্যে ২১ হাজার ৬৪৪ জন ছাত্র এবং ছাত্রী ছিল ২৭ হাজার ৮৪২জন। পাশ করেছে ৮২.৭৬ শতাংশ। গত বছর জেলাতে পাশ করেছিল ৭৯.৩ শতাংশ। বিগত বছর রাজ্য মেধা তালিকায় মালদহের কেউ ছিল না। এ বারে সেই তালিকায় রয়েছে সাত জন। খুশি জেলার সকলেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE