Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

বন্দি ছেলেদের মুক্তির খোঁজে দিশাহারা দম্পতি

কেঁদেই চলেছেন এক বৃদ্ধ দম্পতি। দু’চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে গাল। দু’হাতে বুক চাপরাতে চাপরাতে বৃদ্ধ বলল, “ পৃথিবীতে আমিই একমাত্র দুর্ভাগা বাবা। বাবা হয়ে ছেলের কোমরে লোহার শিকল পড়িয়ে বন্দি করে রেখেছি ২৬ টা বছর।

শেকলে বন্দি দুই ভাই। নিজস্ব চিত্র।

শেকলে বন্দি দুই ভাই। নিজস্ব চিত্র।

রাজকুমার মোদক
ধূপগুড়ি শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০১৬ ০৭:৩৭
Share: Save:

কেঁদেই চলেছেন এক বৃদ্ধ দম্পতি। দু’চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে গাল। দু’হাতে বুক চাপরাতে চাপরাতে বৃদ্ধ বলল, “ পৃথিবীতে আমিই একমাত্র দুর্ভাগা বাবা। বাবা হয়ে ছেলের কোমরে লোহার শিকল পড়িয়ে বন্দি করে রেখেছি ২৬ টা বছর। আমি ওদের মুক্তি চাই। কিন্তু, কী ভাবে দেব বুঝতে পারি না।”

শিকল পড়িয়ে রাখা, দুই মানসিক ভারসাম্যহীন সন্তানের মুখের সামনে সময় মতো খাবারের থালা ধরেন। তাদের সাফসুতরো রাখা, স্নান করানো সবই করতে হয় ৬৫ বছরের বৃদ্ধ বাবাকে। বিপদের আশঙ্কা করে রাত জেগে ছেলেদের পাহারা দেন।

শিকল বন্দী দুই ভাইয়ের কাহিনী জানাতে গিয়ে প্রতিবেশি যুবক ওয়াজেদ আলি বললেন, “এত কষ্ট সহ্য করা যায় না। মেঝভাই সাহানুরের সঙ্গে ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়েছি। খুব ভালো বন্ধু ছিল আমার। পাশেই বাড়ি। চোখের সামনে বন্ধু ও তাঁর পরিবারের অসহনীয় কষ্ট সহ্য করতে পারি না। ”

জলপাইগুড়ি জেলার ধূপগুড়ি ব্লকের শালবাড়ি ২ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের চামটিমুখি গ্রাম। গ্রামে হোমিওপ্যাথির প্র্যাকটিস করেন ৬৫ বছরের বৃদ্ধ আয়ুব আলি। তিন ছেলের মধ্যে মেঝ ছেলে ৪২ বছরের সাহানুর আলম। গত ২৬ টি বছর ধরে বাড়ির একটি ছোট ঘরে লোহার শিকলে বন্দি। তখন সাহানুর ১৬ বছরের এক তরতাজা কিশোর। হাসত, খেলত, স্কুলে যেত। এরপর আস্তে আস্তে তার হারিয়ে যাওয়া শুরু। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে প্রতিবেশিদের ও গ্রামের বাজারে গিয়ে মানুষকে মারধর করত, জিনিসপত্র ভাঙচুর করত সে । নানা জায়গা থেকে আসা অভিযোগের চাপে নিরুপায় হয়ে সাহানুরকে তার বাবা শিকল দিয়ে ঘরের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখতে শুরু করেন। চিকিৎসাও করিয়েছেন সাধ্যমতো। কিন্তু ফল মেলেনি কোনও।

বড় ভাই ৪৪ বছরের আব্দুল হাকিম। আব্দুলও ১৬ বছর বয়সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে নিঁখোজ হয়ে গিয়েছিল । তারপর অনেক খোঁজাখুঁজি করে বাড়িতে নিয়ে আসা হল। তখন তাঁকেও কিছুদিন শিকলে বেঁধে রাখতে হয়েছিল। কয়েক বছরের চিকিৎসায় পুরো সুস্থ হয়ে যায় সে। ৯ বছর আগে বিয়ে করে ঘর সংসারি হয় আব্দুল। স্ত্রী ও এক ছেলে, এক মেয়ে নিয়ে সাত বছর চলার পর ফের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে সেও উন্মাদ। গত ছ’মাস ধরে সেও লোহার শিকলে বন্দী।

মানবাধিকার বিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্য প্রসেনজিৎ রায় বলেন, “কোনভাবেই কাউকে শিকলে বেঁধে রাখা যায় না। আমরা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখব।”

দুই ভাইকে সুস্থ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন বৃদ্ধ আয়ুব আলি। কিন্তু পারছেন না। আট বিঘা কৃষি জমি ছিল তাঁর। গ্রামের ধান ভাঙানোর মিল ছিল। এক সময় মোটামুটি সুখেই ছিলেন। দুই সন্তান মানসিক ভারসাম্য হারানোর পর থেকে ধূপগুড়ি, জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি সহ বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসা করিয়েছেন। চিকিৎসার খরচের জন্য জমি, ধানের মিল সব বিক্রি করতে হয়েছে। এমনকি বাস্তু ভিটেখানিও ব্যাঙ্কের কাছে বন্ধক রেখে ঋণ নিয়ে চিকিৎসার খরচ যোগাতে পিছিয়ে আসেন নি তিনি। বিক্রি করা হয়েছে তাঁদের মা নুরজাহান বিবির সব অলঙ্কার।

এখন বাড়িতে দুই ছেলেকে সামলে যতটুকু সময় পান গ্রামের মজেরমিল বাজারে হোমিওপ্যাথির প্রাকটিস করে সামান্য কিছু রোজগার করেন। গত কয়েক বছর ধরে সংসারে চলছে চরম আর্থিক অনটন। কোনও কোনও দিন তিন বেলা ভাল করে খাবারও জোটে না। তবু তিনি সরকারের খাতায় স্বচ্ছল। তাই বিপিএল তালিকায় নাম নেই। তাঁর চোট ছোট ছেলে একটি ওষুধের দোকানে ওষুধ বিক্রির কাজ শিখছে। চার মেয়ের তিন মেয়ে বিবাহিত । ছোট মেয়ে ধূপগুড়ি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী।

মা নুরজাহান বেগম বলে, “মা কি কখনও সন্তানকে মরে যাওয়ার কথা বলতে পারে? কিন্তু চোখের সামনে নিজের সন্তানরা শিকলে বন্দী এ দৃশ্য দেখে কি করে ঠিক থাকতে পারি। ” প্রতিদিন দুই ছেলেকে ঘর থেকে কিছুক্ষণের জন্য বের করা, আবার ঘরে নিয়ে যাওয়ার সময় বা শিকলের বাঁধন ঠিক করতে গিয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন ছেলেদের হাতে অনবরত অত্যাচার সহ্য করেন বাবা। তবুও ছেলেদের পরিচর্যায় নাছোরবান্দা তিনি। বলেন, “আমি প্রশাসনের কাছে খাবার চাই না, মাথার উপরে ছাদ চাই না। শুধু আবেদন করি, ছেলেগুলোর ভার নিক প্রশাসন। উন্মাদদের চিকিৎসার কত ব্যবস্থা আছে। সেখানে যদি স্থান পেত। ওদের চিকিৎসার জন্য আর কোনও সহায় সম্বল নেই আমার।”

ধূপগুড়ির বিডিও শুভঙ্কর রায় শিকলে বন্দী দুই ভাইয়ের কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে যান। তিনি বলেন, “এত বড় ঘটনা কেউ আমাকে কখনও বলেনি। আমি শুধু একজনের মানসিক ভারসাম্যহীনতার কথা একবার শুনেছিলাম। কেন শিকল বন্দি থাকবে তাঁরা। মানসিক হাসপাতাল আছে, সেখানে নিয়ে যাওয়ার দরকার ছিল। আমি ওই বাড়িতে গিয়ে কথা বলে ব্যবস্থা নেব।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Chain-Shackled
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE