পুজোয় এখনও ছোট-বড় নানাবিধ ম্যাগাজিন প্রকাশ পায়। অনেক পত্রিকার বছরে একটিই সংখ্যা বেরোয়। পুজোর ধারেপাশে। তবে, লিটল ম্যাগাজিনগুলোর সম্পাদকমণ্ডলীও আজকাল পুজোর ‘থিম’-এ বিশ্বাসী। কোনও এক বিশেষ বিষয় নিয়েই বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়, শুধু সেই বিষয়ের উপর লেখা নানান প্রবন্ধ। বিশ্বকবি থেকে বিস্মৃতির অন্তরালে চলে যাওয়া কবির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চিন্তা, পরিবেশ দূষণ থেকে বাংলা নাটকের গান— বিষয় নানাবিধ, মতামতও অজস্র। প্রবন্ধের সংখ্যা ও ম্যাগাজিনের মোট পৃষ্ঠাসংখ্যা বিস্ময়কর। যেমন, এ বার এক ম্যাগাজিনের প্রাক্-শারদীয় সংখ্যা সাড়ে সাতশো পৃষ্ঠার। অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে বুঝতে অসুবিধে হয় না, এই বাজারি ভারসাম্যে জোগান বেড়েছে যখন, চাহিদাও বেড়েছে নিশ্চয়। এত প্রবন্ধ লেখা হচ্ছে, কারণ বাঙালি পাঠক প্রবন্ধ পড়তে চাইছেন।
শুধু (লিটল) ম্যাগাজিন নয়, বইপাড়ার প্রকাশক, বিশেষত নতুন প্রকাশনা সংস্থার কর্ণধাররাও এখন প্রবন্ধের চাহিদা-জোগান সম্বন্ধে একই ধারণা পোষণ করেন। বাংলায় সম্প্রতি প্রকাশিত বইয়ের সিংহভাগ তাই নানাবিধ প্রবন্ধ সংকলন। নতুন প্রকাশকরা বলেন, ‘আমরা শুধু সিরিয়াস বই ছাপি’। অর্থাৎ উপন্যাস গল্প কবিতা নয়, প্রবন্ধের বই। প্রবন্ধের আগে ‘গবেষণাধর্মী’ বিশেষণটা একটু জোরে উচ্চারণ করেন, যাতে বোঝা যায় তাঁদের কাজ কতটা ‘সিরিয়াস’।
প্রবন্ধকাররাও এই সব প্রবন্ধকে তাঁদের নিজেদের গবেষণার ফসল বলে মনে করেন। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের পদোন্নতির জন্যে এবং সরকারি অনুদান পেতে অধিকাংশ প্রবন্ধকারদের প্রয়োজন প্রকাশিত গবেষণাপত্র। অতএব, প্রবন্ধের, থুড়ি, গবেষণাপত্রের সংকলন।
প্রবন্ধ সংকলনগুলি পড়তে পড়তে মনে হল, সংখ্যায় বাড়লেও বাংলায় লেখা প্রবন্ধের মান আদৌ বাড়েনি। প্রবন্ধের পিছনের গবেষণা তো তথা এব চ। আধুনিক সমাজের নানা ক্ষেত্রের মতো এখানেও আমরা কোয়ান্টিটির চাপে পড়ে কোয়ালিটি খুইয়েছি। এর কারণ একাধিক। প্রথম কথা হল, প্রবন্ধকাররা প্রায় একই কথা লিখছেন, একই ভাবনা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে পেশ করছেন। বিশ্বকবি থেকে বীর সন্ন্যাসী— বিষয় যা-ই হোক না কেন, প্রবন্ধ মাত্রেই চর্বিতচর্বণ, বারো নম্বর প্রবন্ধ থেকে তেরো নম্বরটা লেখা। তফাত বড় জোর উনিশ-বিশ। পাঠক হয়তো প্রথম বারোটি প্রবন্ধ পড়ে দেখেননি। কিন্তু তাই বলে তেরো নম্বরটা লেখার যে কোনও যুক্তি থাকতে পারে না, এ কথা লেখক ভুলে যান। এতে সমাজের জ্ঞান মোটেই বাড়ে না, বঙ্কিমী যুক্তিতে দেশের উন্নতি বা সৌন্দর্যসাধনের তো কোনও প্রশ্নই নেই। অধিকাংশ প্রবন্ধই তাই শেষ পর্যন্ত পুরনো প্রকাশিত প্রবন্ধের পুনরাবৃত্তি হয়ে দাঁড়ায়। মৌলিক গবেষণাপত্র নয়, ইংরেজিতে যাকে বলে সার্ভে আর্টিকল।
কিন্তু প্রবন্ধকার সেটা স্বীকার করেন না। ইংরেজিতে লেখা গবেষণাপত্রে যে ভাবে রেফারেন্স তালিকা থাকে, তা বাংলা প্রবন্ধে সচরাচর মেলে না। তৃতীয়ত, নানাবিধ বিষয়ে তথ্য পরিবেশন করলেই ভাল প্রবন্ধ হয় না, এ কথাটা আমাদের প্রবন্ধকাররা বোঝেন না। উইকিপিডিয়া-র যুগে এ তো আরওই অচল। অথচ, আমাদের বইপাড়ায় যাঁর বাড়িতে যত পুরনো পত্রিকা ও বই আছে, তিনিই তত বড় গবেষক ও প্রবন্ধকার হওয়ার দাবি রাখেন। আক্ষরিক অর্থেই পুরনো নথি ঘেঁটে এই গরু-খোঁজাটাই যেন প্রবন্ধকারের গবেষণা হয়ে দাঁড়ায়।
অতি বড় প্রবন্ধকারও তাই পুজোয় ‘নতুন’ প্রবন্ধ লেখেন না। অথবা বলা ভাল, চর্বিতচর্চিত প্রবন্ধটি আদতে নতুন কি না, তা যাচাই করেন না বা যাচাই করার সুযোগ পান না। নিন্দুকেরা বলবেন, প্রাবন্ধিকরা জেনেবুঝেই ‘পুথির নকল’ এবং ‘নকলের নকল’ করে যান, এ ভাবেই তোতা-পাঠককে শিক্ষা দেওয়া হয়। পাঠকও সুযোগ পান না গত পুজোর বা তার আগের কোনও পুরনো পত্রিকার সংখ্যা পড়ার। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাই নতুন প্রবন্ধের প্রতিপাদ্যটি, ইংরাজিতে যাকে বলে ‘রি-ইনভেন্টিং দ্য হুইল’ হয়ে যায়। চাকা যে আগেই আবিষ্কৃত হয়েছে, তার খেয়াল পাঠক বা প্রবন্ধকার কেউই রাখেন না। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই যে প্রবন্ধকাররা সরাসরি চুরি করেন না, তবু ভাবের ঘরে চুরি বছরের পর বছর একই ভাবে চলতে থাকে।
আহা, যদি লিটল ম্যাগ-রা এ বার পুজোয় নতুন লেখা ছাপার বদলে সমস্ত পুরনো লেখা ডিজিটাল আর্কাইভের মাধ্যমে পাঠকদের হাতে তুলে দিতেন, তাতে আমার মতো পাঠকের লাভ হত, আখেরে উপকার হত প্রবন্ধকারদেরও।
ব্রিটেনে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy