Advertisement
E-Paper

দেহদানের ‘জুমলা’

দেহদানে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে কেবল প্রচার করলেই হয় না। বড় কথা হল সদিচ্ছা রূপায়ণের পরিকাঠামো তৈরি করা। এ তল্লাটে সেই নির্মাণ এখনও দূর অস্ত্। কথা বিস্তর, প্রস্তুতি অতি অল্প।রঞ্জিত কুমার পোদ্দার নামটি পাঠকের পরিচিত নয়। এমএলএ-এমপি নন তিনি। মিনিস্টার বা ফিল্মস্টার তো দূরের কথা। রঞ্জিতের ঠিকানা সর্বমঙ্গলা পল্লি, শেওড়াফুলি। ডিগ্রি বলতে হায়ার সেকেন্ডারি। তার পর প্রযুক্তি পেশা-র পড়াশোনা। জন্ম মধ্যবিত্ত ঘরে।

পথিক গুহ

শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০২

রঞ্জিত কুমার পোদ্দার নামটি পাঠকের পরিচিত নয়। এমএলএ-এমপি নন তিনি। মিনিস্টার বা ফিল্মস্টার তো দূরের কথা। রঞ্জিতের ঠিকানা সর্বমঙ্গলা পল্লি, শেওড়াফুলি। ডিগ্রি বলতে হায়ার সেকেন্ডারি। তার পর প্রযুক্তি পেশা-র পড়াশোনা। জন্ম মধ্যবিত্ত ঘরে। আকাশছোঁয়া উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না, তবে কিছু একটা করার প্রতিজ্ঞা ছিল। মানে দেশের জন্য কাজ। কী করা যায়? কেন, সেনাবাহিনী তো আছে। প্রায় ৬ ফুট লম্বা, সৌম্যদর্শন এবং সুঠামদেহী রঞ্জিত ১৯৫৯ সালে নাম লেখালেন ভারতীয় বায়ুসেনায়। টেকনিক্যাল কর্মী।

১৯৬২ সাল। ভারত-চিন যুদ্ধ। রঞ্জিত বায়ুসেনার একনিষ্ঠ সদস্য। ১৯৭১। ভারতের সঙ্গে পাঞ্জা পাকিস্তানের। রঞ্জিত এ বারে গোলাগুলির মাঝখানে। মাসের পর মাস ঘাঁটি গেড়ে সাবেক পূর্ব-পাকিস্তানে। রঞ্জিত ভাবলেন দেশের জন্য প্রাণপাত পুণ্যের কাজ। এবং নিজের কাজে ডুবে থাকলেন।

১৯৮১। সেনাবাহিনী থেকে অবসর। রঞ্জিত এলেন শেওড়াফুলিতে। সংসার বলতে স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে। অবসরপ্রাপ্ত সেনা হিসেবে চাকরি পেলেন ব্যাংকে। সেখানে ১০টা-৫টা। তার বাইরে অঢেল সময়। এবং রঞ্জিতের অন্য কাজ। সমাজসেবা। পরোপকার ছাড়াও একটা কাজ জুটে গেল রঞ্জিতের। উজান নাট্যদলে। ‘মারীচ সংবাদ’, ‘দৈবের হাতে নেই’, ‘বিপন্ন’ কিংবা ‘সক্রেটিসের জবানবন্দী’ নাটকে অভিনয়। কোনওটির নায়ক নন তিনি। তেমন বাসনাও নেই। বরং পছন্দ পার্শ্বচরিত্র। কারণ, তাঁর মনোভাব— ‘দোজ হু স্ট্যান্ড অ্যান্ড ওয়েট...’ রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী সম্পর্কে নেই কোনও বাড়তি শ্রদ্ধা। রঞ্জিতের আইডল এক জন: শঙ্কর গুহ নিয়োগী।

২০০১। বয়স ৬০। ব্যাংকের চাকরি থেকে অবসর। কিন্তু কাজে অবসর যে রঞ্জিতের পছন্দ নয়। চায়ের দোকানে আড্ডা দিয়ে অথবা মন্ত্রী-আমলাদের গালমন্দ পেড়ে সময়যাপনে তাঁর অরুচি। সুতরাং, এ বার খোঁজ স্বেচ্ছায় শ্রমদানের। সুযোগও হাতের কাছে। শ্রীরামপুরে শ্রমজীবী মানুষের নিজস্ব হাসপাতাল। রঞ্জিত বনে গেলেন সেখানকার ‘হোলটাইমার’। রঞ্জিতের কাজ? জব-প্রোফাইলটি অভিনব। কখনও হাসপাতাল কর্মীদের কাজে সাহায্য করছেন, আবার কখনও নিরক্ষর রোগীদের পড়ে শোনাচ্ছেন ডাক্তারবাবুর লেখা প্রেসক্রিপশন। কোন ট্যাবলেট দিনে ক’বার খেতে হবে। ফাইফরমাসের কাজ সামলেও ঘণ্টা ফুরোয় না যে। রঞ্জিতের আরও কাজ জুটে গেল। হাসপাতালের আছে নিজস্ব স্কুল। ছাত্রছাত্রী বলতে গ্রামের দুঃস্থ সংসারের কচিকাঁচা। রঞ্জিত নেমে পড়লেন তাদের নিয়ে নাটকে। এমন হোলটাইমারের পিতৃদত্ত নামটা গেল প্রায় হারিয়ে। ৮ থেকে ৮০, তিনি সকলের ‘বড়দা’।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, জীবনের যোগফল মানুষ অসহায় ভাবে সঁপে দেয় মৃত্যুর পায়ে। বড়দা সৈনিক, সঁপে দেওয়া তাঁর রক্তে নেই। তাঁর ইচ্ছা, অতিক্রম করবেন মৃত্যুকেও। তাই, ১৯৯১ সালে দ্বারস্থ হলেন একটি সংস্থার। অঙ্গীকার করলেন মরণোত্তর দেহদানের। নিশ্বাস বন্ধ হলে তো সেই ইলেকট্রিক চুল্লি। তার আগে এই নশ্বর দেহটা যদি কারও উপকারে লাগে তো মন্দ কী!

হায় মরণ! তা এল ২ জুলাই, ২০১৫। সন্ধে সাড়ে ছ’টায়। কী আর করেন, মৃত্যুর সময়টা বেছে নেওয়ার ক্ষমতা যে তাঁর ছিল না। নয়তো দেহদানে অঙ্গীকারবদ্ধ মানুষটা হয়তো মরতেন সকালবেলায়। সন্ধে সওয়া সাতটায় ফোন করা হল সংস্থাটিতে। এক কর্তা নির্দেশ দিলেন, বডি নিয়ে যান অমুক সরকারি হাসপাতালে। অ্যানাটমি ডিপার্টমেন্টের সামনে পাবেন ডোমকে, তিনি যা করার করবেন। যদি না পান তাকে, বডি নিয়ে যাবেন তমুক সরকারি হাসপাতালে, সেখানে অ্যানাটমি বিভাগে ডোম যা করার করবে।

মৃত্যুর পর ডাক্তারি মোতাবেক অপেক্ষা চার ঘণ্টার। বড়দার বডি শ্রীরামপুর থেকে শেওড়াফুলির বাড়ি ছুঁয়ে পৌঁছল অমুক হাসপাতালটিতে। রাত বারোটা, টিপটিপে বৃষ্টি। কোথায় ডোম! ভোঁ-ভাঁ। শববাহী গাড়ি চলল তমুকের দিকে। রাত একটা, সেখানেও ডোমের দেখা নেই। কী করা? ফোন গেল দেহদানের অঙ্গীকার নথিভুক্ত করে নেওয়া সংস্থাটির সেই কর্তার কাছে। অনেক বার। ফোন বেজে গেল। কর্তা তখন, হয়তো-বা, গভীর ঘুমে।

তবে কি বড়দার বডি এ বার যাবে শ্মশানে? নাহ্‌, মানুষটার অঙ্গীকারকে ধুলোয় মিশতে দেওয়া যায় না। হাসপাতাল চত্বর খুঁজে শবানুগামীরা জোগাড় করলেন ডোমের ফোন নম্বর। ফোন গেল তাঁর কাছে। তিনি ধরলেন। জানালেন, তিনি কোন্নগরে। অত রাতে আসতে পারবেন না। আরও বললেন, ওই সেই সংস্থাটি থেকে তাঁকে কোনও খবর দেওয়া হয়নি। জানা থাকলে তিনি হাসপাতালে হাজির থাকতেন। অনেক পীড়াপীড়িতে তিনি আর এক ডোমের ফোন নম্বর দিলেন। যোগাযোগ করা হল তাঁর সঙ্গে।

খোঁজ করে তাঁর দেখা মিলল। তবে তিনি বললেন, কাজ তো হবে না। কেন? অ্যানাটমি ঘরে তালা। চাবি তো নেই তাঁর কাছে। আর তা ছাড়া, রাতে বডি এলে এমন কাজের জন্য সরকার আগে যে মজুরি দিত, এখন তা বন্ধ। সুতরাং কাজ হবে কেন? এ সব শুনে মাঝরাতে শবানুগামীদের রোখ চেপে গেল। তবে যে সরকারের এত আহ্বান! ‘দেহদানের অঙ্গীকার করুন’ বলে ক্রমাগত প্রচার করে চলা সংস্থাটির এত প্রেস কনফারেন্সে নিজেই নিজেদের পিঠ চাপড়ানি! অনেকের মনে হল, বড়দাকে এ ভাবে অপমান করার অধিকার কারও নেই। সুতরাং রাতেই শবদেহ নিয়ে বসে পড়া যাক রাজপথে। ঘুম ভেঙে নগরবাসী দেখুক দেহদান আহ্বানের বাস্তব ছবি।

পরিস্থিতি গড়াল না তত দূর। ‘প্রাপ্য’ টাকা গুঁজে দেওয়া হল ডোমের পকেটে। তা পেয়ে সে বডি নিয়ে গেল অ্যানাটমি ঘরে। শবানুগামীরা পেলেন শিক্ষা। যে মজুরি বন্ধ করেছে সরকার, তা ফের চালু করতে হবে। চাঁদা তুলে চালু হোক না বড়দার নামে ফান্ড— শুধু এই লক্ষ্যে।

ভুক্তভোগী শবানুগামীরা রাতভর অভিজ্ঞতায় যে-শিক্ষা পেলেন, তা কি একটুও স্পর্শ করবে ওই সংস্থা কিংবা সরকারকে? তাঁরা কি এই প্রজ্ঞা অর্জন করবেন যে, দেহদানে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হলে মাঝরাতেও ফোন ধরতে হয়, কিংবা কারও মজুরি হঠাৎ বন্ধ করতে হয় না? মোদ্দা কথা, সদিচ্ছাই শেষ নয়, তার চেয়েও বড় কথা হল সদিচ্ছা রূপায়ণের পরিকাঠামো তৈরি করা। নইলে সবই তো সেই কলকাতাকে লন্ডন বানিয়ে ফেলার আস্ফালন, কিংবা কালো টাকা ফেরত এনে গরিবের অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। ‘জুমলা’। ইলেকশন স্টান্ট।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy