ব্যাধি দুরারোগ্য হইলে মানুষ উদ্ভ্রান্ত হইয়া পড়ে, কখনও এই চিকিৎসকের কাছে দৌড়য়, কখনও ওই টোটকা দিয়া দেখে, কখনও বা সেই দেবতার থানে ধর্না দেয়। সিপিআইএমের ব্যাধি যে দুরারোগ্য হইয়াছে, তাহা দলের নেতাদের আচরণেই প্রকট। বর্ধমানের সন্ত্রাস তাঁহাদের সম্পূর্ণ বেসামাল করিয়া দিয়াছে। এই ঘটনা হইতে উদ্ভূত জটিল পরিস্থিতির মোকাবিলায় দলনেতারা বিচিত্র আচরণ করিতেছেন, তাঁহাদের কণ্ঠে বিচিত্র সব সওয়াল শোনা যাইতেছে। আবার, এক নেতার কথার বিরূপ প্রতিক্রিয়া হইতে পারে, এই আশঙ্কায় আর এক নেতা ভারসাম্য আনিবার তাগিদে আর এক কথা বলিতেছেন এবং সেই কথারও কোনও যুক্তি খুঁজিয়া পাওয়া যাইতেছে না। প্রকাশ কারাট সম্প্রতি বলিয়াছেন, বর্ধমানের তদন্তভার এনআইএ-র হাতে দেওয়াই ঠিক হইয়াছে। কথাটি ভুল নহে, কিন্তু কথা ঠিক হইলেই প্রকাশ কারাট সে কথা বলিয়া থাকেন, এমন দুর্নাম তাঁহাকে কেহ দিবে না। রাজ্য পুলিশের বদলে এনআইএ’র তদন্ত চাহিয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্য প্রশাসনের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করা যায়, সেই কারণেই যে সিপিআইএম-এর কর্ণধার কথাটি বলিয়াছেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু এই উক্তি তাঁহার বঙ্গীয় সতীর্থদের চিন্তায় ফেলিয়া দিয়াছে যে, এই অবস্থান সংখ্যালঘু ভোটের ক্ষতি করিবে না তো?
এনআইএ তদন্ত শুরু করিবার পরে ঘটনাচক্র যে দিকে চলিতেছে, তাহার ফলে এমন আশঙ্কার কারণ বুঝিতে অসুবিধা নাই। সিপিআইএম দীর্ঘদিন এ রাজ্যে, বিশেষত দক্ষিণবঙ্গে সংখ্যালঘু ভোটের প্রধান প্রাপক ছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই ভাণ্ডারে প্রবল ধস নামাইয়া দিয়াছেন। তিনি সংখ্যালঘু ভোটের জন্য যাহা করিয়াছেন, তাহা অনেকাংশে আপত্তিকর এবং এমনকী বিপজ্জনক, কিন্তু ভোট ব্যাঙ্কের মাপকাঠিতে তাঁহার সাফল্য অনস্বীকার্য। ফলে প্রকাশ কারাটের উক্তির পরে আসরে নামিয়াছেন গৌতম দেব। তিনি ঘোষণা করিয়াছেন, তাঁহারা ‘উদ্বাস্তু’দের পক্ষে ছিলেন, আছেন, থাকিবেন।
আপাতশ্রবণে পুরানো ও বহুচর্চিত, কিন্তু গৌতমবাবুর উক্তির প্রেক্ষিতটি তাৎপর্যপূর্ণ। বর্ধমান কাণ্ডের পরে নূতন করিয়া উঠিয়া আসিয়াছে ‘অনুপ্রবেশ’ প্রশ্ন, এই প্রশ্নে বিজেপি’র রাজনৈতিক প্রচার ক্রমে উচ্চরব হইতেছে। সংখ্যালঘু ভোটের পক্ষে প্রশ্নটি গুরুতর বলিয়াই রাজ্য রাজনীতির প্রচলিত ধারণা। সুতরাং ‘উদ্বাস্তু রাজনীতি’র মোড়কে সিপিআইএম নেতা বুঝাইতে চাহিয়াছেন, তাঁহারা অনুপ্রবেশকে সমস্যা বলিয়া মনে করেন না। নীতিগত ভাবে অবস্থানটি অযৌক্তিক এবং বিপজ্জনক। গৌতম দেব এবং তাঁহার দলের বিলক্ষণ জানা আছে, ‘উদ্বাস্তু’ বা ‘শরণার্থী’ শব্দগুলির আড়ালে বেআইনি অনুপ্রবেশ নিয়ন্ত্রণের বাস্তব প্রয়োজনকে লুকানো সম্ভবপর নহে। ভোটের সুবিধা হইলেও তাহা করা উচিত নহে, কারণ রাজ্যের স্বার্থ ভোটের স্বার্থ অপেক্ষা অনেক বড়। কিন্তু এই প্রচারে সংখ্যালঘু ভোটের কী সুবিধা বামপন্থীরা পাইবেন, তাহাও বলা কঠিন। এখানেই উদ্ভ্রান্তির সুস্পষ্ট প্রমাণ। এই সম্পূর্ণ দিশাহারা অবস্থা হইতে মুক্তি চাহিলে সিপিআইএমকে আপন নীতিগত অবস্থান স্পষ্ট করিতে হইবে। এক মুখে এনআইএ ডাকিয়া জাতীয়তাবাদী হইব, অন্য মুখে ভোটব্যাঙ্ক রাখিতে অনুপ্রবেশের সমস্যাকে তুচ্ছ করিব— এই ‘ভারসাম্য’-এর রাজনীতি আত্মঘাতী, রাজ্যের পক্ষে ক্ষতিকরও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy