দুইটি পৃথক দলের উপর একই কাজের ভার ন্যস্ত হইলে যদি এক দল সর্বদাই ব্যর্থ হয়, আর অন্য দল সর্বদাই সফল, তবে প্রথম দল সম্বন্ধে দুইটি বিকল্প ধারণা সম্ভব। এক, তাহারা নিতান্তই অপদার্থ; অথবা দুই, তাহাদের লাগাতার ব্যর্থতার পিছনে কোনও বিশেষ উদ্দেশ্য বর্তমান। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ সম্বন্ধে কোন পর্যবেক্ষণটি অধিকতর প্রযোজ্য, এই বার সেই উত্তর সন্ধানের সময় হইয়াছে। সারদা কাণ্ডে দেখা গেল, রাজ্যের বিশেষ তদন্তকারী দল বৎসরাধিক কাল সময় নষ্ট করিয়াও যাহা পারে নাই, সিবিআই কার্যত তদন্তের ভার গ্রহণ করিয়াই সেই সমস্ত প্রমাণ সংগ্রহ করিয়া ফেলিয়াছে। খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পরেও রাজ্য পুলিশের কৃতিত্ব বলিতে ৫৫টি গ্রেনেড নষ্ট করিয়া ফেলা, এবং ঘটনাস্থল হইতে একটি কালো ব্যাগে কিছু অনির্দিষ্ট সামগ্রী ভরিয়া— নিন্দকের মতে— সরিয়া পড়া। সিআইডি-ও তথৈবচ। জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার প্রতিনিধিরা আসামাত্র তদন্তে গতি আসিয়াছে। এই বার রাজ্যবাসী জানিতে চাহেন, পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ ঠিক কী করিতেছে? আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বটি তাহারা বহু পূর্বেই বিস্মৃত। তদন্তে সাফল্য অর্জনও তাহাদের সাধ্যাতীত। তবে কি যে অভিযোগ লাগাতার উঠিতেছে, তাহাই যথার্থ এই রাজ্যের পুলিশের কাজ দাঁড়াইয়াছে প্রমাণ লোপাট করা? এমন প্রমাণ, যাহা নিরপেক্ষ তদন্তকারীর হাতে পড়িলে ক্ষমতাবানদের সমূহ বিপদ?
পুলিশকে এমন দলদাসে পরিণত করাকে বাম আমলের উত্তরাধিকার বলিয়া চালানো মুশকিল। সত্য, বাম জমানাতেও পুলিশ নিরপেক্ষ ছিল না। সেই আমলে রাজনৈতিক রং বিচার না করিয়াই পুলিশ পদক্ষেপ করিয়াছে, এমন দাবি করিলে সত্যের অপলাপ হইবে। কিন্তু, বর্তমান জমানায় পুলিশকে দেখিয়া যে ভাবে শাসক দলের নিচুতলার কর্মিবাহিনী ঠেকিতেছে, তাহা কিছুটা অভিনব। আর্থিক কেলেঙ্কারির সন্দেহের কথা অর্থমন্ত্রীকে জানাইবার পরেও সরকার অচল থাকিয়াছে। কেলেঙ্কারি ধরা পড়িবার পরও তদন্ত চলিয়াছে ঢিমেতেতালায়। জঙ্গি মডিউলের খবর পাইয়াও পুলিশের ঘুম ভাঙে নাই। বিস্ফোরণের পরেও পুলিশের নড়িয়া বসিতে যতখানি সময় লাগিল, তাহাতে মূল পাণ্ডারা নিরাপদ আশ্রয়ে পলাইতে পারিয়াছে। এই অপদার্থতা কি নেহাতই দক্ষতার অভাব, না কি কোনও গভীরতর ষড়যন্ত্র রহিয়াছে? স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আমরা ষড়যন্ত্রতত্ত্বে বিশ্বাসী নহি। তাহা বামপন্থী ও নব্য-বামপন্থীদের চারণভূমি। কিন্তু, এক দিকে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা আর অন্য দিকে মুখ্যমন্ত্রীর অনলাইন-অফলাইন গোঁসা— সব মিলাইয়া ছয়টি যন্ত্রের উপস্থিতির গন্ধ কিঞ্চিৎ তীব্র হইতেছে। কোন সুতায় কোন যন্ত্র বাঁধা, এই বার সেই সত্য জনসমক্ষে আসিবার সময় হইয়াছে।
পশ্চিমবঙ্গে যাহা চলিতেছে, তাহাতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দৃশ্যত স্বস্তিতে নাই। কিন্তু, তাঁহার সমস্যা রাজনৈতিক অস্তিত্ব লইয়া। তিনি আজ সংবাদমাধ্যম, কাল কেন্দ্রীয় সরকার, পরশুর পরের দিন সিপিআইএম-কে দোষী ঠাওরাইয়া নিজের অস্বস্তি কাটাইতে চেষ্টা করিবেন। পশ্চিমবঙ্গের সমস্যা ভিন্ন। রাজনীতিক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন ইতিহাসের পাদটীকায় পরিণত হইবেন, তখনও রাজ্যটি থাকিবে। কিন্তু, কী লইয়া? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁহার উত্তরাধিকার রূপে রাখিয়া যাইতেছেন এক বিকল, পক্ষপাতদুষ্ট, অকর্মণ্য প্রশাসন, আর রাজ্যব্যাপী এক অবিশ্বাসের পরিবেশ। রাজ্যে আইনের শাসন নাই, শৃঙ্খলা নাই, আর্থিক নিরাপত্তা নাই, এমনকী মৌলবাদী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সামান্যতম সক্রিয়তা নাই। এই আবহে বিনিয়োগ আসিবে, শিল্প হইবে, নূতন কর্মসংস্থান হইবে— কোনও রূপকথাও এতখানি কল্পনা করিতে পারিবে না। ক্ষুদ্র, সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করিতে রাজ্যের এত বড় ক্ষতি আর কেহ কখনও করেন নাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy