Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

মানবাধিকার শিকেয় উঠলে কার কী?

পশ্চিমবঙ্গে নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের উৎকট সব নজির দেখতে দেখতে মনে পড়ে যায়, ন’মাসের ওপর রাজ্যে সক্রিয় মানবাধিকার কমিশন নেই। কিংবা, আসলে মনে পড়ে না।পশ্চিমবঙ্গে নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের উৎকট সব নজির দেখতে দেখতে মনে পড়ে যায়, ন’মাসের ওপর রাজ্যে সক্রিয় মানবাধিকার কমিশন নেই। কিংবা, আসলে মনে পড়ে না।

শূন্য। রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের কর্ণধারের আসন। জানুয়ারি ’১৪। ছবি: প্রদীপ আদক

শূন্য। রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের কর্ণধারের আসন। জানুয়ারি ’১৪। ছবি: প্রদীপ আদক

সুকান্ত চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০১
Share: Save:

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের হাতে ছাত্র নিগ্রহের ছবি এখনও টিভিতে দেখি, মনের পর্দায় ফুটে ওঠে আরও ঘন-ঘন। আমরা অবশ্য সেই নিগ্রহের স্বরূপ নিয়ে বিভ্রান্ত। ক’জন পুলিশের হাতে লাঠি ছিল, সে প্রশ্ন অবান্তর। ‘লাঠি চার্জ হয়নি’ বলে পুলিশ কমিশনার অশ্বত্থামাবধ করেছেন, কারণ লাঠিচার্জ নামক বিশেষ পুলিশি ব্যবস্থা আক্ষরিক অর্থে প্রয়োগ হয়নি। দরকারও ছিল না, কারণ হানাদাররা দৃশ্যত অস্ত্রহীন যুদ্ধে প্রশিক্ষিত, তাদের হাত-পা-ই মারাত্মক হাতিয়ার। ছাত্র আন্দোলনের উপর ভারতে প্রথম কমান্ডো অভিযানের সাক্ষী হয়ে থাকল অরবিন্দ ভবনের পোর্টিকো। হতে পারে, কুশীলবরা পুলিশের খাতায় কমান্ডো পদে বহাল নয়, সে জন্য আশা করি দ্বিতীয় বার অশ্বত্থামাবধ হবে না।

একই প্রতিক্রিয়া ফের অনুভব করলাম মালদহের সাম্প্রতিক ঘটনার পর, যেখানে ফেসবুকে মুখ্যমন্ত্রী সম্বন্ধে আপত্তিকর মন্তব্য করায় এক যুবককে গ্রেফতারের পর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ লঙ্ঘন করে হাতকড়া পরানো হয়। যে রাজ্যে খুন, ধর্ষণ বা অগ্নিসংযোগের প্রকাশ্য প্ররোচনার পর সরকারের সোৎসাহ সমর্থন পাওয়া যায়, সেখানে ওই যুবকের মন্তব্য আরও কত জঘন্য ও ভয়াবহ ছিল, ভেবে নিশ্চয় আমরা শিউরে উঠব। কিন্তু দেখা গেল, শেষ পর্যন্ত মামলা রুজু হয়েছে দু’টি জামিনযোগ্য ধারায়, পুলিশপক্ষ আদালতে ভর্ৎসিতও হয়েছে। অম্বিকেশ মহাপাত্রের অভিজ্ঞতার সঙ্গে আপাত সাদৃশ্য ধরা পড়বেই। অম্বিকেশবাবুর সৌভাগ্য, তাঁকে হাতকড়া পরতে হয়নি।

পাশাপাশি আরও হরেক ঘটনা মনে আসতে পারে। যেমন, বীভৎস হুমকি ও প্ররোচনা একের পর এক নিদর্শন, যার দু-একটি কিংবদন্তি হয়ে বাকিগুলি বিস্মৃতির পথে ঠেলে দিয়েছে। যেমন বীরভূমে হুমকির ফলে ঘরছাড়া এক পরিবারের কাহিনি, যাদের নিরাপত্তার দায়িত্বে আছে গ্রিন পুলিশ, নাবালিকা কন্যার ‘সুরক্ষার’ জন্য থানার দারোগা তার বিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। যেমন বহু ধর্ষিতা ও নিগৃহীতা নারীর পরবর্তী বিড়ম্বনা। কী হল সেই মহিলার, ধর্ষণের পর রক্তাক্ত অবস্থায় জগাছা থানায় পৌঁছলে যাঁকে ভাগিয়ে দেওয়া হয়? বা গৃহকর্তার হাতে ধর্ষিতা সেই পরিচারিকার, অভিযোগ দায়ের করার জন্য যাঁকে সল্ট লেক থেকে গোসাবা ছোটাছুটি করতে হয়? এই লেখা লিখতে-লিখতেই পড়লাম, হাবড়ায় এমনি আক্রোশের সঙ্গে পুলিশ চোর ধরতে বেরিয়েছিল, যে তাদের আস্ফালনে এক নিরীহ ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। পাশাপাশি পড়লাম, অসুস্থ আত্মীয়ের জন্য সরকারি হাসপাতালে একটা ভাঙা ট্রলি জোগাড় করতে এক ভদ্রলোককে একশো টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে।

এমন অগুনতি ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’র একটাই যোগসূত্র: প্রত্যেকটিই মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রকট উদাহরণ। অতএব মনে পড়ে যায় আমাদের নাগরিক পরিকাঠামোয় এক বিপুল ও বিপজ্জনক ঘাটতি: নয় মাসের উপর এ রাজ্যে সক্রিয় মানবাধিকার কমিশন নেই।

লিখলাম বটে ‘মনে পড়ে যায়’, কিন্তু মনে আমাদের পড়ে না। সমাজ এ নিয়ে বিস্ময়কর ভাবে নীরব। বাঙালির বড় গর্বের রাজনৈতিক চেতনা প্রকাশ পায় চায়ের পেয়ালা বা টিভির পর্দার সামনে দলবাজির উপাদেয় চর্চায়, ইতিবাচক নাগরিকবোধের লেশমাত্র যাতে নেই। সংবাদ মাধ্যমের, বিশেষ বৈদ্যুতিন মাধ্যমের, বড় উপজীব্য রাজনৈতিক তামাসা, বহুপরিচিত ক’টি দলীয় মুখপাত্রের আপসে-খেলা সান্ধ্য বিতণ্ডা। খুব অসাধারণ উপলক্ষেও এর হেরফের ঘটে না। কৈলাস সত্যার্থীর নোবেল লাভের পর শিশুশ্রম, শিশুপাচার, শিশুদের অধিকার নিয়ে ক’টা আলোচনা শোনা বা পড়া গেছে?

সংবাদমাধ্যম আমাদের গণতন্ত্রের মস্ত স্তম্ভ। তারা না থাকলে উপরোক্ত কোনও ঘটনার কথা তো আমরা জানতেই পারতাম না। কিন্তু পিসার মিনারের মতো তার এই টালটাও স্বীকার করতে হয়। আমরাও অবশ্যই সেটা চাই বা চাইতে অভ্যস্ত হয়ে উঠি। সমাজ ও সংবাদমাধ্যমের এই ঔদাসীন্যের ফলেই কর্তাব্যক্তিরা বুক ফুলিয়ে মানবাধিকার সম্বন্ধে অবজ্ঞার অবহেলা করতে ভরসা পান। তবু তাঁরা হয় জনগণের বেতনভোগী নয় জনগণের ভোটপ্রার্থী, একটা বিশেষ দায় তাঁরা এড়াতে পারেন না। এ বিষয়ে তাঁদের সাম্প্রতিক খতিয়ান একটু দেখা যাক।

জানুয়ারি মাসে বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ের পদত্যাগের পর রাজ্য মানবাধিকার কমিশন কার্যত অচল। তার নেতৃত্বে থাকার কথা অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি বা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির। এই পদ শূন্য, শূন্য আরও পদ। এই প্রেক্ষিতে প্রশংসনীয় দ্রুততার সঙ্গে, তাঁর অবসর গ্রহণের খুব অল্প দিনের মধ্যেই সদস্য করা হল পুলিশের প্রাক্তন ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়কে। তিনিই আপাতত অস্থায়ী সভাপতি। কমিশনের ওয়েবসাইট অনুযায়ী আছেন আর মাত্র এক জন বিচারবিভাগীয় সদস্য।

এ অবস্থায় কমিশনের উপর আস্থা রাখতে বা তার শরণাপন্ন হতে মানুষের উৎসাহে ভাটা পড়তে বাধ্য। নীতিগত দিক দিয়েও প্রশ্ন উঠেছে, সদ্য-অবসরপ্রাপ্ত পুলিশপ্রধানকে কী বিচারে সভাপতি করা হল, যেখানে কমিশনের কাছে যত অভিযোগ আসে, তার বিপুল পরিমাণ পুলিশের বিরুদ্ধে। এই নিয়ে হাইকোর্টে মামলা চলছে। সাধারণ ন্যায় ও যুক্তির বিচারেই বলার অপেক্ষা রাখে না যে, একটা অবস্থানগত দ্বন্দ্ব ঘটছে।

সবচেয়ে আশ্চর্য, যে বিরোধী দলগুলি সরকারের সমালোচনায় পাঁচ কেন পঞ্চান্ন মুখ, তারা এ বিষয়ে প্রায় নীরব। আর একটু আগের ইতিহাস দেখা যাক। বামফ্রন্ট সরকারের শেষ দিকেও কমিশনের সভাপতিপদ বহু দিন খালি ছিল, বস্তুত নতুন সরকার বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়োগ করা পর্যন্ত। তার কারণ, যে কমিটি সভাপতি নির্বাচন করবে, তার এক সদস্য থাকেন বিরোধী দলনেতা। আর তৎকালীন বিরোধী (বর্তমান শাসক) দল তখন পণ করেছিল, সরকার পক্ষের সঙ্গে কোনও কমিটির বৈঠকে বসবে না। এই অন্যায় ও অসাংবিধানিক জেদের কাছে সরকারের নতিস্বীকার করার বাধ্যতা ছিল না। বিচক্ষণ সরকারপক্ষ কিন্তু দেখল, মানবাধিকার শিকেয় তুলে এক দিকে বিরোধীদের বদনাম দেওয়া যায়, সেই সঙ্গে রাজ্যে নির্বাচনের আগে কমিশনের উপদ্রব থেকেও রেহাই পাওয়া যায়।

আসলে সব সরকারই অনাচারের পথ পরিষ্কার রাখতে চায়, চায় জনসাধারণকে সাংবিধানিক অধিকার সম্বন্ধে অন্ধকারে রাখতে বা অন্তত সেই খাতে বঞ্চনাটা স্বাভাবিক বলে অভ্যস্ত করাতে। ফলে ঘটনা হল, গত চার বছরে স্থায়ী সভাপতি-সমেত পূর্ণক্ষম কমিশন আমরা পেয়েছি মাত্র বছর দেড়েক। জানি না অন্য কোনও রাজ্য এই রেকর্ড অতিক্রম করেছে কিনা। সেই সঙ্গে স্মর্তব্য, মহিলা কমিশনের সভানেত্রী নিজেই তাঁর কমিশনের সংহতি ও কার্যকারিতা নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছেন।

নাগরিক মাত্রেই জানেন, থানার দারোগা বা দফতরের বড়বাবুর কাছে কাকুতিমিনতি করে কিছু কাজ পাওয়া যেতে পারে, অধিকার হিসেবে দাবি করলেই বিপত্তি। অমুক নেতা সম্বন্ধে শোনা যাবে, তিনি ভারী জনদরদী ও পরোপকারী। খোঁজ নিলে বেরোবে সেই উপকারের নব্বই শতাংশ নিরুপায় মানুষকে এমন কিছু পাইয়ে দেওয়া, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সুষ্ঠু প্রশাসনের কাছ থেকে নাগরিকদের যার চতুর্গুণ পাওয়ার কথা।

জনসাধারণকে বশ করার তাড়নাতেই তাই প্রশাসনকে রাজনীতির দখলে রাখতে হয়, সাংবিধানিক কর্তব্য ভুলে ও ভুলিয়ে রাখতে হয়। এই শেষ কাজটা কঠিন নয়, কারণ ভুলে থাকার অবকাশ অশেষ। গরিব লোকের পক্ষে জীবনসংগ্রামই যথেষ্ট। সচ্ছল উচ্চাভিলাষী শ্রেণির কাছে আরও নানা সংগ্রাম। আর অবশ্যই আছে রঙিন টিভি, যাতে আমাদের নাগরিক অসম্মান আর বিড়ম্বনা ইনফোটেনমেন্টের রাংতা গায়ে জড়িয়ে ঝলমলে উপভোগ্য রূপে আমাদের মনোরঞ্জন করে।

কার্যকর মানবাধিকার কমিশন কবে পাব জানি না, কিন্তু এই নিয়ে দু-একটা চিত্তাকর্ষক টিভি-শো দেখার আশায় রইলাম। কবীর সুমনের ভাষায় ‘আমিও ভণ্ড অনেকের মতো’: ওগুলো দেখি, অংশও নিয়েছি কালেভদ্রে। কিন্তু একটা কাঙালিপনা কিছুতেই মন থেকে দূর হয় না: এই পিটুলিগোলার বদলে যদি সাচ্চা নাগরিক অধিকারের খাঁটি দুধ দু’ফোঁটা পেড়ে পড়ত!

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে এমেরিটাস অধ্যাপক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE