Advertisement
E-Paper

রাজবাড়ি সাকুল্যে একটাই, তাও যায় যায়

হাজার-বারোশো বছরের বাঙালি রাজারাজড়ার কীর্তিকাহিনি যতটা সুপরিচিত, তাঁদের রাজধানী শহরগুলি ততটাই অন্ধকারে। কেমন বাড়িঘরে থাকতেন তাঁরা, তারও খোঁজ মেলা ভার। তবু, উড়াইয়া দেখো ছাই...খুঁ জতে শুরু করেছিলাম বাঙালির রাজবাড়ি। বাংলায় রাজবাড়ির অভাব কি, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান, কোচবিহার, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ তো চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে, ছোটবড় আরও রাজা-জমিদারের প্রাসাদ ছড়িয়ে আছে দুই বাংলার প্রায় সব জেলাতেই। না, সে সব রাজবাড়ির কথা বলছি না। সে সবে তো সাহেবদের ছোঁয়া লেগে গিয়েছে। আরও আগের, পাল-সেন ছেড়ে দিলেও অন্তত সুলতানি আমল, নিদেন মুঘল জমানার কিছুই কি দেখা যাবে না?

ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০৩
বিষ্ণুপুর রাজবাড়ির দক্ষিণ প্রান্ত। ছবি: অভীক কুমার দে।

বিষ্ণুপুর রাজবাড়ির দক্ষিণ প্রান্ত। ছবি: অভীক কুমার দে।

খুঁ জতে শুরু করেছিলাম বাঙালির রাজবাড়ি। বাংলায় রাজবাড়ির অভাব কি, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান, কোচবিহার, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ তো চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে, ছোটবড় আরও রাজা-জমিদারের প্রাসাদ ছড়িয়ে আছে দুই বাংলার প্রায় সব জেলাতেই। না, সে সব রাজবাড়ির কথা বলছি না। সে সবে তো সাহেবদের ছোঁয়া লেগে গিয়েছে। আরও আগের, পাল-সেন ছেড়ে দিলেও অন্তত সুলতানি আমল, নিদেন মুঘল জমানার কিছুই কি দেখা যাবে না? এত সব বিখ্যাত রাজা-নবাব, তাঁদের কর্মকাণ্ডের কথা তো ঐতিহাসিকরা সবিস্তার শুনিয়েছেন। তাঁরা কেমন বাড়িতে থাকতেন জানতে ইচ্ছে করে না? খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, প্রান্তিক বাংলার এক প্রাচীন রাজ্যেই কেবল কোনও রকমে টিকে আছে একটুকরো রাজবাড়ি, যার কথা প্রায় সবাই ভুলে গিয়েছে।

এমনিতেই সারা বাংলায় এমন কোনও একটা শহর নেই যা বহু দিন ধরে কোনও সাম্রাজ্যের কেন্দ্র ছিল। নগরকেন্দ্রিক সংস্কৃতি যে এখানে গড়ে ওঠেনি তা নয়। যতই পাণ্ডববর্জিত হোক না কেন, মৌর্যযুগ থেকেই বাংলায় নগরায়ণের চিহ্ন সুস্পষ্ট। মহাস্থান-বাণগড়-চন্দ্রকেতুগড় ছাড়াও খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যে গোপচন্দ্র-ধর্মাদিত্য-সমাচারদেবের কোটালিপাড়া (বাংলাদেশের ফরিদপুর), শশাঙ্কের কর্ণসুবর্ণ, সমতট-রাজধানী দেবপর্বত (বাংলাদেশের কুমিল্লার ময়নামতী অঞ্চল) মোটের উপর চিহ্নিত করা গেছে। এ দিকে গোপাল থেকে মদনপাল পর্যন্ত অন্তত আঠেরো জন পালবংশীয় রাজার তাম্রশাসনে গোটা বারো ‘জয়স্কন্ধাবার’-এর উল্লেখ আছে। এগুলি কি নিতান্তই অস্থায়ী ‘বিজয়শিবির’, না প্রশাসনিক কেন্দ্র? বলা মুশকিল, কারণ এই বারোটার মধ্যে মুদ্গগিরি (মুঙ্গের) বা পাটলিপুত্র (পাটনা) ছাড়া সবই অচেনা। রামপালের রাজধানী ‘রামাবতী’র উচ্ছ্বসিত উল্লেখ আছে সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত কাব্যে, সে রামাবতী উত্তরবঙ্গের আমাতি হতেই পারে, কিন্তু মাটি না খোঁড়া পর্যন্ত নিশ্চিত ভাবে কিছু বলা কঠিন। চন্দ্র-বর্মণ-সেন রাজধানী বিক্রমপুর হয়তো অনেকটাই নদীগর্ভে হারিয়ে গিয়েছে। মুসলমান ঐতিহাসিকদের বিবরণীর লক্ষনৌতি (গৌড়ের কাছে) আর নওদিহ (নবদ্বীপ?) নাকি লক্ষ্মণসেনের সঙ্গে জড়িত, তবে এই শহর দুটির ইতিহাসও অস্পষ্ট। যেখানে রাজধানীর অবস্থান বোঝা গেছে, সেখানে আবার প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন এত ভাল ভাবে হয়নি যে বাড়িঘর কেমন ছিল তা বলা যাবে। তাই প্রাচীন বাংলার গুটিকয় রাজধানী পাওয়া গেলেও সেখানকার বাড়িঘর, বিশেষত রাজারাজড়ার বাড়ি সম্পর্কে আমরা যে তিমিরে সেই তিমিরেই থেকে গিয়েছি। সুলতানি আমলের রাজধানী, মালদহ জেলার গৌড়-পাণ্ডুয়া বরং অনেকটা পরিচিত। তবে পাণ্ডুয়ার প্রাসাদ এলাকায় আজও অনুসন্ধান হয়নি, কেবল দুটি হামাম বা স্নানাগারের কথা আমাদের জানা আছে। গৌড়ের প্রাসাদ এলাকায় আংশিক খোঁড়ার পর যে স্থাপত্যের ভিত পাওয়া গিয়েছে, তার চরিত্র এখনও স্পষ্ট নয়। বাংলায় মুঘল আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর রাজমহল-ঢাকা হয়ে মুর্শিদাবাদ বাংলার শেষ রাজধানী। রাজমহল বা ঢাকায় মুঘল আমলের প্রাসাদের চিহ্ন লুপ্তপ্রায়, আর মুর্শিদাবাদের এখনকার প্রাসাদ তো পুরোপুরি ঔপনিবেশিক স্থাপত্য। তা হলে? হাতে রইল সেই পেনসিল, অর্থাৎ বিষ্ণুপুর।

অবশ্য এখানে বাড়িঘর বিশেষ টিকে থাকার কথাও নয়। একে তো বাংলায় পাথর বিশেষ নেই বললেই চলে, ভাল পাথর আনতে হলে সেই রাজমহল থেকে, তাতে পড়তা পোষানো মুশকিল। পড়ে রইল বাঁকুড়া-মেদিনীপুরের ল্যাটেরাইট বা মাকড়া পাথর আর তা-ও না পাওয়া গেলে পোড়ামাটি, এ দুটোর উপর পঙ্খের প্রলেপ লাগিয়েই বাঙালি সূত্রধর শিল্পীরা যুগ যুগ ধরে মার্বেল ফিনিশকে টেক্কা দিয়েছেন। মন্দির-মসজিদ যদি বা কিছু রক্ষা পেয়েছে ধর্মীয় কারণেই, সাধারণ বাড়িঘর থেকে প্রাসাদ কিছুই বলতে গেলে বাঁচেনি। তবে মূল স্রোতের ইতিহাসের চাপে প্রান্তিক নানা ইতিহাস, চোখের সামনে থাকলেও, আশ্চর্যজনক ভাবে মনের আড়ালে চলে যায়। মধ্যযুগের মল্ল-রাজধানী বিষ্ণুপুরের ক্ষেত্রেও ঠিক সেটাই ঘটেছে।

বিষ্ণুপুরের গল্প তো সবারই জানা। হান্টার তাঁর অ্যানালস অব রুরাল বেঙ্গল বইয়ে (১৮৬৮) প্রথম বিষ্ণুপুরের রাজকাহিনি লিপিবদ্ধ করেন। সপ্তম শতকের শেষে বৃন্দাবনের কাছে জয়নগরের এক রাজার পুরুষোত্তম (পুরী) তীর্থযাত্রা, সদ্যপ্রসূত সন্তানসহ স্ত্রীকে বিষ্ণুপুরের জঙ্গলে রেখেই চলে যাওয়া, সেই সন্তানের (রঘুনাথ সিংহ বা আদিমল্ল) নানা অলৌকিক ঘটনার মাধ্যমে রাজ্য প্রতিষ্ঠা এই কাহিনির মূল কথা। আজ খোলা চোখে দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না, ‘বাগদি রাজা’ থেকে ক্ষত্রিয় ‘মল্লাবনীনাথ’ হয়ে ওঠার পথে এই গল্প তৈরি করা নিতান্ত জরুরি ছিল। তবে ষোড়শ শতাব্দীর শেষ এবং সতেরো শতকের সূচনায় অন্য কয়েকটি ঘটনাও ঘটছিল, যা এই গল্প সৃষ্টির সঙ্গে অঙ্গািঙ্গ জড়িত। ষোড়শ শতকের শেষেই মল্লরা জঙ্গলঘেরা নিরাপত্তার বেষ্টনী ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। অষ্টম থেকে ষোড়শ শতক পর্যন্ত মল্লদের বিবিধ পরাক্রমের ইতিবৃত্ত শুধু তাঁদের পারিবারিক বিবরণ নির্ভর। সুলতানি আমলে মল্লরা যে কখনও আক্রান্ত হননি, তা কি আক্রান্ত হওয়ার মতো পরাক্রম তাঁরা অর্জন করেননি বলেই? সত্যিই সীমান্তবর্তী মল্লরাজ্য এত ক্ষমতাবান হয়ে উঠলে সুলতানরা চুপচাপ বসে থাকতেন কি না সন্দেহ। প্রত্ননিদর্শন থেকে তো এই গৌরবের ছিটেফোঁটা সমর্থনও মেলে না। আফগান শাসনের অন্তিম পর্বে দেশজোড়া বিশৃংখলার সুযোগে মল্লরা ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সচেষ্ট হন, এটাই স্বাভাবিক। আবুল ফজলের আকবরনামা-য় প্রথম উল্লেখ পাই মল্লরাজ ধার হাম্বিরের, ১৫৮৬ নাগাদ তিনি মুঘল সম্রাটকে বার্ষিক কর দিতে সম্মত হন। এর মাত্র বছর দশেক আগে বাংলায় মুঘল অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বিদ্রোহী আফগানরা তখনও নির্মূল হয়নি, তাই মুঘলদেরও বাংলার সীমান্তে প্রয়োজন ছিল শক্তিশালী সহযোগীর। বীর হাম্বির ১৫৯১-এ কতলু খাঁ-র হাত থেকে বাঁচিয়ে দিলেন মানসিংহের ছেলে জগৎ সিংহকে। আকবরনামা-য় তিনি জমিদারমাত্র। এর পর মল্লরাজারা মুঘলদের কাছে আদায় করে নিতে পেরেছিলেন সম্মানজনক নানা অধিকার— বংশানুক্রমিক রাজত্ব, দুর্গ ও কামান তৈরি তার মধ্যে প্রধান।

শুধু ক্ষমতা পেলেই হবে না, সংস্কৃতিতেও কল্কে পেতে হবে। বিষ্ণুপুরের সংস্কৃতি বলতে তো লৌকিক সংস্কৃতি। ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি অবশ্য আগেই রাজ-আনুকূল্য পেয়েছে, ‘বিষ্ণুপুর’ নামেই তা স্বপ্রকাশ, রাজসভায় নিয়মিত ‘ভাগবত’ পাঠও হত। কিন্তু ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বাঁধাবাঁধির মধ্যে সদ্য ক্ষত্রিয় হয়ে ওঠা রাজার খুব নড়াচড়ার সুযোগ ছিল না, নিম্নবর্গীয় প্রজাদের শামিল করা তো দূর অস্ত। শ্রীনিবাস আচার্য যেন ঠিক সময় বুঝেই বৃন্দাবন থেকে রওনা দিলেন বাংলায় গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য। বিষ্ণুপুরের জঙ্গল পেরোতে গিয়ে ডাকাতদল লুঠ করল শ্রীনিবাসের পুথিভর্তি পেটিকা, আর কী আশ্চর্য, সেই ডাকাতরাও বীর হাম্বিরের পাঠানো! এত বড় রাজাকে কেন যে নিজের রাজ্যের মধ্যেই দূর-দূরান্তের যাত্রীদের উপর ডাকাতি করতে হত, সেটা খুব বিস্ময়ের। সে যাই হোক, শ্রীনিবাস পুথির খোঁজে বিষ্ণুপুর এলেন, এবং শেষে বীর হাম্বিরকে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত করলেন। ঘটনাটা আসলে যে ভাবেই ঘটে থাক, গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম রাজার প্রত্যাশিত পথ খুলে দিল, তৈরি হল নতুন জনসংস্কৃতি। এক দিকে একের পর এক মন্দির তৈরি করে নিত্য ভোগ, পুজো আর সংকীর্তনের মাধ্যমে রাজ্যের সাধারণ মানুষ আর তীর্থযাত্রীদের টেনে নিয়ে আসা, অন্য দিকে ব্রাহ্মণদের নিষ্কর জমি দিয়ে বসতি করিয়ে সাংস্কৃতিক অভিজাতশ্রেণী প্রতিষ্ঠায় মল্লরাজারা সাফল্য পেয়েছিলেন। আর জঙ্গলে ঘেরা হলেও বিষ্ণুপুরের অবস্থান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পথের উপর— ওড়িশা থেকে বৃন্দাবন তথা উত্তর ভারতের প্রধান যোগসূত্র। এই সূত্র ধরেই গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের মতো উত্তর-ভারতীয় দরবারি সংস্কৃতি যে সতেরো শতকে মল্ল রাজসংস্কৃতির অন্যতম প্রধান উপাদান হয়ে উঠেছিল, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু মল্লরাজারা শিকড় থেকে সরে আসেননি। ধ্রুপদ সংগীত, গঞ্জিফা (দশাবতার) তাস, দরবারি পরিচ্ছদ (এবং নিশ্চয়ই আদবকায়দাও) যেমন এল, তেমনই স্থাপত্যে তৈরি হল সম্পূর্ণ নিজস্ব শৈলী। তা হলে তাদের রাজপ্রাসাদ তৈরির ক্ষেত্রেও মুঘল প্রভাবের সঙ্গে স্বকীয় চিন্তার ছাপ থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু কেমন ছিল সেই প্রাসাদ? বিষ্ণুপুর সংক্রান্ত কোনও বইতেই প্রচলিত গল্প ছাড়া রাজপ্রাসাদের আসল চেহারা সম্পর্কে কোনও তথ্য নেই। অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারে চারটি মিনার সহ এই প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের কথা সংক্ষেপে উল্লেখ করেছেন, কুমকুম চট্টোপাধ্যায় এর কথা বলেছেন মল্ল-মুঘল সংযোগের প্রাসঙ্গিক প্রমাণ হিসেবে। বিষ্ণুপুরের অধিকাংশ পুরাকীর্তি যাদের দায়িত্বে, সেই ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের বই এ প্রসঙ্গে একদম নীরব। তার মানচিত্রে পর্যন্ত এর কোনও উল্লেখ নেই।

তবে এখনও এই প্রাসাদের চেহারা চোখে দেখা সম্ভব। রাজপরিবারের কুলদেবী মৃন্ময়ীর মন্দিরের (এটিকেও আধুনিক নির্মাণ বলে তাচ্ছিল্য করার কারণ নেই, এর ভিতরের অংশ সম্ভবত সতেরো শতকের চিহ্ন বহন করছে) পশ্চিমে আছে সুগভীর এক দিঘি, তারও পশ্চিমে বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে এখনও ছড়িয়ে আছে প্রাচীন প্রাসাদের অবশেষ, যার অনেকটাই গাছপালায় ঢাকা। সম্প্রতি বাঁকুড়ার আঞ্চলিক ইতিহাস অনুসন্ধানী জয়দীপ মুখোপাধ্যায় এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করায় সেটি খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ হয়। বিস্তৃত পাঁচিল ঘেরা দুর্গের মধ্যে আবার পাঁচিল ঘেরা প্রাসাদ, তার মধ্যে বসবাসের অংশটি উত্তর-দক্ষিণে অন্তত ৬১ মিটার ও পূর্ব-পশ্চিমে ৪১ মিটার, অর্থাৎ প্রায় ২৫০০ বর্গমিটার এলাকা জুড়ে। এই বাড়ির চার দিকে ত্রিশ ফুট উঁচু পাঁচিল ছিল, তার মধ্যে শুধু দক্ষিণের পাঁচিল আজও অটুট। দক্ষিণেই আছে খুব সংকীর্ণ এক প্রবেশপথ, অন্য কোনও দিকে পাঁচিল না থাকায় আসল প্রবেশপথ আর বোঝা যাচ্ছে না। এই আয়তাকার প্রাসাদের চার কোণে চারটি বর্গাকার মিনার আজও টিকে আছে, উত্তরের মিনার দুটি তিন তলা, দক্ষিণ-পশ্চিমেরটি চার তলা এবং দক্ষিণ-পূর্বেরটি পাঁচ তলা। মাঝখানে সম্ভবত ছিল খোলা চত্বর, চার পাশে দোতলা দালান। মিনারের দেওয়ালে আর দক্ষিণের পাঁচিলে দোতলা পর্যন্ত সারি সারি বরগার চিহ্ন রয়েছে, তা থেকেই বোঝা যায় বসবাসের ঘর অন্তত দোতলা ছিল। সর্বত্র বরগা খুলে নেওয়ার ফলে ছাদ ভেঙে পড়েছে, লুঠ হয়ে গিয়েছে ইট। মিনার চারটি আর এক দিকের পাঁচিল কোনও ক্রমে দাঁড়িয়ে আছে, তবে বট-অশ্বত্থের আক্রমণে তাদের দশাও শোচনীয়। দক্ষিণ-পুবের মিনারের পাঁচতলার ঘরটিকে ‘হাওয়া মহল’ বলেন স্থানীয় মানুষ, রাজপুত প্রাসাদের খোলা ছত্রীর বাঙালি সংস্করণ তাকে বলা যেতেই পারে। মিনারের গড়নে নানা রীতির মিশেল আছে, একটির ভিতরের দেওয়ালে মুঘল শৈলীর অলংকরণ রূপায়িত হয়েছে পঙ্খের কাজে। প্রাসাদের পুব দিকে দিঘিতে যাওয়ার পথও পাঁচিল ঘেরা ছিল, ঘাটে নামার সংকীর্ণ ও ঢাকা পথ দেখলেই বোঝা যায় তা একেবারেই রাজ-অন্তঃপুরের ব্যবহারের জন্য। সব মিলিয়ে দুর্গের মধ্যে প্রাসাদ-দিঘি-কুলদেবীর মন্দির যে একটি সুরক্ষিত অঞ্চল হিসেবে শুরুর দিকেই পরিকল্পিত হয়েছিল তা স্পষ্ট। প্রাসাদ চত্বরে জঙ্গল পরিষ্কার করে কিছুটা খুঁড়ে না দেখলে ঘরবাড়ির সঠিক বিন্যাস বোঝা সম্ভব নয়। তবে এটুকু নিশ্চিত যে এমন প্রাসাদের অস্তিত্ব বাংলায় আর দ্বিতীয়টি নেই।

কোন রাজার সময় এ প্রাসাদ তৈরি? মল্লরাজ দ্বিতীয় বীর সিংহ (১৬৫৬-১৬৭৭) নাকি বর্তমান দুর্গ তৈরি করেন, আর বিষ্ণুপুরের আটটি বাঁধও তাঁরই সময় কাটা হয়। আর দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহের আমল (১৬৯৪-১৭২০) বিষ্ণুপুরের শেষ গৌরবের যুগ, লালবাইয়ের গল্প তাঁকে নিয়েই। রঘুনাথের পর এত বড় প্রাসাদ তৈরির ক্ষমতা আর কোনও মল্লরাজার ছিল বলে মনে হয় না। স্থাপত্য বিচারেও এই প্রাসাদকে সতেরো শতকের পরে টেনে আনা কঠিন। দীর্ঘ অবহেলা বাংলার অসামান্য এই পুরাকীর্তিকে অবলুপ্তির পথে ঠেলে দিয়েছে। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় বিষ্ণুপুরকে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা চলছে অনেক দিন ধরেই। পরিচিত মন্দিরগুলির বাইরে এই নজিরবিহীন স্থাপত্যকীর্তিটি কি সেই সুবাদে কোনও রক্ষাকবচ পাবে?

তথ্য সহায়তা: জয়দীপ মুখোপাধ্যায়, শেখর ভৌমিক, রজত সান্যাল।

Indrajit chowdhury royal house west bengal history patna bankura midnapore
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy