Advertisement
E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু

মতুয়া বিষয়ে কিছু সওয়াল জবাব

শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৪ ০০:০০

মতুয়া বিষয়ে কিছু সওয়াল জবাব

গৌতম চক্রবর্তীর লেখা (‘মতুয়া: শুধু শোরগোল...’, ১৫-০৫) পড়লাম। এই প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলতে চাই।

অনুন্নত হিন্দু জাতির প্রাণপুরুষ হরিচাঁদ ঠাকুর বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ সাব ডিভিশনের অন্তর্গত সাফলিডাঙা নামক একটি প্রত্যন্ত গ্রামে জন্মেছিলেন। ‘সাফলডাঙা’ নয়। সাফলিডাঙা গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রাম হল ওড়াকান্দি। ওড়াকান্দি গ্রামের পূর্ব প্রান্তে শ্বেতপাথরের মন্দির, নাটমন্দির, কামনাসাগর (পুকুর) ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে এখানে বড় মেলা বসে। বেশ কয়েক দিন ধরে মেলা চলে। মেলার স্থানীয় নাম হল বারুণী। বর্তমানে উত্তর চব্বিশ পরগনার ঠাকুরনগর পুণ্যভূমি হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে।

মতুয়ারা এক ধরনের ‘বৈষ্ণব’ও নয়, কিংবা মতুয়া নিম্নবর্গের/বর্ণের অর্থাত্‌ নমশূদ্র সম্প্রদায়ের কোনও ধর্মও নয়। মতুয়া হল, যারা ডঙ্কা আর শিঙা বাজাতে বাজাতে নিশান উড়িয়ে বিভিন্ন সাজে সজ্জিত হয়ে প্রাণপুরুষ হরিচাঁদ এবং গুরুচাঁদ ঠাকুরের পাদপদ্মে অন্তরের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের জন্য মাতোয়ারা হয়ে দলে দলে পুণ্যভূমি ঠাকুরনগর মতুয়া মেলায় উপস্থিত হয়। তাঁদের প্রত্যেকেকে আলাদা আলাদা ভাবে মতুয়া বলে। আর গোটা দলটাকে বলে, মতুয়ার দল। তাঁরা হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান যে কোনও সম্প্রদায়েরই হতে পারেন। মতুয়াদের মধ্যে কোনও গোঁড়ামি নেই। সকল সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে যে ভক্তিরসের প্লাবন দেখা যায়, সেটা অত্যন্ত প্রশংসনীয়।

উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার অন্তর্গত বনগ্রামের সন্নিকটবর্তী হেলেঞ্চা উচ্চবিদ্যালয়ের খেলার মাঠে প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে মতুয়া মহাসম্মেলন হয়। হিন্দু (ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য) মুসলমান, খ্রিস্টান বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লক্ষ লক্ষ ভক্ত, যাঁরা মতুয়া নামে পরিচিত, তাঁরা ডঙ্কা এবং শিঙা বাজাতে বাজাতে নিশান উড়িয়ে মতুয়া মহাসম্মেলনে আসেন। মতুয়া মহাসম্মেলনে মহাপুরুষ হরিচাঁদ ঠাকুর এবং গুরুচাঁদ ঠাকুরের মাহাত্ম্য নিয়ে জ্ঞানগর্ভ মনোগ্রাহী আলোচনা হয়। ভক্ত মতুয়ারা ঋদ্ধ হন। জীবন পথের দিশা খুঁজে পান।

প্রতি বছর পুণ্যভূমি ঠাকুরনগরে যে মতুয়া মেলা এবং হেলেঞ্চায় যে মতুয়া মহাসম্মেলন সম্পন্ন হয়, তা হল প্রকৃতপক্ষে অনুন্নত হিন্দু জাতির নিজস্ব ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি।

অপূর্বকুমার বিশ্বাস। কলকাতা-৩০

¶ ২ ¶

গৌতম চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘মতুয়া মেলায় দেখেছিলাম, নিশান উড়িয়ে ডঙ্কা বাজাতে বাজাতে ভক্তরা যখন ঝাঁপিয়ে পড়ছেন জলে। এই ভাবে কাড়ানাকাড়া বাজানো দুনিয়ার সর্বত্র কৃষক বিদ্রোহের লক্ষণ। ডঙ্কা বা শিঙা মানেই সামন্ততান্ত্রিক সমাজে নতুন এক ক্ষমতার জয় ঘোষণা: আমি এসে গিয়েছি’। তাই কী?

মতুয়ারা যে লাঠি, শিঙা, জয়ডঙ্কা, নিশান নিয়ে মিছিল করেন তার মূলে আছে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৯২৩ সালে ফরিদপুর জেলার ওড়াকান্দি গ্রামের কাছে ছিল পদ্মবিল নামে এক বিল। ওড়াকান্দি গ্রাম হিন্দুপ্রধান। পাশের গ্রামটি মুসলমানপ্রধান। এই পদ্মবিলে মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে কয়েক জন হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে প্রথমে বচসা ও পরে মারামারি হয়। ঘটনা এখানেই শেষ হয় না। পরের দিন মুসলমানরা হিন্দু গ্রাম আক্রমণের জন্য তৈরি হয়।

খবর শুনে ওড়াকান্দির শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুর চিন্তায় পড়েন। সে দিন ছিল মতুয়া ধর্মমতের প্রবর্তক শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মদিন। ওই দিন ওড়াকান্দিতে বারুণীর স্নান ও মেলা বসত। তাই মতুয়া ধর্মাবলম্বী বহু নমশূদ্র সে দিন ওড়াকান্দিতে সমবেত হয়েছিলেন। গুরুচাঁদের নির্দেশে বহু মতুয়া মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। সে দিন যাঁরা গুরুচাঁদ ঠাকুরের কাছে হিন্দুদের সুরক্ষার জন্য অঙ্গীকার করেন, ঠাকুর তাঁদের হাতে একটি করে লাঠি তুলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আজ থেকে এই ডঙ্কার নাম হল জয়ডঙ্কা’।

উজ্জ্বলকুমার মণ্ডল। শেওড়াফুলি, হুগলি

প্রতিবেদকের উত্তর:

অপূর্ববাবুর চিঠির উত্তরে জানাই:

১) হরিচাঁদের জন্মস্থান হিসেবে সাফলিডাঙা, সাফলাডাঙা এবং সফলডাঙা তিনটি শব্দই প্রচলিত। ছাপাখানা আসার আগে, বাংলা ভাষায় স্থানীয় জায়গার নাম এ রকম বহু ভাবে উচ্চারিত হয়েছে। যথা, শিয়ালদহ, শেয়ালদহ ও শ্যালদা-র মধ্যে পরে একটিকে স্ট্যান্ডার্ডাইজ করা হয়েছে। পয়ার ছন্দে লেখা, প্রামাণ্য ‘শ্রীহরিলীলামৃত’র বয়ান: ‘ফরিদপুর জিলামধ্যে সাফলাডাঙায়/ পঞ্চ ভ্রাতা জন্মিলেন এসে এ ধরায়।।’ সাফলাডাঙা, সফলডাঙা মায় ‘বঙ্গদেশে ধন্য গ্রাম সাফলানগরী’ও আছে তাতে। সাফলিডাঙা নেই।

২) ডঙ্কা বাজিয়ে মতুয়া মেলায় গেলেই মতুয়া? তা হলে ‘হরি নাম সার/প্রেমেতে মাতোয়ারা মতুয়া নাম যার’ লাইন দুটি লিখলেন কেন হরিলীলামৃত-র লেখক তারকচন্দ্র সরকার? হরিচাঁদ আগে তাঁর ধর্মের কথা বলেছেন, পরে মেলার মাধ্যমে সেই প্রতিবাদী ধর্ম সংগঠিত হয়েছে।

৩) হরিচাঁদ হরিনামের কথা বলছেন। শ্রীচৈতন্য যে পরজন্মে হরিচাঁদ হয়ে জন্মাচ্ছেন, তা নিয়েও হরিলীলামৃত বইয়ে নানা মিথ। তা হলে ‘মতুয়া এক ধরনের বৈষ্ণব’ বলতে আপত্তি কী? নমশূদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যেই এই ধর্মের উত্থান। পরে অবশ্যই স্থানীয় মুসলমান এবং খ্রিস্টানরা অনেকে এই সম্প্রদায়ভুক্ত হয়েছেন। নামগানের ধর্মে হিন্দু বনাম মুসলমান থাকে না। শ্রীচৈতন্যের প্রধান শিষ্য যবন হরিদাস তার প্রমাণ।

উজ্জ্বলকুমার মণ্ডলের চিঠির উত্তরে জানাই:

১) জয়ডঙ্কা শব্দটি বহু আগে থেকেই প্রচলিত। ১৯২৩ সালে গুরুচাঁদ ঠাকুর ওটি সৃষ্টি করেননি।

২) সপ্তদশ, অষ্টাদশ শতকে পেরু বা স্পেনের মতো যে সব দেশে কৃষক বিদ্রোহ হয়েছে, এ ভাবেই ডঙ্কা বাজানো হয়েছে। স্পেনের লোকেরা হরিচাঁদকে চিনতেন বা হরিচাঁদ স্পেনের কথা জানতেন এমন নয়। কিন্তু সামন্ততান্ত্রিক সমাজে কতকগুলি লক্ষণ ঠিক চেনা যায়। দেশ, কালের মধ্যে ব্যবধান সত্ত্বেও।

৩) ১৯২৩ সালে পদ্মবিলের ঘটনাটি প্রসঙ্গে বলি, সেখানে টানা তিন বছর, ১৯২৬ সাল অবধি নমশূদ্র বনাম স্থানীয় মুসলমানদের দাঙ্গা হয়। দাঙ্গা মানে, গরুচুরি নিয়ে মারপিট। তা থেকেই কবিগান তৈরি হয়ে গেল, ‘গুরুচাঁদ আগুয়ান সম্মুখ সমরে/ মুসলমান নির্বংশ করিবার তরে।’ অথচ, ওড়াকান্দিতে তখন নমশূদ্র-মুসলমান সকলে বসে এই গান শোনে, একই হাটে বিকিকিনি করতে যায়। মিথ চিরকাল এ রকম ভাবেই তৈরি হয়! গরুচুরির মারপিটকেও সে বর্ণহিন্দুর ক্ষাত্রধর্মে পরিণত করে। স্নানযাত্রা আর বিজয়যাত্রা একাকার হয়ে যায়।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy