একটা ঘুমের ওষুধ বলবি বাবা? প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেল ছেলেটা ঘুমোয়নি ঠিক করে, পড়াশুনোও তো করতে পারছে না কিছুই।’ পাড়ার এক কাকুর ফোন। আমাকে যতটা স্নেহ করেন, আমি প্রায় তার কাছাকাছিই স্নেহ করি তাঁর ছেলে প্রবীরকে— এ বছর রাজ্যের ছিয়াত্তর হাজার জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার্থীর এক জন। পাড়াতেই ছোট্ট দোকান বাবার, ছেলে স্বপ্ন দেখে স্টেথো গলায় ঝুলিয়ে পাড়ার সবার জন্য ওষুধ লিখবে এক দিন। মাঝে মাঝেই নানান টিপস দিতাম ওকে। খুব খাটছিল, প্রস্তুতিও বেশ ভাল। এই সে দিনও হেসে বলেছিল, ‘দাদা, সতেরো তারিখ জয়েন্ট আর উনিশ তারিখ ভোটের রেজাল্ট, জীবনটা একই থাকবে না কিছু পরিবর্তন হবে, দেখাই যাক।’
আমি আর ওকে বলতে পারিনি, একটা লড়াইয়ের জন্য সর্বোচ্চ মাত্রায় প্রস্তুতি ও যোগ্যতা থাকলেও সব সময় আমরা জিততে পারি না। তার কারণটাকে মাথা নাড়িয়ে চুকচুক করে মোটা দাগে কিছু জন ‘ভাগ্য’ বলেন আজও। অন্যান্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মতোই জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষাও দাবি করে সর্বোচ্চ মাত্রার প্রস্তুতি ও পারদর্শিতা। জয়েন্টে একটা নম্বরের জন্য প্রায় পঞ্চাশ র্যাঙ্কের হেরফের হয়ে যায়, ক্ষেত্রবিশেষে একশো। আবার, মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক আর জয়েন্ট— পরীক্ষা হিসেবে এক গোত্রভুক্তও নয়। প্রশ্নের ধরন, পরীক্ষা দেওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি, সবই আলাদা। সেই দৃষ্টিভঙ্গি আয়ত্ত করে, সর্বোচ্চ মাত্রায় প্রস্তুতি নিয়েও আজ প্রবীর এবং তার মতো অসংখ্য ছাত্রছাত্রী জয়েন্ট নামক দৈত্যটার সঙ্গে লড়াইয়ের আগেই আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে, গত দেড় মাসের চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন খেলার পুতুল হওয়ার শেষে অ্যালপ্রাজোলাম খুঁজছে একটু ঘুমনোর জন্য। তার কারণ, এ দেশের অন্যান্য বিভিন্ন ক্ষেত্রের মতোই, জয়েন্টের ক্ষেত্রেও নীতিনির্ধারকদের খামখেয়ালিপনা, দূরদর্শিতার অভাব।
২০১২’তে ডাক্তারি প্রবেশিকার ক্ষেত্রে সারাদেশব্যপী অভিন্ন ‘ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি অ্যান্ড এন্ট্রান্স টেস্ট’, সংক্ষেপে ‘নিট’ পরীক্ষার কথা ঘোষণা করা হয়। যুক্তি প্রধানত দুটি। এক, ছাত্রদের অনেকগুলি এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিতে প্রস্তুতির ক্ষেত্রে এবং আর্থিক ভাবে যে অসুবিধা হয় তা দূর করা এবং দুই, ছাত্র ভর্তির নামে বিভিন্ন প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজগুলির কোটি কোটি টাকার ব্যবসা বন্ধ করা। কিছু রাজ্য এবং মূলত প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজগুলির বিরোধিতার কারণে সে বার নিট হয়নি। ২০১৩’তে প্রথম নিট হয়, পরীক্ষা নেয় সিবিএসই বোর্ড। প্রশ্নপত্র হয় ইংরেজি এবং হিন্দি, এই দুটি ভাষায়।
এ রাজ্যের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে খোঁজ নিলে দেখা যাবে, ২০১৩’তে ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে জেলার বাংলা মাধ্যমের ছাত্রের সংখ্যাটা হাতে গোনা। অনেক আগে থেকে জানা সত্ত্বেও বোর্ডভিত্তিক সিলেবাসের আকাশপাতাল পার্থক্য ও ভাষার সমস্যার জন্য সেই ছাত্রছাত্রীরা কেউই বিশেষ কিছু করে উঠতে পারেনি। তাদের প্রস্তুতি বা যোগ্যতার খামতি ছিল না, কিন্তু যেই নীতিনির্ধারকেরা বলে দিলেন ‘এইটাই হবে’ এবং কিছুতেই বলে দিলেন না ‘এইটা কী ভাবে হবে’, তখনই তাদের প্রস্তুতির সংজ্ঞা পাল্টে গেল, যোগ্যতার মাপকাঠি বদলে গেল। যে ছেলেটা শেষ পনেরো বছর মাতৃভাষায় পড়ে এসেছে তার কাছে যোগ্যতার নতুন মাপকাঠি হয়ে গেল ইংরেজি ভাষায় দখল, যে মেয়েটা শেষ দু’বছর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকের বইগুলি পড়েছিল তার কাছে প্রস্তুতির নতুন সংজ্ঞা হল সম্পূর্ণ অন্য সিলেবাস ভিত্তিক এনসিইআরটির বইগুলো মলাট থেকে মলাট পড়ে ফেলা। কিন্তু বিশ্বাস করুন, এটা কোনও তিন মিনিটে তীব্র বশীকরণ এবং সকল সমস্যা সমাধানের ভণ্ড শো নয়, এটা জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা। ব্যক্তিগত স্তরে একটা ছেলে বা মেয়ের ডাক্তার হয়ে ওঠা ছাড়াও যার সঙ্গে ভবিষ্যতে একটা সমাজ এবং তার মানুষের স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রশ্ন জড়িয়ে থাকে।
১৯১৩’র জুলাইতেই সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতি আলতামাস কবীরের বেঞ্চ ‘অসাংবিধানিক’ আখ্যা দিয়ে নিট বাতিল করে। কারণ তা বিভিন্ন রাজ্য এবং সংখ্যালঘু বা ভাষাভিত্তিক সংরক্ষিত কলেজগুলির ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করে। তার পর গত দু’বছর ধরে সর্বভারতীয় পিএমটি পরীক্ষার পাশাপাশি রাজ্য মেডিক্যাল জয়েন্টও হয়েছে। এ বছরও ঠিক ছিল পয়লা মে হবে সর্বভারতীয় পিএমটি, সতেরোই মে রাজ্য জয়েন্ট এন্ট্রান্স। হঠাৎ ১১ এপ্রিল মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট রায় দিলেন, তাদেরই নেওয়া নিট বাতিলের সিদ্ধান্তটিকে আবার বাতিল করে ফিরিয়ে আনা হবে সর্বভারতীয় এক ও অভিন্ন নিট। কোনও রাজ্য বা প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ বা সংরক্ষিত কলেজ আর আলাদা করে পরীক্ষা নিতে পারবে না। প্রবীরেরা এক ঝটকায় মাঝদরিয়ায়। পরবর্তী কাহিনি স্মৃতিতে তাজা। নাগরদোলার বিস্তর ওঠানামার পরে আপাতত এক বছরের জন্য ‘বাধ্যতামূলক নিট’-এর ওপর জারি হয়েছে স্থগিতাদেশ। রাজ্যগুলি নিজস্ব সরকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির জন্য রাজ্য জয়েন্ট এন্ট্রান্স নিতেই পারে, যদিও বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজকে ছাত্র ভর্তি করতে হবে নিটের মাধ্যমেই।
পরীক্ষার ঠিক আগে অনিশ্চয়তা আর জটিলতার মেগাসিরিয়াল এবং চূড়ান্ত মানসিক চাপের কথা ছেড়ে দিলেও কয়েকটা প্রশ্ন উঠে আসছে। নিট-এর স্বপক্ষে প্রধান যুক্তিগুলির দিকে তাকালে দেখি, এ রাজ্যে তথা এ দেশে হাতে গোনা ছেলেমেয়ে রাজ্য জয়েন্টের বাইরে অন্য পরীক্ষা দেয়। তার একটা কারণ, রাজ্য বোর্ডের সঙ্গে রাজ্য জয়েন্টের সিলেবাসের অভিন্নতা, দ্বিতীয় কারণ ভাষা এবং শেষ কারণ ডাক্তারি পড়ার ইচ্ছে থাকলে নিজ রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজগুলিতেই পড়া যায়। সিবিএসই বোর্ড নিয়ন্ত্রিত, শুধুমাত্র ইংরেজি আর হিন্দি ভাষায় হওয়া নিট শেষ পর্যন্ত গ্রামের কোন বাংলা মাধ্যমের ছেলেটার স্বার্থের কথা বলছে? এর পরে ভবিষ্যতের প্রবীরের বাবারা ব্যবস্থা করবেন দোকানটা বেচেও ছেলেকে যেন ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ানো যায়। স্কুলের যেটুকু ভূমিকা আছে, নষ্ট হবে সেটুকুও, ভিড় বাড়বে কাগজে ছবি বেরনো নামকরা কোচিং সেন্টারের দরজায় যেখানে লক্ষ টাকার বিনিময়ে স্বপ্ন তৈরি হয়। ডাক্তার তৈরি হবে, কিন্তু তৈরি হবে শহরের হাজার স্কোয়ার ফিট থেকে, শহরেরই হাজার স্কোয়ার ফিটের জন্য।
আর দ্বিতীয় যুক্তি? বেসরকারি কলেজগুলোয় যারা ডাক্তারি পড়তে যায় তারা ডোনেশনের অঙ্কটা জেনে তবেই যায়। অসাধু চক্র ভাঙার উদ্যোগটি যথেষ্ট হাততালি কুড়োলেও নিট দিয়ে সেটা কতটা আটকানো যাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। প্রসঙ্গত, ২০১৩’তে নিট হওয়ার বছরেই খবরের শিরোনামে আসে ব্যপম কেলেঙ্কারি। বেসরকারি কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে দুর্নীতির শেকড়টা কত দূর বিস্তৃত, দেখেছিলাম সে দিনই।
শহরের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের, পাঁচখানা প্রাইভেট টিউটর থাকা, বড় কোচিং সেন্টারে সাপ্তাহিক মক টেস্ট দেওয়া ছেলেটার কাছে জয়েন্ট হল ঝাঁ-চকচকে কেরিয়ার গড়ার পরীক্ষা, মুকুটে আর একটা পালক গোঁজার পরীক্ষা। কিন্তু গ্রামের অনেক প্রবীরের কাছে জয়েন্টটা একাধারে স্টেথোর স্বপ্ন এবং জীবনযুদ্ধে বেঁচে যাওয়ার একমাত্র পরীক্ষা। কলকাতায় কেউ জয়েন্ট না পেলে ভেসে যায় না, গ্রামে পরিবারসুদ্ধ যায়। ভবিষ্যতের সমাজে কোন ডাক্তারেরা ডাক্তারি করবেন আর কারা স্বাস্থ্য পরিষেবা পাবে— জয়েন্টটা সেই পরীক্ষাও বটে। ডালভাত আর বিরিয়ানির পার্থক্যটা আর কেউ বুঝতে শিখুক না-শিখুক, এ দেশের নীতিনির্ধারকরা বুঝবেন। নিটের পথ থেকে স্থায়ী ভাবে সরে আসেননি তাঁরা, ভবিষ্যতের জন্য রাস্তা খোলাই আছে। প্রবীরদের লড়াইটা শুধু এমসিকিউ-এর পাঠে নয়, নীতিহীনতার মাঠেও। বাইশে শ্রাবণের শেষ দৃশ্যের জন্য প্রবীরদের জন্ম নয়।
কেন্দ্রীয় সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক