Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ৩

আলোচনা হোক সব মুসলমানের সঙ্গে

ধর্মের অপব্যবহার থেকে জন্ম নেওয়া সন্ত্রাসের মোকাবিলা কেবল রাষ্ট্রের কাজ হতে পারে না। পরিবার এবং সমাজের মধ্যে থেকে তৈরি হতে হবে সন্ত্রাস রোখার সচেতনতা।প শ্চিমবঙ্গের পশ্চিম প্রান্তে এক মফস্‌সল শহরে ইদের জামাত। আটটাতে নমাজ শুরু। মানুষজন এসে বসতে শুরু করেছেন। ইমাম সাহেবও হাজির। তিনি তাঁর নিজের মতো করে দ্বীন এবং দুনিয়া সম্পর্কে কথা বলা শুরু করেছেন।

‘কল্যাণ হোক’। আরব সাংস্কৃতিক সংগঠনের শান্তি মিছিল। মাদ্রিদ, স্পেন। গেটি ইমেজেস

‘কল্যাণ হোক’। আরব সাংস্কৃতিক সংগঠনের শান্তি মিছিল। মাদ্রিদ, স্পেন। গেটি ইমেজেস

তাজুদ্দিন আহ্‌মেদ
শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

প শ্চিমবঙ্গের পশ্চিম প্রান্তে এক মফস্‌সল শহরে ইদের জামাত। আটটাতে নমাজ শুরু। মানুষজন এসে বসতে শুরু করেছেন। ইমাম সাহেবও হাজির। তিনি তাঁর নিজের মতো করে দ্বীন এবং দুনিয়া সম্পর্কে কথা বলা শুরু করেছেন। মাইকের হাত ধরে সেই সব কথা ভেসে চলেছে অনেক দূরে; মাঠের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা শিবমন্দির ছুঁয়ে ঢুকে পড়ছে আশপাশের বাড়ির অন্দরে। বয়সে তরুণ ইমাম প্রতি বারের মতো বলে চলেছেন সততার পথে চলার কথা, রোজা রাখার প্রয়োজনীয়তার কথা। হালকা চালে সতর্ক করছেন তরুণদের, তারা যেন রমজান মাসের সব নিয়ম ত্যাগ করে সিনেমা হলে লাইন না দেয়।

আমি অপেক্ষা করছি কখন ইমাম সাহেব বলবেন সেই সব কথা— তিক্ত, রুক্ষ এবং প্রয়োজনীয়। আমার চোখের সামনে চাপ-চাপ রক্ত, সাইরেনের আওয়াজ, সন্তানহারা মায়ের মুখ, বাংলাদেশ, ইস্তানবুল, বাগদাদ, সিরিয়া, প্যারিস, মদিনা। ইমাম সাহেব শেষ ভাগে এসে সংক্ষেপে বললেন, কিছু মুসলমানের অমুসলমানোচিত আচরণের ফলে আজ ইসলাম সন্ত্রাসের সঙ্গে সমার্থক, যা কাম্য নয়। আমি চাইছি আরও কথা হোক, আরও কথা হওয়া জরুরি। বাড়ি ফেরার পথে শুনতে পেলাম, পাশের ইদগাহ থেকে ভেসে আসছে আর এক ইমাম সাহেবের কণ্ঠ: ‘জিহাদ মানে অস্ত্র হাতে নেওয়া নয়। এই যে রমজান মাসে সমস্ত ইচ্ছা, সমস্ত লোভের সঙ্গে আপনারা লড়াই করে আল্লাহ্‌র পথে চলেছেন, এই হল জিহাদ।’

বুঝতে পারলাম কথোপকথন চলছে; বুঝতে পারলাম আশা রয়েছে অন্ধকার এই সময় পার করে ফেলার। পরে নানা সংবাদমাধ্যমে যখন জানতে পারলাম যে, বিশ্বের নানা প্রান্তে ইদের জামাতে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে স্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন নিন্দা উচ্চারিত হয়েছে, সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমান নমাজের পর মিছিল করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন পৈশাচিক নরহত্যার, বুঝলাম আমার আশা অবাস্তব নয়।

প্রশ্ন উঠতে পারে, ধর্মীয় জমায়েতে এই আলোচনা এবং নিন্দার মধ্যে কি কোনও আশার আলো আছে? সন্ত্রাস তো ধর্মের বেশ ধরেই আঘাত হেনে চলেছে। সে ক্ষেত্রে সাধারণ যুক্তি অনুসারে ধর্ম এবং ধর্ম-সংক্রান্ত আচরণ সমূহের গুরুত্ব হ্রাসের মাধ্যমেই তো জনজীবন থেকে সন্ত্রাসের ছায়া দূর করার চেষ্টা করা উচিত। অন্তত পশ্চিমি ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা তো সেই শিক্ষাই দেয়।

এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে মুসলমান সমাজে, বিশেষত তরুণদের মধ্যে ধর্মান্ধতাপ্রসূত সন্ত্রাসবাদের বিস্তার নিয়ে কয়েকটি কথা জানা দরকার। সরলীকরণের ঝুঁকি নিয়েও বিষয়টিকে কারণ ও প্রতিকার, এই দু’ভাগে ভাগ করে নিলে হয়তো আলোচনার সুবিধা হতে পারে। ভাগ দু’টি কোনও ভাবেই পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। কারণের মধ্যেই রয়েছে প্রতিকারের বীজ। প্রথমত, মুসলিম সমাজে সন্ত্রাসবাদ বিস্তারের কারণ হিসেবে অনেক সময় ইসলাম ধর্ম ও তার সংস্কৃতিকে দোষারোপ করা হয়। এই ব্যাপারে পশ্চিমের হান্টিংটনবাদী, যাঁরা ‘সভ্যতার সংঘাত’-এর মতো তত্ত্বকে মান্যতা দেন, তাঁরা অগ্রগণ্য। পিছিয়ে নেই বর্তমান ভারতের গেরুয়া রাজনীতির প্রবক্তারাও। তবে সব শুভবুদ্ধির মানুষই জানেন, পৃথিবীর আরও অনেক ধর্মের মতো ইসলামও শান্তি এবং ভালবাসার বার্তা দেয়। ফলে এই (অপ)ব্যাখ্যার মধ্যে সমাধান খোঁজা অর্থহীন।

দ্বিতীয় কারণটির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন ইতিহাসবিদ এবং সমাজতত্ত্ববিদরা। তার প্রেক্ষিত অনেক বড়— অর্থ, ক্ষমতা এবং রাজনীতি। বিশ্বের বেশির ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত দেশে, বিশেষত তথাকথিত মধ্যপ্রাচ্যে, সন্ত্রাসের উত্থানের পিছনে রয়েছে আমেরিকা এবং রাশিয়া-সহ পশ্চিমি দেশগুলির স্বার্থ। এর প্রতিকার অবশ্যই প্রয়োজন, কিন্তু তার সম্ভাবনা ইতিহাসের এই লগ্নে ক্ষীণ।

তৃতীয় যে কারণটি দৃশ্যমান, তার মোকাবিলা করা সম্ভব এবং মুসলমান সমাজের পক্ষেই সম্ভব। অসাম্য, অবহেলা, দারিদ্র— এই সবের গর্ভে জন্ম নেয় যে ‘সেন্স অব ভিকটিমহুড’, যা বহুলাংশে যুক্তিযুক্তও বটে, তাকে কাজে লাগিয়ে চলেছে ধর্মের নামে ভয়ানক মগজধোলাই। মুসলমান তরুণের স্বপ্নে তাই অস্ত্র-হাতে নরহত্যার মতো নৃশংস কাজ জীবনের মহত্তম কর্ম হিসেবে আজ প্রতিভাত। ধর্মের এই অপব্যবহারের প্রতিকার রয়েছে আলোচনা ও কথোপকথনের মধ্যে। তার দায় বর্তায় মুসলমান সমাজের ওপরেই।

ইসলামের সঙ্গে সন্ত্রাসের কোনও যোগ নেই— শুধু এটুকু বলে ক্ষান্ত হলে, সে কেবল ভাবের ঘরে চুরি করা হবে। দরকার সমাজের সব স্তরে কথোপকথন; সবাইকে নিয়ে মত বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে উঠে আসবে যে ধর্মীয় বিশ্ববীক্ষা, তা-ই হয়ে উঠবে সন্ত্রাসের প্রকৃত প্রতিরোধ।

এই ‘সবাই’ বলতে কারা? এর মধ্যে যেমন থাকবেন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত প্রগতিবাদী মুসলমান, তেমনই থাকবেন ধর্মপ্রাণ, হয়তো বা আধুনিক শিক্ষায় কম শিক্ষিত মানুষ, যাঁর কাছে ইসলামই জীবনের সব বিষয়ের শেষ কথা। থাকতে পারেন সংস্কারাচ্ছন্ন গোঁড়া মানুষজনও। মনে রাখতে হবে, ধর্মপ্রাণ এবং অনেকটাই ধর্ম-নির্ভর এই সব মানুষকে যদি কথোপকথনের বাইরে রাখা হয়, তবে অতি সহজে তাঁদের কাছে পৌঁছে যায় ধর্মান্ধ এবং ধর্ম-রাজনীতির ধারক ও বাহকেরা। যাঁরা কথায় কথায় ফতোয়া দেন (হিন্দু প্রেক্ষিতে বলতে গেলে এঁরাই গো-মাতার উপাসনার জন্য উন্মুখ হন), সেই সব মুসলমান ধর্মীয় নেতাকেও আলোচনায় আনা প্রয়োজন। লড়াইটা যখন ধর্মের অপব্যবহার নিয়ে, সেখানে ধর্মকে এড়িয়ে না গিয়ে ধর্মের অনুষঙ্গ (তা ফতোয়াই হোক না কেন), ব্যবহারের মধ্যেই রয়েছে বাস্তববোধের পরিচয়। বাংলাদেশে কিছু দিন আগে লক্ষাধিক ইমাম হিংসার বিরুদ্ধে যে-ফতোয়া দিয়েছিলেন, সে কথা এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়।

মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষজনের কিংবা ভারতের মতো দেশের জনজীবনে পরতে পরতে লেগে রয়েছে ধর্মের স্পর্শ। সেই ধর্মের অপব্যবহার-প্রসূত সন্ত্রাসের মোকাবিলা তাই উঠে আসতে হবে পরিবার এবং সমাজের মধ্যে থেকে। রাষ্ট্রের ভূমিকা সেখানে গুরুত্বপূর্ণ হলেও, নির্ণায়ক নয়। এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে প্রাত্যহিক ধর্মীয় আচরণের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে সচেতনতাকে। ইজতিহাদ (স্বাধীন যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা) তো ইসলামি ঐতিহ্যেরই অংশ। ধর্মীয় বিশ্ববীক্ষার মধ্যেও এক রকম ভাবে ন্যায় এবং যুক্তি থাকে। সেই বোধগুলিকে চারিত করতে হবে সম্প্রদায়ের সমস্ত মানুষের মধ্যে, যাতে তাঁরা অন্যায়কে অন্যায়, অশুভকে অশুভ বলে চিহ্নিত করতে পারেন, তা সে যতই ধর্মের মুখোশ এঁটে আসুক না কেন। অন্যথায় সারা পৃথিবী হয়ে উঠবে ভ্রাতৃঘাতী কারবালা।

আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE