Advertisement
E-Paper

বিজয় মাল্য ও বিনোদিনী বাগদি

ধনীর বেলা আঁটিশুটি, গরিবের বেলা দাঁতকপাটি, এই নীতি নিয়ে বহু দিন চলেছে আমাদের দেশের সরকারি ব্যাঙ্ক। হাতি গলে যাচ্ছে, পিঁপড়ে পালাবার পথ আটকাচ্ছেন ব্যাঙ্কের কর্তারা।বিজয় মাল্যকে কে না চেনে। বিনোদিনী বাগদিকে কেউ চেনে না। তবু মিল একটা আছে — সরকারি ব্যাঙ্কের টাকা রয়েছে দু’জনের ঘরেই। বিজয় মাল্য ধার করেন বিমান কোম্পানির জন্য। আর বিনোদিনী একটু মাটি পেতে। দুই বিঘে জমি ঠিকা নিয়ে চাষ করছেন তিনি। দু’বিঘায় ১৬০ কিলোগ্রাম মতো মুসুর ডাল হলে ব্যাঙ্কের ঋণ মিটিয়ে হাজার সাতেক টাকা হাতে আসবে। গরুর খাবারটা মুফতে জুটবে। ডাল চাষে জমি উর্বর হওয়ায় জমির মালিক ধান চাষের জন্য ঠিকা দেবে সহজ শর্তে। আরও দু’পয়সা আসবে হাতে।

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০১৬ ০০:০৮

বিজয় মাল্যকে কে না চেনে। বিনোদিনী বাগদিকে কেউ চেনে না। তবু মিল একটা আছে — সরকারি ব্যাঙ্কের টাকা রয়েছে দু’জনের ঘরেই। বিজয় মাল্য ধার করেন বিমান কোম্পানির জন্য। আর বিনোদিনী একটু মাটি পেতে। দুই বিঘে জমি ঠিকা নিয়ে চাষ করছেন তিনি। দু’বিঘায় ১৬০ কিলোগ্রাম মতো মুসুর ডাল হলে ব্যাঙ্কের ঋণ মিটিয়ে হাজার সাতেক টাকা হাতে আসবে। গরুর খাবারটা মুফতে জুটবে। ডাল চাষে জমি উর্বর হওয়ায় জমির মালিক ধান চাষের জন্য ঠিকা দেবে সহজ শর্তে। আরও দু’পয়সা আসবে হাতে।

বিজয় আর বিনোদিনী, দু’জনেই আঁতেপ্রেনিয়র। তফাত যদি কিছু থাকে, তবে তা ব্যাঙ্কের ব্যবহারে। বিনোদিনীদের জন্য যা বজ্রআঁটুনি, বিজয়দের জন্য তা-ই ফস্কা গেরো। বিজয় মাল্যের থেকে নয় হাজার কোটি টাকা আদায় করতে নাস্তানাবুদ ১৭টি ব্যাঙ্ক, কর্তারা চেঁচামেচি জুড়েছেন তিনি ‘স্বেচ্ছা-খেলাপি’— লন্ডনে মুর্গি-মাটনে দিন কাটাচ্ছেন কিন্তু টাকা ফেরত দিচ্ছেন না। কিন্তু এত টাকা ব্যাঙ্কগুলো কীসের ভরসায় ধার দিল, তা ভেবেই সকলে মাথা চুলকোচ্ছে বেশি। যে সব ব্র্যান্ডের ‘বন্ধকী’ মূল্য হিসেবে তখন চার হাজার কোটি টাকা ধার দিয়েছিল ব্যাঙ্ক, এখন তার মূল্য ছ’কোটি টাকা। কোনও ব্যাঙ্ক টাকা ধার দিয়েছে এয়ার কন্ডিশনার, ট্র্যাকটর, এমনকী
ফোল্ডিং চেয়ারের ভিত্তিতে। কেউ হেলিকপ্টার বাঁধা রেখে, যা আর ওড়ার দশায় নেই। বন্ধকী সম্পদের বাজারদর তলানিতে, বেচতে চাইলেও খদ্দের মিলছে না। দেশের মানুষের টাকা বিনিয়োগ করার এই ছিরি ব্যাঙ্কের।

এমনটাই আজ দস্তুর। বিজয় মাল্য দৃষ্টান্ত শুধু। সম্প্রতি তথ্যের অধিকার আইনে দরখাস্ত করলে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানিয়েছে, ২০১৩ থেকে ২০১৫, এই দু’বছরে এক লক্ষ কোটিরও বেশি টাকার ঋণ হিসেবের খাতা থেকে বাদ দিয়েছে (‘রাইট অফ’) ২৯টি সরকারি ব্যাঙ্ক। ২০০৪ থেকে ২০১৫ সাল অবধি হিসেব ধরলে টাকাটা দাঁড়ায় ২ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। যারা ‘সাম্রাজ্য চালাচ্ছে অথচ ঋণখেলাপি,’ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে তাদের তালিকা চেয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।

২ লক্ষ কোটি টাকা! অঙ্কটা কল্পনাও করতে পারবেন না বিনোদিনীরা। ২০ হাজার টাকা নিতেও তাঁদের মাথায় ঘাম ফোটে। তবে সম্প্রতি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নোটিস পাঠিয়েছে, সামান্য টাকা ঋণ নিলে তা সংসারের কাজে ফুরিয়ে যায়, রোজগারের জন্য বিনিয়োগ হয় না। তাই অন্তত কম করে ১ লক্ষ টাকা, খেপে খেপে ১০ লক্ষ টাকা অবধি দিতে হবে একটা স্বনির্ভর দলকে। অনুন্নত জেলাগুলোতে ৩ লক্ষ টাকা ৭ শতাংশ সুদে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঠিক সময়ে শোধ করলে আরও ভর্তুকি মিলে দাঁড়াবে ৪ শতাংশ সুদে। এমনকী শর্তবিশেষে ২ শতাংশেও মিলতে পারে।

নির্দেশ কেমন মানা হচ্ছে, তার একটা ছবি দেখা গেল বীরভূমে। লাভপুর ব্লকের মহোদরীর রাধাকৃষ্ণ স্বনির্ভর দলকে গত বছর ডিসেম্বরে ২ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা ধার দেয় ব্যাঙ্ক। দলনেত্রী সুমিত্রা সাহা জানালেন, তাঁর ভাগের ৩০ হাজার টাকা দিয়ে তিনি নিজে একটা মুদির দোকান খুলেছেন। অন্যরা কেউ পোলট্রি, কেউ গরুছাগল পালন, কেউ একফালি জমি নিয়ে চাষ করছেন। একসঙ্গে ৩০ হাজার টাকা হাতে পেয়ে এই মেয়েদের মুখ রীতিমত উদ্ভাসিত।

কিন্তু খটকা দুটো। এক, যত দিন ধারের টাকা শোধ না হবে, তত দিন দলের মেয়েরা সেভিংস অ্যাকাউন্টে হাত দিতে পারবেন না। সঞ্চয়ের ৬০ হাজার টাকার একটা টাকাও নয়। ব্যাঙ্কগুলো এমন করে বলে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নির্দেশিকায় মেয়েদের সেভিংস অ্যাকাউন্টকে আটকাতে নিষেধ করেছে। তবু এই চলছে। গরিব ‘সিকিউরিটি’ দিতে পারবে না বলেই গোষ্ঠী গড়ে তাদের ঋণ দেওয়ার পথ বাতলেছিল বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাঙ্ক। কিন্তু গরিবের জন্য এ দেশের ব্যাঙ্ক চায় ‘ডবল সিকিউরিটি।’ গোষ্ঠীও গড়তে হবে, সঞ্চয়ের টাকা তোলাও চলবে না।

মেয়েরা নিজেদের টাকায় হাত দিতে পারবে না কেন? শুনে ব্যাঙ্কের কর্তা বললেন, ‘‘নিজের টাকা বললেই তো হবে না। ৩০ হাজার টাকা লোন পাওয়ার পরেও আরও টাকা দরকার কেন, বোঝাতে হবে।’’

আহা, এমন সুরে যদি বিজয় মাল্যকে প্রশ্ন করত ব্যাঙ্ক। অ্যাকাউন্ট যেন খেলাপি (এনপিএ) না হয়, তা নিশ্চিত করতে যদি ১:৫ অনুপাতে সঞ্চয় আর ঋণের শর্ত রাখত তাঁর কাছে। অথচ গোটা ভারতে স্বনির্ভর দলের ১০ কোটি মেয়ের ঋণ খেলাপ হয়েছে ৩৮১৫ কোটি টাকা। এক বিজয় মাল্যের অশোধিত ঋণের অঙ্কটা যার তিন গুণ।

দ্বিতীয় খটকা এই যে, গোষ্ঠীর সব মেয়ের জন্য বরাদ্দ ঋণের টাকার এক লপ্তে দিচ্ছে ব্যাঙ্ক। দশজন সদস্যের কার, কবে, কতটা দরকার, না দেখেই। অথচ মেয়েদের গোষ্ঠী, বা কৃষিঋণের অ্যাকাউন্ট হল ‘ক্যাশ-ক্রেডিট।’ ঋণ মঞ্জুর হলেই নিতে হবে, এমন নয়। যখন যতটা প্রয়োজন, তখন ততটা তোলা যাবে। যে দিন তুলবে, সে দিন থেকে সুদ গোনা হবে। নাবার্ড একটি রিপোর্ট বলছে, অধিকাংশ চাষিই তা জানেন না বলে অকারণে সুদ গোনেন। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মেয়েরাও তাই।

বহু ক্ষেত্রে ব্যাঙ্ক যা করে, তা স্রেফ শয়তানি। ঋণ মঞ্জুর হলেই টাকাটা মেয়েদের দলের সেভিংস অ্যাকাউন্টে দিয়ে দেয়। মেয়েরা সে টাকা তুলুক আর না তুলুক, তাদের সুদ গুনতে হবে। ব্যাঙ্ক কর্তারা এই সব কলকাঠি নাড়েন ঋণের টার্গেট পূরণ করতে। কর্তাদের চাকরি বাঁচাতে খেসারত গুনতে হয় গরিব মেয়েদের। এখন কয়েকটি ব্যাঙ্ক মেয়েদের পরামর্শ দিচ্ছে, ৩ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়ে ১ লক্ষ রাখুন ফিক্সড ডিপোজিটে। ব্যাঙ্কের সুবিধে অনেক — ঋণের সিকিউরিটি, নতুন ঋণ, নতুন ডিপোজিট হল। শুধু ভর্তুকির যা উদ্দেশ্য, মেয়েদের ব্যবসা বাড়ানো, সেটা হল না।

মেয়েদের দুঃখের কথা শুধু কি তাদের ডায়েরি, গল্প-উপন্যাস, যাত্রা-সিরিয়ালেই লেখা হয়? লেখা হয় ব্যাঙ্কের পাশবইয়েও। হাতিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের মোরদিঘি গ্রামের একটি দলের সঞ্চয় ১৪ হাজার টাকা। তিন লক্ষ টাকা ঋণ দিতে হলে সেভিংস অ্যাকাউন্টে লাগবে অন্তত ৩০ হাজার। ব্যাঙ্ক কর্তারা তাদের বোঝাচ্ছেন, ৩ লক্ষ টাকার ঋণ থেকে ১৬ হাজার সেভিংসে দেখিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু ব্যাঙ্কের টাকা নিতে মেয়েদের খুব ভয়। তাঁরা অনেক বেশি সুদে দলের সঞ্চয় থেকে ঋণ নেন। এ এক ডবল ট্র্যাজেডি। গরিব মেয়েরা সরকারি ভর্তুকি হারাচ্ছেন ভয়ে-অজ্ঞতায়, আর ভর্তুকির ভুল ব্যবহারে উৎসাহ
দিচ্ছে ব্যাঙ্ক।

ধনীর বেলা আঁটিশুটি, গরিবের বেলা দাঁতকপাটি, এই নীতি নিয়ে বহুদিন চলেছে সরকারি ব্যাঙ্ক। বাঁ হাতে মনসা পুজো দেওয়ার মতো করে ‘প্রায়োরিটি সেক্টর’, অর্থাৎ চাষি, গরিব মেয়ে, ছোট ব্যবসায়ীকে পরিষেবা দিয়েছে। যা সঞ্চয়, তার দু’গুণ, তিনগুণ ঋণ দেওয়ার কথা, দিয়েছে তার অর্ধেক। এখনও বহু সরকারি ব্যাঙ্ক এমন করছে। যার ১ লক্ষ টাকা সঞ্চয়, তাকে ঋণ দিচ্ছে ৬০ হাজার টাকা। ফলে মেয়েদের বেশি সুদে ধার করতে হচ্ছে। নাবার্ড বলছে, ‘বন্ধন’ বা ‘উজ্জীবন’-এর মতো বেসরকারি ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা থেকে ২০১৪-১৫ সালে এ রাজ্যের মেয়েরা ধার নিয়েছে ৯৪৪৯ কোটি টাকা। যেখানে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মাধ্যমে ব্যাঙ্কের থেকে নিয়েছে ১৫০৫ কোটি টাকা। সুদের হিসেব কষলে দেখা যাচ্ছে, ব্যাঙ্কের থেকে ওই টাকাটা পেলে মেয়েদের অন্তত ১৩৫০ কোটি টাকা সুদ কম দিতে হত।

টুনির ঘরে যে ধন আছে, রাজার ঘরে তা আছে থরেথরে। তবু টুনির মোহর ফিরে পেতে কুরুক্ষেত্র বেধেছিল। ব্যাঙ্ক কর্তাদের ভূমিকাটাও অনেকটা তেমনই। হাতি গলে যাচ্ছে, পিঁপড়ের পথ আটকাচ্ছেন তাঁরা।

মেয়েরা যদি না বাঁচে, টাকা বাঁচিয়ে ব্যাঙ্কের লাভটা কী?

কৃতজ্ঞতা: লোক কল্যাণ পরিষদ

শিল্পী: সুমন চৌধুরী

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy