এখানে কী হচ্ছে? শুধু ওদের জন্য?’ অষ্টম শ্রেণির ছাত্রটির প্রশ্নের উত্তরে আমরা প্রশ্ন করি, ‘বড় হয়ে ওঠার সময় ছেলে এবং মেয়েদের শরীরে নানা রকমের পরিবর্তন হয় তো?’ সে মাথা নাড়ে। ইতিমধ্যে জড়ো হয়েছে আরও কয়েক জন। কারও মুখে কৌতুক, লজ্জা বা সংকোচের আভাস নেই। বলতে থাকি, ‘সেগুলো তো জানা দরকার!’ তাতেও তারা সায় দেয়। তখন বলতে হয়, ‘‘সবাই এক জায়গায় বসে আলোচনা করব, এত বড় জায়গা তো নেই ভাই, তাই শুধু মেয়েদের নেওয়া হচ্ছে।’’
‘মানে, ছেলে-মেয়েদের আলাদা করে নেওয়া হবে, তাই তো?’ চোখ সরিয়ে বলি, ‘সেটা ঠিক জানি না।’
ভেতরে অপেক্ষারত সহকর্মী বন্ধুদের ডাক পেয়ে বেঁচে গেলাম। একটি অসরকারি সংস্থার সদস্য হিসেবে আমরা যাচ্ছি উত্তর ২৪ পরগনার বিভিন্ন স্কুলে। জেলার সর্বশিক্ষা মিশন আয়োজিত প্রকল্পে। উদ্দেশ্য, বয়ঃসন্ধির সময়ে কিশোরীদের যে বিষয়গুলি নিয়ে উদ্বেগ, কৌতূহল, সেগুলি সম্পর্কে জরুরি তথ্যের আদানপ্রদান। সহজ ও আকর্ষণীয় ভাবে মেয়েদের কাছে নানা বিষয় তুলে ধরার জন্য তৈরি করা হয়েছে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন, ফিল্মের ক্লিপিংস। যাতে হাসি-ঠাট্টার মধ্যে দিয়ে সংকোচ কাটে, মূল বিষয়ে তাড়াতাড়ি ঢোকা যায়।
ঘরের বাইরে ছড়িয়ে যায় আমাদের হাসির আওয়াজ আর ফিল্মের শব্দ। আমরা তখন বুঝি না যে এই কর্মসূচির অংশ হতে না পারায় একই ক্লাসের ছেলেরা কতটা বঞ্চিত মনে করে নিজেদের! খাওয়ার বিরতিতে আলাপ করতে গেলে তারা সাফ জানায়, ‘তোমরা মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে এসেছ, তাদের সঙ্গেই বল, আমরা তোমাদের সঙ্গে কথা বলব না।’ আমরা ভাবতে থাকি, শুধু মেয়েদের সঙ্গে কথা বলারই কি দরকার ছিল?
এ দিকের অধিকাংশ সহ-শিক্ষা স্কুলগুলিতে ছেলে এবং মেয়েদের আলাদা বিভাগ। যেমন সপ্তম-ক হল ছেলেদের, সপ্তম-খ মেয়েদের। আবার কোথাও বা একই ক্লাসের ছেলে-মেয়েদের ক্লাস বসে আলাদা বাড়িতে। কাছাকাছি থাকলেই নাকি ওরা প্রেম করছে, শারীরিক সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়ছে, এমনকী কোথাও কোথাও ক্লাসের মধ্যেই! অগত্যা আলাদা করার বিধান। আমাদের জন্য নির্ধারিত স্কুলগুলির মধ্যে মাত্র একটি স্কুলেই তারা এক ঘরে বসে। হতে পারে কাকতালীয়, কিন্তু সেই মেয়েদের সংকোচ তুলনায় অনেক কম ছিল।
প্রতি দিন মধ্যাহ্নের বিরতিতে আমরা একটা গোপন চিরকুট ফেলার বাক্স রাখতাম, যেখানে মেয়েরা তাদের যে কোনও সমস্যার কথা জানাতে পারে, যা তারা কাউকে বলতে পারছে না। শেষে সবাই মিলে চেষ্টা করতাম সমস্যাগুলির সমাধান বের করতে। একটি প্রশ্ন এল, এক সহপাঠী তার গোপন অঙ্গে হাত দিয়েছে। প্রথমে সে ভেবেছিল হয়তো ভুল করে লেগে গিয়েছে। কিন্তু তার পরে শোনে যে সেই ছেলেটি অন্যদের কাছে বাহাদুরির সঙ্গে জানাচ্ছে যে ইচ্ছে করে সে কাজটা করেছে। কী করবে মেয়েটি এখন? আমরা আলোচনা করি। আশা করা যায়, সহপাঠীর এই কুরুচিপূর্ণ আচরণের ফলে ক্রমশ ঘিরে-ধরা অবসাদ থেকে বেঁচে গেল মেয়েটি। কিন্তু সেই ছেলেটির কাছে তো আমরা পৌঁছতে পারি না। ছেলেটি বিকৃতির হাত থেকে বাঁচবে কী করে?
নানা স্কুলে মেয়েরা জানতে চেয়েছে, ‘ছেলেরা স্কুলে যাওয়া-আসার পথে বিরক্ত করে। মোবাইল নাম্বার চায়। কী করব?’ উঠে আসে প্রশ্ন, ‘ছেলেরা কেন এত অসভ্যতা করে?’ অনুভব করি, ঠিক কতটা জরুরি এই বিষয়ের আলোচনায় ছেলেদের অংশগ্রহণ। নারীনিগ্রহের যে সব ঘটনা ঘটে চলেছে আমাদের চারপাশে, তার মূল কারণগুলোর কাছাকাছি এ ভাবেই তো পৌঁছতে পারার চেষ্টা করা যেত?
সরকারি পরিকল্পনায় বয়ঃসন্ধির প্রকল্প সীমাবদ্ধ থাকে শুধু মেয়েদের মধ্যে। ছেলেরা থাকলেই কি মেয়েরা সংকোচে কথা বলবে না? আমাদের পুরুষ সহকর্মীদের উপস্থিতিতে গোড়ার দিকে দু-এক জন ছাত্রী একটু আড় চোখে তাকালেও পরে আর বোঝাই যায়নি যে ‘অবাঞ্ছিত’ কেউ উপস্থিত আছেন। ঋতুস্রাব নিয়ে আলোচনার সময়েও সংকোচ করতে দেখা যায়নি। কারণ, প্রাথমিক জড়তা কেটে গিয়েছে তত ক্ষণে। কোনও পুরুষের উপস্থিতি মেয়েদের কাছে আর সমস্যা নয়। তাঁরা যা বলছেন, যে ভাবে বলেছেন, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
প্রশিক্ষকরা যদি লিঙ্গপরিচয় নির্বিশেষে আলোচনা করতে পারেন, তা হলে ওরাও ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে শুধুমাত্র ‘পড়ুয়া’ পরিচয়ে পাশাপাশি বসে কেন অংশ নিতে পারবে না? এই অসম ব্যবস্থা বয়ঃসন্ধির মুখে দাঁড়ানো এই ছেলেমেয়েদের সুস্থ সহজ বন্ধুত্বের রাস্তাটা আরও কঠিন করে দিচ্ছে না কি? বয়ঃসন্ধির দোরগোড়ায় দাঁড়ানো ছাত্রদের স্বাভাবিক কৌতূহলের নিবৃত্তি ঘটিয়ে বিকৃতির হাত থেকে বাঁচিয়ে তোলার কাজটা অসম্ভব হবে কেন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy