Advertisement
Back to
Presents
Associate Partners
Lok Sabha Election 2024

এ বার কি বিন্ধ্য পার, মোদীকে চ্যালেঞ্জ তামিলনাড়ুর

সব অঙ্ক কষেই ২০১৯-এর অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী মোদী চিনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তাঁর বৈঠকের জন্য চেন্নাই শহর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে মহাবলীপুরমকে বেছে নিয়েছিলেন।

মহাবলীপুরমে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।

মহাবলীপুরমে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। —ফাইল চিত্র ।

প্রেমাংশু চৌধুরী
মহাবলীপুরম শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০২৪ ০৭:১২
Share: Save:

আসমানি রঙা কাগজে খয়েরি রঙের প্যাস্টেলে আঁকা ছবির মতো মাথা তুলে রয়েছে বারোশো থেকে তেরোশো বছরের প্রাচীন মহাবলীপুরমের তট মন্দির। দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরের গর্জন কানে কানে এসে বলে যাচ্ছে, তার বুকের গভীরে না কি এমনই ছ’টি মন্দির ডুবে রয়েছে। পায়ের তলায় রোদে তেতে ওঠা বালি জানান দিচ্ছে ভোটের উত্তাপ।

“চলুন ঘুরিয়ে দেখাই। মন্দিরের ইতিহাস শোনাব। কেন পাঁচ বছর আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এই মহাবলীপুরমেই বৈঠকে বসেছিলেন, সেটাও বলব”, গলায় সগর্বে সরকারি পরিচয়পত্র ঝোলানো ট্যুরিস্ট গাইড এস ভাস্করণ আমন্ত্রণ জানান।

২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের সমস্ত খবর জানতে চোখ রাখুন আমাদের 'দিল্লিবাড়ির লড়াই' -এর পাতায়।

চোখ রাখুন

এর পরে ভাস্করণ ভাঙা ইংরেজিতে বলে চলবেন তামিলনাড়ুর সঙ্গে চিনের ঐতিহাসিক সম্পর্কের কাহিনী। পল্লব রাজা দ্বিতীয় নরসিংহবর্মনের রাজত্বের কথা। সেই আমলেই তৈরি হয়েছিল এই তট মন্দির, পাহাড়ের গুহায় পাথর খোদাই করে ‘অর্জুনের প্রায়শ্চিত্ত’ চিত্র, পঞ্চপাণ্ডবের রথ। এসেছিলেন হিউয়েন সাং। তামিলনাড়ুর সঙ্গে চিনের বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান তুঙ্গে উঠেছিল। বিশেষত দক্ষিণ-পূর্ব চিনের ফুজিয়ান প্রদেশের সঙ্গে তামিলনাড়ুর গভীর সাংস্কৃতিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। চিনা প্রেসিডেন্টের গদিতে বসার আগে এই ফুজিয়ানেরই গভর্নর ছিলেন জিনপিং।

সব অঙ্ক কষেই ২০১৯-এর অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী মোদী চিনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তাঁর বৈঠকের জন্য চেন্নাই শহর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে মহাবলীপুরমকে বেছে নিয়েছিলেন। নিজেই চিনের রাষ্ট্রনেতাকে মহাবলীপুরম ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন। কূটনীতির সঙ্গে রাজনীতিও ছিল। এই মহাবলীপুরম থেকেই তিনি তামিলনাড়ুর ভোটারদের মন জয়ের চেষ্টাও শুরু করেছিলেন। চিনের প্রেসিডেন্টকে পাশে নিয়ে গোটা বিশ্বের সামনে তামিল শিল্প-সংস্কৃতিকে তুলে ধরছেন বলে বার্তা দিয়েছিলেন।

“ঠিক তাই।” ভাস্করণ সায় দিয়ে বলেন, “তার পর থেকেই বিদেশি পর্যটক মহাবলীপুরমে উপচে পড়ছে। জানেন তো, এখন তাজমহলের থেকেও মহাবলীপুরমে আসে!” বোঝা যায়, বিদেশি পর্যটক বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাস্করণের রোজগারও বেড়েছে। “শুধু মহাবলীপুরম কেন! গত পাঁচ বছরে প্রধানমন্ত্রী তামিলনাড়ুর বহু জায়গায় গিয়েছেন। রামমন্দির উদ্বোধনের আগের দিন তিরুচিরাপল্লীর রঙ্গনাথস্বামী মন্দির, তিরুভারুরের কোথণ্ডরামস্বামী মন্দিরে পুজো দিয়েছেন। পর্যটকেরা নতুন করে তামিলনাড়ুকে আবিষ্কার করেছেন।”—ভাস্করণের চোখে-মুখে মোদী-মুগ্ধতা।

কাঞ্চীপুরমের ডিএমকে সাংসদ গণেশন সেলভম এ সব শুনে হাসেন। তাঁর সংসদীয় কেন্দ্রের মধ্যেই মহাবলীপুরম। “আসলে নরেন্দ্র মোদী টের পেয়েছেন, উনি যতই লোকসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গড়ুন, দক্ষিণ ভারতের মানুষ তাঁকে ভোট দেয় না। নিজেকে বিশ্বগুরু বলেন। কিন্তু বিন্ধ্য পর্বতের এ পারেই তাঁর কারিকুরি কাজ করে না।” সেলভম আবার হাসেন। তার পরে বলেন, “ওই জন্যই গত পাঁচ বছর ধরে মোদী তামিলনাড়ুকে নিশানা করেছেন। মহাবলীপুরম থেকে শুরু করে বার বার নানা ছুতোয় তামিলনাড়ু এসেছেন। যদি বিজেপির কিছু ভোট বাড়ে। যদি বিজেপির জন্য কয়েকটা আসন বাগিয়ে নিতে পারেন। তা হলে দক্ষিণ ভারতেও তাঁর জনপ্রিয়তার ঢেউ আছড়ে পড়েছে বলে দাবি করতে পারবেন।”

তা হলে, ‘আব কি বার, চারশো পার’-এর সঙ্গে ‘আব কি বার, বিন্ধ্য পার’?

সেলভম বলেন, “লাভ হবে না। তামিলনাড়ুর মানুষকে এ সবে ভোলানো যায় না।”

ঠিকই। যায় না। লোকসভা ভোটে দক্ষিণ ভারতের হাওয়া বুঝতে তামিলনাড়ুতে পৌঁছে থেকে দেখছি, সাধারণ মানুষ ডিএমকে, এডিএমকে, কংগ্রেসের লোকসভা নির্বাচনের ইস্তাহার নিয়ে চুলচেরা বিচারে ব্যস্ত। ছোট্ট ছোট্ট জিরাগা সাম্বা চালে তৈরি আম্বুর বিরিয়ানির টেবিলেও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরির প্রশ্নে কোন দল কী বলছে, তার তুলনা চলছে। দিল্লি থেকে আসা সাংবাদিকের পরিচয় পেলে জানতে চাইছেন, বিজেপির ইস্তাহার কবে প্রকাশ হবে? এত দেরি কেন? সেখানে তামিলনাড়ুর জন্য কী থাকবে? মহাবলীপুরমের যে কোনও রেস্তরাঁর মালিক আপনাকে বলে দেবেন, ২০২১-এর তামিলনাড়ুর বিধানসভা ভোটে ডিএমকে-র ইস্তাহারে কতগুলো প্রতিশ্রুতি ছিল। ডিএমকে ক্ষমতায় এলেও তার মধ্যে কতগুলো এখনও পূরণ হয়নি!

হিন্দি বলয় ছেড়ে দিন। পশ্চিমবঙ্গের মানুষও একুশের ভোটে তৃণমূলের ইস্তাহারে কী ছিল, তা মনে করতে পারবেন না। এখানেই নরেন্দ্র মোদীর চ্যালেঞ্জ। এই তামিলনাড়ু রামমন্দিরে ভোলে না। নরেন্দ্র মোদী তাই প্রচারে এলেও রামমন্দিরের কথা বিশেষ বলেন না। তামিলনাড়ুতে সনাতন ধর্মের দোহাই দিয়ে হিন্দুত্বের বুলি চলে না। পেরিয়ারের মতাদর্শ এ রাজ্যে যুক্তিবাদে ভর করে জাতপাতহীন সমাজের বীজ বুনে দিয়েছে। ব্রাহ্মণ্যবাদ তামিলদের চক্ষুশূল। দ্রাবিড় অর্থনৈতিক মডেল যুগে যুগে আর্থিক বৃদ্ধির সঙ্গে সামাজিক ন্যায়ের কথা বলেছে। মোদীর ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’--এর স্লোগান এখানে নিছক ক্লিশে। তামিলরা জাতীয়তাবাদী। কিন্তু উগ্র জাতীয়তাবাদী নয়। এই তামিলনাড়ুতে হিন্দু ছেলের সঙ্গে খ্রিস্টান মেয়ে বা মুসলিম মেয়ের সঙ্গে হিন্দু ছেলের বিয়ে এতই স্বাভাবিক যে এখানে লাভ জেহাদের কথা বলে মেরুকরণ করাও কঠিন।

নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ তবু চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। ২০১৪-র পরে পাঁচ বছর তাঁরা পশ্চিমবঙ্গ-সহ উত্তর-পূর্বে আসন বাড়ানোর দিকে নজর দিয়েছিলেন। ২০১৯-এর পর থেকে তাঁরা গত পাঁচ বছর দক্ষিণ ভারতে আসন বাড়ানোর দিকে নজর দিয়েছেন। মোদী কি সফল হবেন?

মহাবলীপুরমের ট্যুরিস্ট গাইড ভাস্করণ বলছিলেন, “সে বার প্রধানমন্ত্রী এই মহাবলীপুরমের সৈকতে আবর্জনাও সাফ করেছিলেন। মানুষ ভুলে যায়নি। আগে উনি এলে ‘গো ব্যাক মোদী’ স্লোগান উঠত। এখন আর তা হয় না। এটাও তো সাফল্য।”

বঙ্গোপসাগরের ঢেউ মহাবলীপুরমের সৈকতে ধাক্কা খেয়ে ফিরে যায়। ঢেউয়ের মাথায় প্রশ্নটা ভাসতে থাকে— আব কি বার, বিন্ধ্য পার?

২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের সমস্ত খবর জানতে চোখ রাখুন আমাদের 'দিল্লিবাড়ির লড়াই' -এর পাতায়।

চোখ রাখুন
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE