আবার একটা ভোট। আবার উত্তেজনা। গত পাঁচ বছরের হিসেব যদি বলেন, আমি তো ভালই আছি। চারি দিকে মানুষের ভালবাসা, স্বীকৃতি, অভিবাদন, হাততালি, সংবর্ধনা, পুরস্কার আর আশীর্বাদে অভিভূত। অনেক রকম কাজ করার সুযোগ এসেছে, যথেষ্ট রোজগারের সুযোগ হয়েছে। তবে দেশের বেশির ভাগ মানুষ কেমন আছেন, তাঁদের সুবিধে-অসুবিধের কথা বিশ্লেষণ করার সুযোগ পাইনি। বরং একটু বেশিমাত্রায় নিজের সুবিধে-অসুবিধে দেখার চেষ্টা করেছি। তবে জেনেছি ঠিকই, খবরের কাগজে আর টেলিভিশনের মাধ্যমে অসত্ উপায়ে রোজগারের খবর পড়ে আর দেখে মনে হয়, মানুষ এ সব কেন করছে? তবে কি তারা ভাল নেই ? নাকি সামাজিক পরিস্থিতি তাদের এই কাজ করতে বাধ্য করছে? নাকি কিছু অসত্ লোক তাদের দিয়ে এই কাজ করিয়ে নিচ্ছে, অবস্থার সুযোগ নিয়ে? আমাদের রাজ্যও কিছু আলাদা নয়। এখানেও মাঝে মাঝে একই রকম খবর ছেপে বেরোচ্ছে। আর টিভিতে দেখাচ্ছে। সবটাই কি সত্যি? নাকি সেখানেও কোনও অসত্ উদ্দেশ্য আছে? আর্ভিং ওয়ালেস্-এর ‘দি অলমাইটি’-র কথা মনে পড়িয়ে দেয়। পয়সা দিয়ে কি খবর তৈরি করা যায়? তাই হচ্ছে কি? না না, আমি একটু বেশি পরিমাণে খারাপ ভাবছি। এতটা খারাপ অবস্থায় বোধহয় আমার রাজ্য বা দেশ নেই। আমিই ভুল।
গত পাঁচ বছরে অনেক রকম পরিবর্তন চোখে পড়েছে। রাস্তা মেরামত হয়েছে, অনেক বেশি আলো বসেছে, অনেক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র তৈরি হয়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলোকে আরও উন্নত করা হয়েছে। অনেক প্রেক্ষাগৃহে শীতাতপের ব্যবস্থা হয়েছে ও বসার আসনগুলিও বেশ উন্নত এখন। বহু ক্লাব ও সংগঠনকে টাকা দেওয়া হয়েছে। হরতাল ও বন্ধ কমেছে। এগুলো যেমন ভাল পরিবর্তন তেমনই বহু জায়গায় অশান্তির ঘটনা আমাদের বিচলিত করেছে। মারপিট ও খুনোখুনি বেড়েছে। টাকা খাওয়া-খাওয়ি বেড়েছে। পুলিশ কখনও আক্রান্ত হয়েছে, আবার কখনও নিষ্ক্রিয় থেকেছে। শ্লীলতাহানির ঘটনা বেড়েছে। রাস্তায় গাড়ি ও মানুষের অধৈর্যতা বেড়েছে। রাজনৈতিক অন্তর্দ্বন্দ্ব বেড়েছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কাছের মানুষদের উচ্চপদে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক নেতাদের গালিগালাজ আমাদের স্তম্ভিত করেছে। নিত্যপ্রয়োজনায় জিনিসের দামও বেড়েছে বেশ কিছুটা। তবুও বলব, আমার কাছে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল সরকারি ‘টেকনিশিয়ান্স স্টুডিও’-র পরিবর্তন। যে স্টুডিও কমপ্লেক্স আগের সরকার একটি বেসরকারি সংস্থাকে লিস-আউট করে দিচ্ছিল, এই সরকার এসে সেটি পুনরুদ্ধার করল। এটি নিঃসন্দেহে গর্বের। তবে শহরকে অযথা নীল-সাদায় মুড়ে দেওয়াটা এবং অতি আলোকিত করাটা হাস্যকর। অন্য রাজ্যের মানুষরা এই নিয়ে আমাদের কটাক্ষ করতে ছাড়েন না।
জোট এ বারের ভোটে একটা নতুন চ্যাপ্টার। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল জোট করে অনেক বার ভোটে লড়েছে এবং অনেক সময় যেমন সুফল পেয়েছে, তেমনই মাঝে মাঝে খারাপও হয়েছে। কিন্তু এ বারের কংগ্রেসের সঙ্গে বামফ্রন্টের জোট করার সিদ্ধান্তটা অনেকের কাছে আশ্চর্যের। যে কংগ্রেসের জন্য হাজার হাজার বামপন্থী প্রাণ হারিয়েছিল ও বামপন্থীদের হাতে কংগ্রেসের লোকেরা প্রাণ হারিয়েছিল, সেই অশান্তি আর শত্রুতা ভুলে গিয়ে তারা বন্ধু হয়ে গেল? যে কংগ্রেস দল তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে বামফ্রন্টের ঘোর বিরোধিতা করেছিল এবং বামফ্রন্টের হারের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তাদের সঙ্গেই জোট? তা-ও আবার তৃণমূলের বিরুদ্ধে? আমরা জানি, কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের সম্পর্ক এখন আর ভাল নেই। একটা কথা আছে, আমার শত্রুর শত্রু হচ্ছে আমার বন্ধু। এটা তো সামাজিক নিয়মে খাটে আমরা জানি, রাজনীতিতেও খাটে? তবে রাজনীতি এমনই একটা বিষয় যেখানে অভিজ্ঞ লোকেরা বলে থাকেন, রাজনীতিতে কখনওই কেউ চিরশত্রু বা চিরবন্ধু হন না। রাজনৈতিক দলগুলিকে এক এক সময় এক এক রকম পন্থা অবলম্বন করে চলতে হয়। এটা অনেকটা দাবা খেলার মতো। তবে এ বিষয়ে আমার বেশি বলা উচিত নয়, কারণ আমি রাজনীতির বিশেষ কিছুই বুঝি না। যাঁরা বোঝেন তাঁরাই ঠিক করেছেন জোট হওয়া উচিত, অতএব হবে। এখন মানুষ কী বলে সেটাই দেখার। বেশির ভাগ সাধারণ মানুষ কী চায়, সেটা কেউ বলতে পারে না। সেটা ভোটের ফলাফল বলবে।
ভোটের বাজারে ‘নোটা’ অপশন সব সময়েই খোলা। ‘নান অব দি অ্যাবাভ’। যাঁরা মনে করেন কাউকেই ভোট দেবেন না এবং তাঁর ভোটটা একেবারে নষ্ট যাতে না হয়ে যায় তাঁরা ‘নোটা’ টিপবেন। এটা তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকার। তবে আমি কিন্তু ওটায় নেই। আমি ভোট দেব সেই দলকে, যাদের আমি মনে করি রাজ্য চালানোয় সক্ষম, দেশ চালানোয় দক্ষ। যারা তাদের মতাদর্শ দিয়ে দেশ চালাবে। এবং তাদের মতাদর্শ যদি আমার শিক্ষা, রুচি, মনন ও ব্যবহারের সঙ্গে মেলে তবেই তাকে ভোট দেব। সে ক্ষেত্রে আমাদের দেশের সব ক’টি দলই কিন্তু সমান। তারা সকলেই দেশের ও দশের ভালর জন্যই কাজ করেন। কেউ মানুষের অপকারের কথা ভেবে ভোটে দাঁড়ায় না। কিন্তু সব ক’টি দলের মধ্যে থেকে একটি দলকে তো বেছে নিতেই হবে, যারা থাকলে উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ কম, তাকেই ভোট দেব। কাজেই সেখানে প্রার্থী’র থেকে দলকে প্রাধান্য দিই।
আরও পড়ুন
আজও নেতার কাছে চাওয়ার বস্তু ‘রোটি, কাপড়া আউর মকান’
ভোটের ক্ষেত্রে শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। নতুন সরকার গঠনের জন্য তৃণমূল কংগ্রেস বহু নামি-দামী শিল্পীদের সংগঠিত করেছিল। তাঁরা এক বাক্যে বলেছিলেন, পরিবর্তন চাই। তাঁদের কথা মানুষ শুনেছিলেন এবং তাঁদের আবেদনে সাড়া দিয়ে ভোট দিয়েছিলেন। পরে কিছু শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী সেই বক্তব্য থেকে সরে আসেন। আবার অনেকে পরেও যোগদান করেছেন। করবেন না-ই বা কেন? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নেত্রী হিসেবে তাঁদের ভাল লেগেছিল। ওই একটি মানুষকে দেখে তাঁরা বুঝেছিলেন, ‘এঁকে সমর্থন করলে রাজ্যের ভালই হবে।’ সেই মানুষটি সত্যিই ভীষণ স্নেহপ্রবণ ও আন্তরিক। আমি ব্যক্তিগত ভাবে তাঁর সঙ্গে মিশে দেখেছি। যে সমস্ত শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী সত্যিই মানুষের জন্য কাজ করতে চেয়েছিলেন, তাঁরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং জিতেওছিলেন। যদিও তাঁদের রাজনৈতিক শিক্ষা ছিল না। অনেকে ভাল কাজ করেছেন ঠিকই, তবে বেশির ভাগ শিল্পী বিধায়ক বা সাংসদ হয়েও খুব একটা সফল হতে পারেননি। আমি তাঁদের মধ্যে পড়ি না। কারণ আমার কাছে ব্যক্তির চেয়ে সংগঠক অনেক বড়। এখনও বামফ্রন্টের সাংগঠনিক ক্ষমতা তৃণমূল কংগ্রেসের থেকে অনেক বেশি বলে আমার মনে হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy