Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

চিনেও চেনে না পুলিশ, চিনা তাই ‘ফেরার’ই

কাউকে বলেন, ‘‘এখানে আমিই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়’’, কাউকে বলেন, ‘‘পুলিশকে অভিযোগ জানিয়ে লাভ হবে না। অভিযোগ যেখানেই দে না কেন, ঘুরে আসবে সেই আমার কাছেই।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায় ও শিবাজী দে সরকার
শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৬ ০২:০০
Share: Save:

কাউকে বলেন, ‘‘এখানে আমিই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়’’, কাউকে বলেন, ‘‘পুলিশকে অভিযোগ জানিয়ে লাভ হবে না। অভিযোগ যেখানেই দে না কেন, ঘুরে আসবে সেই আমার কাছেই। আমিই লালবাজার।’’

কোনও রাখঢাক নেই। লোকজনকে এমন কথা বলে নিজের ক্ষমতা জাহির করেন। বেলেঘাটায় কলকাতা পুরসভার ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে এই সুনীল সিংহ বা চিনাই প্রশাসন। আর এ হেন চিনাকে চটাবে কে? তাই চিনাকে আর নিজে থেকে গিয়ে দাঁড়াতে হয় না কারও সামনে। ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে কোনও নির্মাণকাজ হলেই ঠিকাদারেরা পৌঁছে যান চিনার দরবারে। কে ইমারতি দ্রব্য সরবরাহ করবে, কোন মিস্ত্রি কাজ করবে, জোগানদারেরা কোথা থেকে আসবে— সব ঠিক করে দেন চিনা। কেউ কোনও নতুন ফ্ল্যাট নিতে চাইলে চিনার সবুজ সঙ্কেত চাই-ই চাই। এর জন্য চার্জ দিতে হয় সবাইকে। আর একটা শর্ত, যে ফ্ল্যাট চিনা বেছে দেবেন, তা নিতেই হবে। দাম নিয়ে কোনও দরাদরি চলবে না। স্থানীয়দের কথায়, ‘চিনা তোলাবাজিকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন।’

চিনার এক শাগরেদের কথায়, ‘‘আমাদের কাজে পুরো গ্যারান্টি। কোনও ঝঞ্ঝাট হবে না। ফেল কড়ি, মাখো তেল। ফ্ল্যাটবাড়িতে কোনও নিরাপত্তারক্ষী রাখতে হবে না। আমরাই সব দেখে দেব।’’

খুনের চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। বছর দেড়েক আগে নারকেলডাঙায় গুগ্গি নামে স্থানীয় এক যুবককে গুলি করে খুনের ঘটনার অন্যতম মূল অভিযুক্ত চিনা। পুলিশের খাতায় তিনি ফেরার। তবে নারকেলডাঙা মেন রোড, ক্যানাল রোড, কসাই বস্তি এলাকায় চিনার দেখা মেলে প্রতি দিনই। ভোটের বাজারেও তিনি উজ্জ্বল। মিছিলে যেমন আছেন, তেমনই আছেন ব্যানার-ফেস্টুনে। তৃণমূল প্রার্থী পরেশ পালের অনেক ব্যানার— ফেস্টুনের নীচে চোখে পড়ছে ‘সৌজন্যে সুনীল সিংহ (চিনা)’।

পুলিশের কাছেও চিনা অতি পরিচিত নাম। খুনের অভিযোগের পাশাপাশি চিনার বিরুদ্ধে তোলাবাজি, বেআইনি অস্ত্র রাখা-সহ গোটা সাতেক অভিযোগ রয়েছে কেবলমাত্র নারকেলডাঙা থানাতেই। কিন্তু তৃণমূলে চিনার অবস্থান কোথায়? নারকেলডাঙা মেন রোডে তৃণমূলের একটি অফিসে বসে এক তৃণমূল কর্মী জানালেন, ‘‘চিনাদা আমাদের ওয়ার্ডের তৃণমূল সেবাদলের প্রেসিডেন্ট।’’

চিনার এমন ক্ষমতাবান হয়ে ওঠার পিছনে পুলিশ এবং এলাকার মানুষ দুষছেন কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ স্বপন সমাদ্দারকে। লালবাজারের একটি সূত্রের দাবি, নারকেলডাঙার গুলি-কাণ্ডের পরেই চিনাকে গারদে পুরতে চেয়েছিলেন গোয়েন্দা অফিসারেরা। কিন্তু স্বপনবাবুর মদতপুষ্ট হওয়ার ফলেই চিনাকে পাকড়াও করার অনুমতি মেলেনি। ‘‘ফলে চিনার সাহস বেড়ে গিয়েছে,’’— বলছেন লালবাজারের এক গোয়েন্দা অফিসার। চিনার সঙ্গে স্থানীয় পুলিশের দহরম-মহরমের কথাও কিন্তু এলাকায় কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে।

স্থানীয় এক ব্যবসায়ী জানাচ্ছেন, ‘‘চিনাকে ফেরার বলছে পুলিশ আর গত সপ্তাহে থানার এক অফিসারের সঙ্গে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে খোশগল্প করতে দেখেছি আমরা। থানায় চিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়লে ওই অফিসারই তা চিনার কানে তুলে দেন। আমরা এটা জানি।’’

কী বলছেন মেয়র পারিষদ স্বপন সমাদ্দার? স্বপনবাবুর দাবি, ‘‘কোনও নেতা নয়। চিনা আমাদের দলের কর্মী। ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে মিথ্যে মামলায় চিনাকে ফাঁসানো হয়েছে।’’ স্বপনবাবুর ঢঙেই চিনা বলেন, ‘‘আমাকে যে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে, তা মানুষ জানে। দলের নির্দেশে দলীয় প্রচারে অংশ নিতে হচ্ছে বইকী। দলই আমার সব।’’

পুলিশের খাতায় যিনি ‘ফেরার’, তিনি প্রচারে থাকছেন কী করে?

লালবাজারের একটি অংশের অভিযোগ, চিনাকে ধরার ব্যাপারে শীর্ষ কর্তারা উদাসীন, তাই থানা থেকে শুরু করে গোয়েন্দা বিভাগ — কেউ তার টিকি ছুঁতে পারছে না। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ এবং নারকেলডাঙা থানা অবশ্য জানিয়েছে, ওই ঘটনার সঙ্গে চিনার জড়িত থাকার প্রাথমিক কোনও প্রমাণ তাঁরা পাননি। তাই তাঁকে গ্রেফতার তো করাই হয়নি, উল্টে তাঁর স্ত্রীকে দিয়ে মুচলেকা লিখিয়ে নেওয়া হয়েছে। যাতে আর কোন গোলামালে চিনা না জড়ায়।

পূর্ব শহরতলি থানা এলাকার এক পুলিশকর্তা বলেন, ‘‘হরিদেবপুর থানার কবরডাঙ্গায় একটি পানশালার বাইরে দুষ্কৃতীদের গুলিতে মারা যান এক যুবক। অভিযোগ ওই ঘটনায় জড়িতেরা সকলেই ছিল শাসকদলের ঘনিষ্ঠ। পুলিশ অফিসারেরা ওই দুষ্কৃতীদের ধরার ব্যপারে অনুমতি চাইলেও লালবাজারের কর্তা তা দেননি। আর যার ফলেই ওই খুনের ঘটনা ঘটে।’’ নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে দুষ্কৃতীদের ধরার ব্যাপারে পুলিশ কিছুটা তৎপর হলেও শাসক-ঘনিষ্ঠ দুষ্কৃতীদের যে গ্রেফতার করা হচ্ছে না তার উদাহরণ চিনা। তবে কলকাতা পুলিশের এক কর্তা জানান, ‘ওয়ান্টেড’ তালিকায় নাম থাকা সব অপরাধীদের গ্রেফতার করা হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE