Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
তৃণমূলে ফের নারদের হুল

ভিডিওর জালে এ বার অপরূপা, সঙ্গে শঙ্কুদেবও

প্রথম দফায় জালে পড়েছিলেন এগারো জন। দ্বিতীয় দফায় ধরা পড়লেন আরও দুই। সোমবার নারদ নিউজের পক্ষ থেকে স্টিং অপারেশনের যে ভিডিও ফুটেজ তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে ‘বন্দি’ তৃণমূলের আরামবাগের সাংসদ অপরূপা পোদ্দার এবং নেতা শঙ্কুদেব পণ্ডা। অপরূপাকে দেখা গিয়েছে ক্যামেরার ও-পারে থাকা নারদ নিউজের প্রতিনিধির কাছ থেকে টাকা নিতে। শঙ্কু সরাসরি টাকা না-নিলেও তাঁকে কোনও একটি সংস্থার অংশীদারিত্ব চেয়ে দরাদরি করতে দেখা গিয়েছে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৬ ০৪:০৮
Share: Save:

প্রথম দফায় জালে পড়েছিলেন এগারো জন। দ্বিতীয় দফায় ধরা পড়লেন আরও দুই। সোমবার নারদ নিউজের পক্ষ থেকে স্টিং অপারেশনের যে ভিডিও ফুটেজ তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে ‘বন্দি’ তৃণমূলের আরামবাগের সাংসদ অপরূপা পোদ্দার এবং নেতা শঙ্কুদেব পণ্ডা। অপরূপাকে দেখা গিয়েছে ক্যামেরার ও-পারে থাকা নারদ নিউজের প্রতিনিধির কাছ থেকে টাকা নিতে। শঙ্কু সরাসরি টাকা না-নিলেও তাঁকে কোনও একটি সংস্থার অংশীদারিত্ব চেয়ে দরাদরি করতে দেখা গিয়েছে।

প্রথমটির মতো এই ফুটেজটির যথার্থতাও আনন্দবাজারের পক্ষে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এই ছবির জেরেই রাজ্য রাজনীতির উত্তাপ আরও এক ধাপ চড়েছে। বিরোধীদের অভিযোগ, দুর্নীতি যে শাসক দলের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিকড় ছড়িয়েছে, এই ছবিই তার প্রমাণ। অন্য দিকে তৃণমূল নেতারা ‘জাল ভিডিও’ এবং ‘রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের’ তত্ত্বই আঁকড়ে রয়েছেন। পাশাপাশি একান্ত আলোচনায় স্বস্তি প্রকাশ করে কেউ কেউ বলছেন, এ দফার ফাঁড়া অল্পের উপর দিয়েই গিয়েছে। কারণ, অপরূপা সাংসদ হলেও বড় মাপের কোনও নেত্রী নন। আর সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তলব করার পর থেকে শঙ্কুর সঙ্গে দূরত্ব অনেকটাই বাড়িয়ে ফেলেছে দল। বস্তুত ফের স্টিং অপারেশনের ফুটেজ প্রকাশের আশঙ্কায় তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে যে ভ্যাপসা পরিবেশ ছিল, এ দিন সেটা অনেকটাই কেটেছে। তাঁদের আরও স্বস্তি দিয়ে নারদ নিউজের প্রধান ম্যাথু স্যামুয়েল এ দিন বলেছেন, ‘‘আর কোনও ফুটেজ আপলোড করছি না। ৫২ ঘণ্টার ফুটেজের সবটাই মঙ্গলবার আদালতের হাতে তুলে দেবেন আমার আইনজীবী।’’

গত ১৪ তারিখ দিল্লিতে প্রথম দফার ফুটেজ প্রকাশের সময়ই স্যামুয়েল দাবি করেছিলেন, আরও বিস্ফোরক ছবি রয়েছে। প্রয়োজনীয় সম্পাদনার পরে তা প্রকাশ করবেন। ফলে দুশ্চিন্তায় ডুবে ছিল তৃণমূল শিবির। প্রকাশ্যে অবশ্য বিষয়টিকে বিরোধীদের ষড়যন্ত্র বলেই উড়িয়ে দিচ্ছিলেন দলের নেতারা। জনসমক্ষে দেখানোর চেষ্টা করছিলেন, তাঁরা মোটেই চিন্তিত নন। প্রথম ভিডিওয় দেখা যাওয়া তিন নেতা— শোভন চট্টোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিম ও সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে এ দিন দক্ষিণ কলকাতায় পদযাত্রা করেন খোদ তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু জনমানসে তো বটেই, দলের অন্দরেও ক্ষোভ দানা বাঁধছিল। দলীয় বৈঠকে অসন্তোষ উগরে দেন দুই সাংসদ সুগত বসু ও দীনেশ ত্রিবেদী। পরে অভিযুক্ত সাংসদদের সঙ্গে এক সারিতে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ দেখাতে অস্বীকার করেন সুগতবাবু। আর স্যামুয়েল এ দিন দাবি করেছেন, অন্য তৃণমূল নেতা-মন্ত্রীদের মতো দীনেশের সঙ্গেও দেখা করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দীনেশ রাজি হননি। দেখা করলেও তাঁদের প্রস্তাবে সাড়া দেননি আর এক সাংসদ সুব্রত বক্সী।

অপরূপার সঙ্গে অবশ্য গত লোকসভা ভোটের আগে অনায়াসেই দেখা করা গিয়েছিল বলে দাবি নারদ নিউজের। ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, অপরূপা নীল চুড়িদার পরে খাটের ওপর বাবু হয়ে বসে রয়েছেন। গায়ে ডোরাকাটা টারকোয়াইজ রঙের ওড়না। সামনে রাখা টাকার তোড়া। মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলছেন, ‘‘আমি জীবনে এ সব খুলতে পারি না। এ সব শাগিরের কাজ।’’ নারদ নিউজের প্রতিনিধিকে তখন বলতে শোনা যায়, ‘‘ঠিক হ্যায়। দো লাখ দে দো। এক লাখ ম্যায় আপকো দুঙ্গা। ব্যাগ আছে তো আপনার?’’ অপরূপা তখন ফোনে কাউকে বলেন, ‘‘সুগন্ধা আমার ব্যাগটা একটু নিয়ে আসুন। আমার পার্সটা... হ্যাঁ শুধু ব্ল্যাক কালারেরটা।’’

ইন্টারনেটে এই ফুটেজ ছড়ানোর পরে আঠাশে পা-দিয়েই লোকসভায় পৌঁছে নজর-কাড়া অপরূপা বলেন, ‘‘ঘুষ ও ডোনেশনের মধ্যে তো একটা ফারাক রয়েছে। কেউ যদি বলে অপরূপা তোমার নির্বাচনের জন্য দশ হাজার টাকা নাও, এর মধ্যে অপরাধটা কোথায়?’’ পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে তাঁর দাবি, ‘‘যদি ফুটেজে প্রমাণ করা যায় যে আমি টাকা নিয়েছি, তা হলে সাত দিনের মধ্যে ইস্তফা দেব।’’

অপরূপা চ্যালেঞ্জ ছুড়লেও মুখে কুলুপ এঁটেছেন শঙ্কুদেব। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, কর্পোরেট সংস্থার অংশীদারির বিনিময়ে তিনি সব রকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন নারদের প্রতিনিধিকে। বলছেন, ‘‘ম্যায় আপকে সাথ হুঁ। অগর আপকা কাম হো যাতা হ্যায় উনকে সাথ মিলনে সে, মেরা ক্যায়া আতা যাতা হ্যায়? আপ সির্ফ বোলনা শঙ্কু মুঝে ইয়ে চাহিয়ে... আই ওয়ান্ট আ স্টেক ইন দিজ সাবজেক্ট। এক স্টেক হোনা চাহিয়ে। মেরা স্টেক রহেগা তো ইস্যুজ অলগ হোগা।’’ কেন অংশীদারি চাই তার ব্যাখ্যা দিতেও শোনা গিয়েছে শঙ্কুকে। তিনি বলেছেন, ‘‘ইউ নো আই অ্যাম নট আ প্রফেশনাল পার্সন। আই হ্যাভ নো প্রফেশন জাস্ট নাউ। পলিটিক্স অগর ম্যায় করুঁ আগে, মুঝে কুছ না কুছ করনা চাহিয়ে। তো ইয়ে মেরা বিজনেস হোগা!’’

তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি শঙ্কুদেব একদা শিক্ষাক্ষেত্রে ছড়ি ঘোরালেও ইদানীং দলে বেশ কোণঠাসা। সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তাঁকে তলব করার পরেই দলের শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশে তাঁকে পাততাড়ি গোটাতে হয়েছে তৃণমূল ভবন থেকে। এক সময় দলীয় সভা-অনুষ্ঠানে দাপিয়ে বেড়ানো শঙ্কুকে এখন খুব একটা সক্রিয় অবস্থায় দেখাও যাচ্ছে না। শাসক দলের নেতারা শঙ্কু তেমন গুরুত্বপূর্ণ কেউ নন বলে বিষয়টি লঘু করতে চাইলেও বিরোধীরা কিন্তু দাবি করছেন, তাঁর মন্তব্য এত সহজে উড়িয়ে দেওয়ার নয়। রাজ্য বিজেপির সহ-সভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদার এ দিন বলেন, ‘‘ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, শঙ্কু বলছেন, ‘তাঁকে’ দিয়ে যত দূর সম্ভব কাজ করিয়ে দেবেন। এই ‘তিনি’ কে? যাঁর নির্দেশ ছাড়া এ রাজ্যে পাখি ডাকে না, গাছের পাতা নড়ে না, তিনিই কি?’’ সিপিএম রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রও বলেন, ‘‘একের পর এক তৃণমূল নেতা, সাংসদদের ঘুষ খাওয়ার ভিডিও টেপ প্রকাশ করা হচ্ছে। এই ঘুষখোরদের দলের মাথা কে সেটা খুঁজে বার করতে হবে।’’

ভোটের মুখে তৃণমূলের বিরুদ্ধে আরও একটা অস্ত্র হাতে আসায় স্বাভাবিক ভাবেই উল্লসিত বিরোধী শিবির। কিন্তু সবচেয়ে খুশি বোধহয় নন্দীগ্রামের প্রাক্তন সিপিআই বিধায়ক শেখ ইলিয়াস মহম্মদ। শঙ্কুদেবের স্টিং অপারেশনের জেরে বিধায়ক পদ খুইয়েছিলেন তিনি। আর এ দিন সেই শঙ্কুর নামই আর এক স্টিং অপারেশনে জড়িয়ে যাওয়ায় খুশি চাপার বিন্দুমাত্র চেষ্টা না-করে তাঁর মন্তব্য ‘‘এত দিনে একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হল। শঙ্কু আমাকে যে গর্তে ফেলেছিল, ও সেই গর্তেই পড়ল। এ বার ওকেও পাপস্খালন করতে হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE