Advertisement
০৫ মে ২০২৪
ভয় উড়িয়ে ভোট/১

হাত যখন ভেঙে দিল, ভোট দেবই

রাতের হুমকিটা যে সত্যিই এমন করে ফলে যাবে, তা দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি কল্যাণী বিবেকানন্দ পল্লির শিবু দাস। কিন্তু আক্রান্ত হয়েও ঘুরে দাঁড়ানোর যে নজির তিনি রাখলেন, তা এই হুমকি-ভোটের বাজারে দৃষ্টান্ত হয়ে রইল। দৃষ্টান্ত হয়ে রইল তাঁর স্ত্রী টুলটুল দাসের ভয় জয় করা জেদও।

হাত ভেঙেছে, তবু ভাঙেনি জেদ। ভোট দিয়ে ফেরার পর বিবেকানন্দ পল্লির প্রহৃত দম্পতি। —নিজস্ব চিত্র।

হাত ভেঙেছে, তবু ভাঙেনি জেদ। ভোট দিয়ে ফেরার পর বিবেকানন্দ পল্লির প্রহৃত দম্পতি। —নিজস্ব চিত্র।

সুপ্রকাশ মণ্ডল
কল্যাণী শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৪৯
Share: Save:

রাতের হুমকিটা যে সত্যিই এমন করে ফলে যাবে, তা দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি কল্যাণী বিবেকানন্দ পল্লির শিবু দাস। কিন্তু আক্রান্ত হয়েও ঘুরে দাঁড়ানোর যে নজির তিনি রাখলেন, তা এই হুমকি-ভোটের বাজারে দৃষ্টান্ত হয়ে রইল। দৃষ্টান্ত হয়ে রইল তাঁর স্ত্রী টুলটুল দাসের ভয় জয় করা জেদও।

তৃণমূলের হুমকি উপেক্ষা করে ভোট দিতে গিয়েছিলেন কালনা পলিটেকনিক কলেজের শিক্ষক শিবুবাবু। পরিণাম? মেরে তাঁর দু’টি হাতই ভেঙে দেয় তৃণমূলের ভৈরব-বাহিনী। কিন্তু দমানো যায়নি শিবুকে। ভাঙা হাত নিয়েই সস্ত্রীক ভোট দিয়ে এসেছেন তিনি।

মস্তানেরা যখন স্বামীর উপরে চড়াও হয়েছে, বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন শিবুর স্ত্রী টুলটুলও। মহিলা বলে রেয়াত না করে শাসক দলের গুন্ডারা এলোপাথাড়ি চড়-থাপ্পড় মারে তাঁকেও। টুলটুল দমেননি। ভোট দিয়েছেন তিনিও।

গত কয়েক দিন ধরেই শাসকের বাহুবলীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল নদিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকায়। যেখানেই জোটের ভরসায় মানুষ মাথা তোলার চেষ্টা করেছে, সেখানেই ভয় দেখানোর কারবার চালিয়েছে তারা। কখনও হরিণঘাটা, কখনও চাকদহ, কখনও গয়েশপুর— চক্কর দিয়ে বেড়িয়েছে মোটরবাইক-বাহিনী। ধরে-ধরে শাসিয়েছে, বোমা মেরেছে বিরোধী প্রার্থীর বাড়িতে, ভেঙে দিয়েছে জোট প্রার্থীর গাড়ির কাচ।

এরা যে ভোটের দিন দাঁত-নখ বার করবে, তা অবশ্য প্রত্যাশিতই ছিল। ভোটের আগের রাত থেকেই কল্যাণী, চাকদহ, গয়েশপুরে বাড়ি-বাড়ি হুমকি দেওয়া হয়েছিল— কেউ যেন বুথমুখো না হয়। গেলে সুস্থ দেহে বাড়ি ফেরার দায়িত্ব কেউ যে নিতে পারবে না, তা-ও জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল স্পষ্ট করে।

বুধবার রাতেই হুঁশিয়ারি পেয়েছিলেন কল্যাণী বিবেকানন্দ পল্লির শিবু দাসেরাও। শিবু এ দিন বলেন— ‘‘সোজা বাড়িতে এসে চড়াও হয়েছিল ওদের (তৃণমূলের) গুন্ডাবাহিনী। আমায় অকথ্য গালিগালাজ করে ওরা। যাওয়ার সময়ে হুমকি দিয়ে যায়, কোনও ভাবেই যেন আমি বা আমার বাড়ির কেউ ভোট দিতে বুথে না যাই।’’

কিন্তু শিবুরা মরিয়া ছিলেন, ভোট দিতে যাবেনই। তাতে যা হয়, হবে। এমনিই তো ভয়ে মরে আছেন, নতুন করে কী আর হবে— ভেবেছিলেন দাস-দম্পতি। শিবুর কথায়, ‘‘ভেবেছিলাম, ওরা ভয় দেখাতে পারে। বুথের রাস্তায় ফের গালিগালাজ করতে পারে। রাস্তা থেকে ফিরিয়ে দেওয়ারও চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু এত দূর যে যাবে, তা ভাবতে পারিনি।’’

বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১০টা নাগাদ স্ত্রী টুলটুলকে সঙ্গে নিয়ে ভোট দিতে বেরোন শিবু। কেউ যে তাঁদের নজর রাখছে, প্রথমে বুঝতে পারেননি। শিবু জানান, খানিক দূর এগোতেই তৃণমূলের কয়েক জন লোক তাঁদের পথ আটকায়। প্রথমে নিচু স্বরেই তারা তাঁদের বাড়ি ফিরে যেতে বলে। কিন্তু শিবু ভোট না দিয়ে ফিরতে রাজি হননি।

এর পরেই বীরপুঙ্গবেরা গলা চড়ায়। এক ভদ্রমহিলা যে সামনে রয়েছেন, তার পরোয়া করেনি তারা। বরং বাপ-মা তুলে, শ-কার ব-কার সহকারে গালিগালাজ চলতে থাকে। তাতেও শিবু অনড়। ফিরতে রাজি হননি তাঁর স্ত্রীও। বরং তাঁদের জেদ আরও চড়ে যায়, ভোট দেবই!

ফল হয় ভয়াবহ।

কাছেই সাজিয়ে রাখা বাঁশ তুলে শিবুকে বেধড়ক মারতে শুরু করে গুন্ডারা। হাত তুলে মাথা বাঁচাতে গেলে তাঁর ডান হাত ভেঙে যায়। মরিয়া হয়ে বাঁ হাত দিয়ে বাঁশ ঠেকানোর চেষ্টা করেন তিনি। ভাঙে বাঁ হাতও। বাঁশের বাড়ি পড়তেই থাকে। শিবু মাটিতে পড়ে যান। টুলটুল তাঁকে আড়াল করতে গেলে তাঁকেও চড়-থাপ্পড় মারা হয়। শেষে পুলিশ গিয়ে তাঁদের উদ্ধার করে।

তার পরেও বাড়ি ফিরতে কিন্তু রাজি হননি দাস দম্পতি। কল্যাণী জেএনএম হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে শিবুর দু’হাতে প্লাস্টার করানো হয় তাঁর। পরিচিতেরা বাড়ি ফেরার ব্যবস্থাই করছিলেন। কিন্তু বেঁকে বসেন টুলটুল। তিনি জেদ দেখিয়ে বলেন, ‘‘ওরা যখন মারলই, তখন আজ ভোট আমরা দেবই। ভয় পেলে ওরা আরও ভয় দেখাবে।’’

শিবু বলেন, ‘‘আমিও ঠিক করে ফেলেছিলাম, ওরা যখন মেরে হাত ভেঙেই দিল, সেই হাত নিয়েই ভোট দেব। ওদের চোখের সামনে দিয়ে গিয়েই ভোট দিয়ে এলাম।’’

এই সাহস দেখে আর কারও বাধা দেওয়ার মতো বুকের পাটা হয়নি। এমনকী তৃণমূলের কোনও নেতা এ নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়াও জানাতে চাননি। কল্যাণীর তৃণমূল প্রার্থী রমেন্দ্রনাথ বিশ্বাস শুধু বলেন, ‘‘এ নিয়ে কী আর বলব!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Assembly Election 2016 Injured Voter
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE