চার মাস আগের কথা। জানুয়ারি মাসের এক ঠান্ডা, মেঘলা দুপুরে ধর্মতলার প্যারাডাইস সিনেমার দোতলায় ওম মুভিজের অফিস সে দিন একেবারে নিঝুম।
অনেক আশা নিয়ে শাহরুখ-কাজলের ছবি, ‘দিলওয়ালে’র বেঙ্গল সার্কিট কিনেছিল এই ডিস্ট্রিবিউশন সংস্থা। কিন্তু প্রথম তিন-চার দিনেই তাঁরা বুঝে যান হাওয়া কোন দিকে।
ছবিটা থেকে তাঁদের নেট লস দু’কোটি টাকা। কী করে লোকসানের মাত্রা কম করা যায় এই নিয়ে তখন ক্রমাগত মিটিং চলছে অফিসে।
এর পরে যা ঘটে তা অকল্পনীয় এবং তার থেকে বোঝা যায় ‘দিলওয়ালে’ ফ্লপ হওয়ার পর ঠিক কতটা চাপে ছিলেন শাহরুখ। শুধু তাই নয়, এর পরের ঘটনাই শাহরুখ খানকে ইন্ডাস্ট্রির ‘বাদশা’ করে তোলে।
‘‘আমরা শাহরুখকে চিঠি পাঠিয়ে বলেছিলাম, আমাদের দু’কোটি টাকা লস হয়েছে। অন্য কোনও স্টারের ছবি যখন খারাপ চলে, তখন তাঁরা আমাদের বলে পরের ছবিতে ডিসকাউন্ট দেবেন এবং তাঁরা দেনও। কিন্তু শাহরুখ অন্য ধাতুতে গড়া। আমাদের শাহরুখ জানিয়েছিলেন যত টাকা লস হয়েছে, তার অর্ধেক উনি ফেরত দিয়ে দেবেন। কিন্তু ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এ রকম তো অনেক কথাই হয়। কিন্তু হঠাৎ একদিন দেখি আমাদের অফিসে একটা চেক এসেছে রেড চিলিজের তরফ থেকে। চেকের অ্যামাউন্ট এক কোটি টাকা। শাহরুখ শুধু এক কোটি টাকা ফেরতই দেননি, জাস্ট একটা চেকেই এত বড় অ্যামাউন্ট দেওয়ার ক্ষমতা যে উনি রাখেন সেটাও বুঝিয়ে দিলেন। এই না হলে শাহরুখ!’’ শনিবার সকালে বলছিলেন ওম মুভিজের সুনীত সিংহ।
এই ঘটনাটা যখনই মুম্বইয়ের বড় পরিচালক-প্রযোজকদের বলেছি, তাঁরা বিশ্বাসই করতে চাননি। তার কারণ মূলত দু’টো।
প্রথমত, শাহরুখ খান টাকা ফেরত দেওয়া মানে তিনি মেনে নিলেন ‘দিলওয়ালে’ ফ্লপ করেছিল। দ্বিতীয়ত, সঞ্জয় লীলা বনশালির ‘বাজিরাও...’য়ের সামনে নিজের ইগোকে এ ভাবে জলাঞ্জলি দেওয়া অন্তত শাহরুখের ধাতে যে নেই সেটা এত দিনে সবাই জেনে গিয়েছে।
এত কিছু সহ্য করার পর তাই তাঁর জীবনে ‘ফ্যান’ যে হয়ে উঠেছিল অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ একটা রিলিজ, সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল গোটা বলিউড। আজকে যখন ‘ফ্যান’ নিয়ে প্রথম সারির সব সমালোচক ‘বাহ বাহ’ করছেন, যখন আবার শাহরুখের অভিনয়ের প্রশংসা হচ্ছে, তখন একটা ব্যাপার পরিষ্কার।
শাহরুখ খান সিংহাসনে ফেরত।
এবং সবচেয়ে আশ্চর্য, শাহরুখের প্রত্যাবর্তন কিন্তু ঘটল অ-শাহরুখোচিত ভঙ্গিতে। এমন ছবিতে যেখানে শাহরুখের চেনা কোনও ‘ক্রাচ’ নেই। না আছে গান, না হিরোইনের সঙ্গে আইসল্যান্ডে রোম্যান্স। আছে শুধু একজন।
দিল্লির ‘গৌরব চান্দনা’। অবশেষে শাহরুখকে রোহিত শেঠিদের এয়ার পকেট থেকে যিনি বের করে আনলেন।
তাঁর ‘ফ্যান’।
‘‘‘ফ্যান’য়ে যেন নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করলেন শাহরুখ। আবার লোকে ‘ডর’ আর ‘আনজাম’য়ের শাহরুখকে ফিরে পাচ্ছে এই ছবিতে। হ্যাঁ, সেকেন্ড হাফটা যথেষ্ট গাঁজাখুরি কিন্তু শাহরুখ এটা অন্তত বুঝিয়ে দিয়ে গেল, ‘দিলওয়ালে’র পর ওঁর অবিচুয়ারি যারা লিখে ফেলেছিল তারা বড্ড তাড়াহুড়ো করেছিল,’’ বলছেন বলিউডের বিখ্যাত ট্রেড অ্যানালিস্ট তরণ আদর্শ।
শুধু তরণ নয়, শাহরুখ ঘনিষ্ঠ এক প্রযোজকও একই কথা বলছেন ‘ফ্যান’ দেখে। ‘‘হ্যাঁ, হয়তো ‘ফ্যান’ প্রথম দিন ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’ কী ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’য়ের মতো ২৫-৩০ কোটির ব্যবসা করেনি। হ্যাঁ, ছবির সেকেন্ড হাফ যথেষ্ট উইক কিন্তু বহু দিন বাদে যেন ‘স্বদেশ’ কী ‘চক দে ইন্ডিয়া’র শাহরুখ ফিরল বলিউডে,’’ বলছেন তিনি। এই কারণেই একটার পর একটা রিভিউতে প্রশংসার বন্যায় ভেসে যাচ্ছেন শাহরুখ খান। ময়াঙ্ক শেখরের মতো সমালোচক বলছেন, ‘চক দে’র পর এটা শাহরুখের সেরা অভিনয়’। অন্য দিকে খালিদ মহম্মদ বলছেন, ‘ফ্যান’য়ের চরিত্রে শাহরুখ টেরিফিক’।
শনিবার সকালে শাহরুখের ঘনিষ্ঠ মহলের বহু মানুষের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল অদ্ভুত একটা শান্তি যেন ফিরে এসেছে শাহরুখের অন্দরমহলে। সবাই বলছিলেন ‘দিলওয়ালে’ ভাল না করার পর বেশ কিছু দিন অফিসের কাজকর্মেও নাকি সে রকম মন ছিল না তাঁর। ‘‘রিলিজের পরে একটা ঘোরে থাকে সবাই। ‘দিলওয়ালে’র পরও তাই হয়েছিল। তারপর এই শহর, সেই শহরের প্রচারের সময় ভাবার অবকাশ থাকে না। কিন্তু দিন দশেক পরে আমরা বুঝে যাই মানুষ সেই ভাবে গ্রহণ করেনি ‘দিলওয়ালে’।
তার আগে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ কী ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’ নিয়েও খুব খুশি ছিলেন না শাহরুখ নিজে। পয়সা কামাচ্ছিলেন ঠিকই অথচ দর্শকদের ভালবাসা পাচ্ছিলেন না। কিন্তু ‘ফ্যান’ সেই দুঃখ আবার ভুলিয়ে দিয়েছে। এটা একটা কামব্যাক তো বটেই,’’ বলেন শাহরুখের ঘনিষ্ঠ এক সহকর্মী।
এই সহকর্মীর কাছ থেকে জানা গেল গত কয়েক বছর ফারহা খান আর রোহিত শেঠির সঙ্গে ছবি করা নিয়ে নাকি তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলেও যথেষ্ট ক্ষোভ ছিল। শাহরুখ নিজেও নাকি সোশ্যাল মিডিয়াতে তার আঁচ টের পাচ্ছিলেন। ‘‘আজকে ‘ফ্যান’য়ের পর মনে হয় অন্তত রোহিত শেঠিকে কিছু দিন আর মন্নতের ড্রয়িং রুমে দেখা যাবে না,’’ বলছেন শাহরুখ ঘনিষ্ঠ এক অভিনেতা।
শুধু তাই নয়। বলিউডের ট্রেড পণ্ডিতদের মত, বেশ কিছু বছর ধরে সলমন খান ক্রমাগত ১০০-২০০, ২৫০ কোটি টাকার ব্যবসা করে অসম্ভব চাপে ফেলে দিচ্ছিলেন কিং খানকে।
‘‘সলমন এক প্রকার বাধ্য করেছিল শাহরুখকে ‘নাম্বারস গেমে’ নিয়ে যেতে। শাহরুখের নিজের খেলাটাই বদলে দিয়েছিল সলমন। শাহরুখ গত কয়েক বছর যেন ছবি করছিল ৩০০ কোটি কামাবে বলে। তাতে ওঁর ফ্যানেরা খুশি হচ্ছিল না মোটেই। অবশেষে শাহরুখ নিজেকে ফিরে পেল ‘ফ্যান’য়ে। এটা হয়তো ‘বাজিগর’, ‘ডর’য়ের মতোই গুরুত্বপূর্ণ ছবি তাঁর কেরিয়ারের। ওই ছবিগুলো শাহরুখকে বলিউডের সিংহাসনে আসীন করেছিল। ২৩ বছর বাদে ‘ফ্যান’ আবার লাইফ লাইন দিয়ে গেল শাহরুখকে,’’ বলছেন বিশ্বস্ত ট্রেড বিশেষজ্ঞ আমোদ মেহরা।
শোনা যায়, ‘ফ্যান’য়ের আগে থেকেই নাকি নিজের স্ট্র্যাটেজি ধীরে ধীরে বদলাচ্ছিলেন শাহরুখ। সেই বদলানোর স্ট্র্যাটেজির ফলস্বরূপ তিনি এখন ছবি করছেন ‘ইংলিশ ভিংলিশ’ ছবির পরিচালক গৌরী শিন্দের সঙ্গে। ‘তনু ওয়েডস মনু’ এবং ‘তনু ওয়েডস মনু রিটার্নস’য়ের পরিচালক আনন্দ এল রাইয়ের পরের ছবিতেও কিংগ খান। এ ছাড়াও শাহরুখ যে নিয়মিত মিটিং করছেন ইমতিয়াজ আলির সঙ্গে এমনটাই খবর দিলেন তাঁর এক সহকর্মী। সঞ্জয় লীলা বনশালির সঙ্গেও আলোচনাতে দেখা যাচ্ছে তাঁকে।
নতুন এই পরিচালক দলের পাশাপাশি তাঁর পরের ছবি ‘রইস’য়ের পরিচালকের নামও যথেষ্ট ইন্টারেস্টিং। রাহুল ধোলাকিয়া। যিনি গুজরাত দাঙ্গার পটভূমিকায় বানিয়েছিলেন সেই বিতর্কিত ছবি ‘পরজানিয়া’।
সব মিলিয়ে নিজের পুরো টিমকেই যেন নতুন করে সাজাচ্ছেন শাহরুখ। যার প্রথম সিঁড়ি মণীশ শর্মা পরিচালিত ‘ফ্যান’।
যে কারণেই তেইশ বছর আগের রাহুলের সেই বিখ্যাত আর্তনাদ ‘কি... কি... কিরণ’য়ের পর আবার বলিউডে ফিরে এল ‘ফ্যা... ফ্যা... ফ্যান’।
ফিরিয়ে আনলেন ইন্দ্রবিহারের ‘গৌরব চান্দনা’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy