ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত।—নিজস্ব চিত্র
‘গুলাব গ্যাং’-য়ের পরিচালক সৌমিক সেন-য়ের নতুন ছবি ‘মহালয়া’-র কাজ নিয়ে তিনি ব্যস্ত। সঙ্গে শুরু হয়েছে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের নতুন ছবি ‘বিসর্জন’য়ের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের কাজ। টেবিল ভর্তি চাইনিজ কুইজিন নিয়ে গল্প করতে বসলেন ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত। তাঁর আঙুল ভর্তি নানান পাথরের আংটি।
ভাগ্যে খুব বিশ্বাস করেন?
আমি বরাবরই ভাগ্যে বিশ্বাস করি। সবাই কিন্তু ভাগ্যে বিশ্বাস করে, স্বীকার করতে ভয় পায়! (বলেই একটা স্পাইসি চিকেনে কামড় বসালেন)
এই ভাগ্যের ফেরেই কি চিরদীপ ‘ইন্দ্রদীপ’ হলেন? এখনও অনেকে জানেন না ‘মনের মানুষ’য়ের মতো সুপারহিট অ্যালবামের অ্যারেঞ্জার চিরদীপই হল ইন্দ্রদীপ?
(মুচকি হেসে) থাক না। শত্রুদের একটু কনফিউজ করা ভাল। তাতে আমাকে নিয়ে আগ্রহটা বাড়বে।
শত্রুদের কনফিউজ করা, জায়গা কেড়ে নেওয়া কি আপনার স্বভাব?
(খুব উত্তেজিত) এটা কিন্তু খবরের কাগজের লোকেরা বলে। এটা ভুল! দেখুন, জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা আমি সবসময় বলি। আমি তো মনে করি ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’-য়ের পর বাংলায় ফিল্মের গান জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্য একটা জায়গায় আসতে পেরেছে। এটা বললে হয়তো অনেকেই রেগে যাবে। তবে এটাই সত্যি। আর কেউ কারও জায়গা নিতে পারে না। অনুপম(রায়) যা পারে, আমি পারব না। আমি যা পারি অনুপম বা জিৎ পারবে না। অনুপম গান গায় আবার লেখেও। ও একটা ধারার। আমার অবশ্য কোনও ধারা নেই। আমি ঝালে-ঝোলে-অম্বলে সবেতে আছি।
এক সময় চিরদীপের হাত দিয়েই কিন্তু অজস্র প্রাইভেট বাংলা গান বাজারে এসেছিল…
হ্যাঁ, ঠিকই। মনে আছে ‘মনের মানুষ’ করার সময় শ্রীকান্তদা(আচার্য) হারমোনিয়াম বাজিয়েছিল। জয়(সরকার) গিটার ধরেছিল। তখন অন্য রকম একটা পরিবেশ ছিল। জয়েরও দারুণ অ্যালবাম আছে কিন্তু। রাঘব ‘সারেগামা’ থেকে প্রথম অ্যালবাম করল, আমাকে নিয়েছিল। তখন কিন্তু আমার কোনও পরিচিতি হয়নি। তাও ও যে আমায় নিয়েছিল, এর জন্য আমি কৃতজ্ঞ। কী সব গান তৈরি হয়েছিল আগে! যাই হোক, এখন সবাই আমাকে আইডি নামেই জানে।
আগে তা হলে বাংলা গানে স্বর্ণযুগ ছিল, এখন নেই বলছেন?
না, একদম বাজে কথা। বলুন তো, ঠিক কোন সময় থেকে কোন সময়টা ‘গোল্ডেন এরা’? কেউ জানি না আমরা! দেখুন, এ আর রহমান, অমিত ত্রিবেদী, অনুপম রায়, জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, চন্দ্রবিন্দু, এই সময়ের! এই সময়েই কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, সৃজিত মুখোপাধ্যায়, রাজ চক্রবর্তীর মতো পরিচালক কাজ করছেন! কাজ হচ্ছে তো! কমলেশ্বর ‘চাঁদের পাহাড়’ করতে পেরেছে। আগে কি কেউ এভাবে ‘চাঁদের পাহাড়’ ভেবেছিল? যে যার মতো করে চেষ্টা করছে।
আপনি যেমন। রোজ বড় প্রোডাকশন হাউসের অফিসে বসে থাকেন কাজ পাওয়ার জন্য।
আপনি দেখছি নাছোড়বান্দা! (হেসে) আমার শরীরটা এত ভারী না, যেখানেই যাই, বডি ফেলে দিই। সিলমাছের মতো।
আপনি কথা এড়িয়ে যাচ্ছেন!
না, আমি প্রায়ই নামী প্রোডাকশন হাউসের অফিসে যাই। আমার বাড়ির খুব কাছে ওটা। ওখানে সবাই আমার বন্ধু। তাই যাই।
আর অন্যের ভাত মারেন...
মোটেও না। আমি কি ওই প্রোডাকশন হাউসের সিকিউরিটি গার্ড যে অন্য সঙ্গীত পরিচালকদের ঢুকতে দেব না? অন্য সঙ্গীত পরিচালকরাও তো ওখানে দিব্যি কাজ করছেন! আমি কাঠি করায় বিশ্বাসী নই।
কিন্তু ফস করে অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়ের মতো সঙ্গীত পরিচালককে ‘চোর’ বলায় বিশ্বাসী?
এটা ঠিক নয়। আমি এক সাংবাদিক বন্ধুর পোস্ট রিটুইট করেছিলাম এটা বোঝাতে যে, কোনও গান হবহু টোকা ঠিক নয়। গান তৈরির ক্ষেত্রে কারও বা কোনও কিছুর প্রভাব থাকতে পারে, তা বলে হবহু টোকা? এটার বিরুদ্ধে ছিলাম। আমার সঙ্গে কারও প্রতিযোগিতা নেই। আমি আমার তালে চলি।
প্রতিযোগিতা নেই, এটা হতে পারে?
প্রতিযোগিতা করলে মদন মোহন, শচীনদেব বর্মন, আর ডি বর্মনের সঙ্গে করব। আরেকটা কথা বলি, ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তই বোধহয় একমাত্র সঙ্গীত পরিচালক যে গানের সব ক’টা জঁর নিয়ে কাজ করতে পারে।
শুনেছি আপনি টাকা পেলে যে কোনও ছবিতে কাজ করেন!
দেখুন, আমি আগে মানুষ। তার পর আর্টিস্ট। আমারও কমিটমেন্ট আছে। ২০১১-১২ সালে পয়সা দিলেই আমি কাজ করতাম। এখন আর করি না।
মানে আপনি বাংলা সিনেমার সব সঙ্গীত পরিচালককেই এককথায় গোল দিতে পারেন?
এ কেমন কথা! আমি কী সেটা দর্শক বলবে। তবে আমি কিন্তু ‘সিনেমাওয়ালা’ থেকে একেবারে কমার্শিয়াল ছবি — সব জায়গায় মিউজিক করতে পারি।
তা হলে মুম্বই যাচ্ছেন না কেন?
হ্যাঁ। চলে যাব শিগগির! ভলিউম অব ওয়ার্ক ওখানে বেশি। কাজ করার লোকও বেশি। মুম্বইতে রোজ ভয় পায় ওরা, বাদ পড়ে যাব ভেবে। নীতি মোহন, পালক, ওরা কিন্তু দারুণ গাইছে। তবে এখন একটা হাওয়া উঠেছে। একটা গান হিট করলেই লোকে মাতামাতি করছে। একটা গানে স্টার হওয়া যায় না। মোহিত চৌহান আজ কোথায় বলুন তো?
আপনি কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবিতেও সুর দেন। আবার ‘লে ছক্কা’-র সুরও করেন। মিউজিক ডিরেক্টর হিসেবে কতটা কম্প্রোমাইজ করতে হয়?
কম্প্রোমাইজের জায়গা নেই তো। আমি লুঙ্গি ডান্সের মতো গান করতে চাই। যদি দু’টোই পারি, কেন করব না বলুন তো? এখন তো কমার্শিয়াল ছবিতে আরও বেশি কাজ করতে চাই। ডুব দিয়ে দেখি না, সাঁতরাতে পারি কি না। আরডি বর্মনও তো ‘কাঁটা লাগা’ করেছেন। লক্ষ্মীকান্ত করেছেন ‘চোলি কে পিছে কেয়া হ্যায়’।
আর শুনুন, বসিরহাটের মাছওয়ালা আমার ‘অপুর পায়ের ছাপ’ শুনবে না। তার কাছেও তো আমি পৌঁছতে চাই। আগে তো সিনেমা ওই অবধি পৌঁছতই না।
কী বলছেন! লোকে তো সেই কবে থেকে উত্তম-সুচিত্রার ছবির গান শুনছে, আজও শোনে।
আমরা শহরের রিপোর্ট পাই। আমরা কি একেবারে ইন্টিরিয়রে গিয়ে দেখেছি? উত্তম-সুচিত্রার ক’টা গান গ্রামের মানুষ জানে? জেন ওয়াই উত্তম-সুচিত্রার ক’টা গান জানে? একটা সময় একেকটা লিসনিং শেষ হয়। তার মধ্যে কিছু মানুষ আছে যারা বরাবরই উত্তম-সুচিত্রা শুনবে।
সব জায়গায় পৌঁছনোর জন্য আপনি প্রাইভেট অ্যালবামের কথা ভাবছেন না?
পঞ্জাব ছাড়া এখন কোথাও প্রাইভেট অ্যালবাম চলছে না। গজলের অবস্থা দেখুন! পিনাজ মাসানি, পঙ্কজ উদাস — কত গায়ক ছিলেন। এখন কোথায় তাঁরা? এখন এন্টারটেনমেন্টে ফিল্ম মিউজিকের জয়জয়কার। কিন্তু অলটারনেটিভ কালচারেরও প্রয়োজন আছে। তবে দু’টোতেই ক্রিয়েটিভিটি সমান, বরং সিনেমায় গান তৈরি করা আরও শক্ত।
আজকের গানের তো আয়ু নেই!
কে বলল নেই? আজও সেই ‘চ্যাপলিন’ থেকে ‘লে ছক্কা’ বেজেই চলেছে। আয়ু না থাকলে রেডিয়ো স্টেশনগুলো চলতই না। তবে আগের চেয়ে সময় বদলেছে। এখন ইউটিউবের যুগে গান আপলোড করুন। লোকে নিলে আপনি পাশ, না হলে ফেল, এটা মেনে নিতেই হবে।
সবটাই তা হলে মেশিন-মেড সিঙ্গার?
সবটা নয়। অরিজিৎ সিংহ ভাবুন। হিরের চমকানি থামানো মুশকিল। পৃষ্ঠপোষকরা ঠিক রতন চিনে নেবে। অরিজিৎ বহুগুণসম্পন্ন। পিছনে থাকতে পছন্দ করে। এখনও হাওয়াই চটি পরে ঘোরে। সেটা শো অফ নয়। জিয়াগঞ্জের সেলুনে চুল কাটে। নিজেকে ভাঙাগড়ার মধ্যে রাখে, আরও অনেক এগোবে। আমার এত ট্যালেন্ট নেই। খাবারের উদাহরণ দিয়ে আর একটু বলি?
বলুন না…
(এগর্যাপড রাইস খেতে খেতে বললেন) সব রকম গান থাকবে। আসলে মেনকোর্স, স্টার্টার, স্যুপ সবেরই দরকার।
জীবনের মেনকোর্সটা কী রকম সাজাচ্ছেন? বিয়ের কথা ভাবছেন?
পাগল নাকি! ৪৪ বছরে বিয়ে করব? আগে তো কেউ বিয়ে করল না। করলে করতাম।
চল্লিশের পর তো জীবন শুরু...
(চিংড়ি মাছ খেতে খেতে বললেন) চিংড়ি ভালবাসি। চিংড়ি মাছ দেখে চারটে খেয়ে ফেললাম। তার পর ভয়ঙ্কর অ্যালার্জি হল। তখন তো অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। (একগাল হেসে) একা থাকাই ভাল। নিজের টার্মে চলি। বিয়ের আর দরকার নেই। বন্ধুত্ব ভাল লাগে।
জাম্বো প্রন, এগর্যাপড রাইস, ফিশ — এলাহি খাওয়ার মতো আপনার মিউজিকের বাজেটও নাকি এলাহি?
হ্যাঁ, বাজেট প্রবলেম হয়। কিন্তু শুনুন, জুতোর সুখতলা খুইয়ে নিজেকে দাঁড় করিয়েছি। দিনের পর দিন গালে হাত দিয়ে বসে থেকেছি, মিউজিক করেছি, নাম যায়নি। যে রকম কাজ করব সে রকমই তো দাম হবে।
বাজেট প্রবলেমেই কি একবার শিবপ্রসাদের সঙ্গে কাজ করেননি?
ওই সময়টা ছেড়ে এসেছি। খারাপ মোড়গুলোতে যেতে চাই না। ‘না’ বলতেও হয় মাঝে মাঝে।
আপনিও তো প্রচুর শিল্পীকে না বলে দেন...
হ্যাঁ, আমাকেও অনেককে বাদ দিতে হয়। এই ট্রেন্ডটা মুম্বই থেকে চালু হয়েছে। এক জন গায়ককে দিয়ে রেকর্ড করে দেখা গেল তার টোনাল কোয়ালিটি ম্যাচ করছে না। তখন তো তাকে ‘না’ বলতে হয়। খারাপ লাগে।
শুনেছি, আপনি খুব রাগী...
মুখের উপর সত্যি কথা বলে দিই। তবে ইদানীং রাগ কমিয়েছি। আগে রূঢ়ভাবে বলতাম। আই ওয়াজ লেস সিভিলাইজড। বন্ধুদের কথা শুনে শুধরেছি।
সৃজিত মুখোপাধ্যায়, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ করেন, হ্যান্ডেল করেন কীভাবে?
আমি ওদের বন্ধু। দু’জনেই খুব ভাল পরিচালক। কৌশিকদা কম কথা বলে। কিন্তু অনেক কিছু বলে। যদিও সৃজিতই ‘নির্বাক’ বানিয়েছে (হাসি)। ও যতগুলো কথা দিয়ে বলতে হয় বলবে। দু’জনের দেখার স্টাইল আলাদা, কিন্তু দু’জনেই জানে কী বলবে, কতটা বলবে। সৃজিতের গান ওর সংলাপকে রিপ্লেস করে।
আপনার প্রেমও তো নানাভাবে রিপ্লেসড হয়। বৌদি...গায়িকা। সিঙ্গাপুরের বান্ধবী।
এ কী! এ সব কে বলল? (লাজুক মুখ করে) তবে সুন্দরী মহিলাদের সব সময় ভাল লাগে।
ইদানীং এক গায়িকার প্রেমে পড়েছেন নাকি?
আরে! এত সহজে প্রেম হয় না। কাউকে পছন্দ হল, সময় কাটালাম, ঠিক আছে। আরও একটা কথা বলি। শুনুন, পছন্দ করার সঙ্গে গান গাওয়ানোর কোনও সম্পর্ক নেই। আমি এটাই মানি। আমার চরম শত্রু ভাল গাইলে তাকে দিয়েও গাওয়াব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy