বসিরহাটে তাঁর বাড়ির পুকুরে। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।
‘প্রাক্তন’য়ে আপনার অভিনয় নিয়ে চারিদিকে জোর আলোচনা...
থ্যাঙ্ক ইউ। থ্যাঙ্ক ইউ। আসলে ‘সুবর্ণলতা’ সিরিয়ালের পর শহুরে দর্শকের কাছে আমার একটা দারুণ পরিচিতি হয়েছিল। এর আগে ‘উড়ো চিঠি’ কি ‘অলীক সুখ’য়ে মানুষ আমার অভিনয়ের প্রশংসা করেছিল। ‘প্রাক্তন’ সেটাকে জাস্ট অন্য লেভেলে নিয়ে গেল। মানুষের রিঅ্যাকশন মারাত্মক। বহু মানুষ আইডেন্টিফাই করতে পেরেছে আমার ক্যারেকটারের সঙ্গে। আমার জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছবি হিসেবে থাকবে ‘প্রাক্তন’।
হ্যাঁ, কিন্তু এর পাশাপাশি অনেকে এটাও বলেছে আপনি বেশি ‘লাউড’। বড্ড বেশি চড়া মাত্রায় অভিনয় করেছেন...
হ্যাঁ, আমার কানেও এসেছে কথাটা। আমি একটা কথা বলতে পারি?
শিওর।
আমি মনে করি ‘প্রাক্তন’য়ে আমার পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় নিজে একজন অত্যন্ত কনফিডেন্ট অভিনেতা। আমি শুধু ওঁর ব্রিফ ফলো করে গিয়েছি। উনি আমাকে যে রকম করতে বলেছেন আমি সেই রকম করেছি। আর দর্শকের রিঅ্যাকশন প্রমাণ করে দিয়েছে শিবপ্রসাদ ওয়াজ রাইট।
এখানে ইন্টারভিউয়ের আগে দেখছিলাম কফি শপে আপনার সঙ্গে সেলফি তোলার বিরাট ভিড়। মেয়েরা অটোগ্রাফ নিচ্ছে।
কী বলব বলুন, মানুষের আশীর্বাদ। মফস্সলের ছেলে...
আপনার বাড়ি তো বসিরহাট?
হ্যাঁ, বাড়ি বসিরহাট কিন্তু আমার জন্ম বর্ধমানে। আমি আদ্যোপান্ত গ্রামের ছেলে। আম, কাঁঠাল, ভাদ্র মাসে তাল, স্কুল, মারপিট — এই ছিল আমার জীবন। বাড়িতে একা থাকলে যে বিয়ার খেতে হয় আর বান্ধবীদের ফোন করতে হয়, এটা আমি কলকাতায় এসে জেনেছিলাম। এই গ্রামের জীবনই আমার সব ছিল এক সময়। আর ছিল স্বামী বিবেকানন্দর সঙ্গে দারুণ একটা যোগাযোগ। আমি আজও নিয়মিত রামকৃষ্ণ মিশনে যাই। এক সময় সংসারও ছেড়ে দেব ভেবেছিলাম।
এ রকম একটা পরিবেশ থেকে সিনেমার পরিবেশে চলে আসাটা সহজ ছিল ?
না। আমি গ্রামের বাড়ি ছেড়ে স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়তে আসি। তখন ব্যারাকপুরে থাকতাম। স্কটিশে এসে দেখলাম শহরটা কতটা আলাদা। এখানে মেয়েদের সঙ্গে ধাক্কা লাগলে মেয়েরা গালাগালি করে না। এমন পরিবেশে বরানগরের একটা নাটকের গ্রুপ, ‘আগামী’তে নাটক করা শুরু করলাম। আমার এক দাদা ছিল, পল্লব ঘোষ। উনি আমাকে শুভাশিস মুখোপাধ্যায়ের কাছে পাঠান। শুভাশিস যে আমাকে বিরাট কাজ দিয়েছিলেন এমন নয়, কিন্তু উনি আমাকে বাঁচতে শিখিয়েছিলেন। আমাকে বুঝিয়েছিলেন অভিনেতার জীবনে সেভিংস কতটা ইম্পর্ট্যান্ট। শুভাশিস যদি আমার বাবা হন, তা হলে আমার মা অবশ্যই খরাজ মুখোপাধ্যায়।
আপনাকে তো অনেকে বলেন খরাজ মুখোপাধ্যায়ের ক্লোন?
ক্লোন নই। হওয়ার চেষ্টা করছি খরাজ মুখোপাধ্যায়ের ক্লোন। অত বড় অভিনেতা তো, ক্লোন হতেও সময় লাগে। খরাজদা আমাকে প্রচুর কাজ দিয়েছিলেন সেই সময়। ডাবিং করতে শিখিয়েছিলেন। আর একজন আমাকে প্রচুর সাহায্য করেছিল। রুদ্রনীল ঘোষ। সেই সময় আমাকে দেখলে আত্মীয়রা ঘামতে শুরু করত। ভাবত, ওরে বাবা কত দিন থাকবে! সেই সময় রুদ্র আমাকে ওর বাড়িতে থাকতে দিয়েছিল। আর সেই সময় কাঞ্চনদা আমাকে একটা কথা বলেছিল। বলেছিল, “পল্টু, দুমদাম করে বেশি টাকা চাস না, একদিন টাকা আমরা ঠিক বানিয়ে নেব।”
আজ পিছনে ফিরে তাকালে মনে হয় সবটাই সিনেমা।
আপনার বড় ব্রেক তো ‘ধ্যাততেরিকা’?
হ্যাঁ, কিন্তু তার আগের সময়ে সাঙ্ঘাতিক স্ট্রাগল ছিল। আমি আজকে ধন্যবাদ দিতে চাই সেই ব্যারাকপুরের সাইকেলের দোকানের মালিককে, যিনি আমাকে ৭৫ পয়সায় তাঁর টেলিফোন বুথ ব্যবহার করতে দিতেন। সে রকম বহু মানুষ আছেন...
তাঁদের সঙ্গে দেখা হয় আপনার?
শো করে ফেরার পথে অনেক রাতে আমি মাঝেমধ্যে গাড়িটা ব্যারাকপুরে দাঁড়াতে বলি। দেখা করি ওঁদের সঙ্গে। নিজের সেই সব দিনগুলো ভাবলে কান্না পায়। তবে ‘ধ্যাততেরিকা’ ছাড়াও সেই সময় আমাকে পরিচিতি দিয়েছিল ‘এক নম্বর মেস বাড়ি’, রানাদা আর সুদেষ্ণাদি-র ‘পুলিশ ফাইল’য়ের একটা গল্প।
লোকে বলে খাওয়া ছাড়া আপনার একটাই নেশা: ফ্ল্যাট কেনা।
আমি কলকাতায় থাকার জন্য এত লোকের মুখ-ঝামটা শুনেছি যে, নিজের বাড়ি থাকার গুরুত্বটা আমি জানি। ২০০৭ সালে পাটুলিতে একটা ফ্ল্যাট কিনি। পরে আর একটা ফ্ল্যাট কিনি কালিকাপুরে। বাড়ি না থাকার কষ্ট কী জিনিস, যাদের বাড়ি নেই তারাই বুঝবে।
আচ্ছা, লোকে বলে, এত ভাল অভিনেতা হওয়া সত্ত্বেও এখনও আপনি হিরোর বন্ধুই থেকে গেলেন ।
আমি তাতেই খুশি তো। আমি যখন হিন্দি ছবি দেখতাম তখন পরেশ রাওয়ালের দিকেই চোখ চলে যেত। বাংলা ছবিতে আমার তরুণকুমারকে দারুণ লাগত। আমি ওই বন্ধুটা, ওই ভাইটা হয়েই খুশি। আর দেখুন, আমি প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বহু শো করেছি। ওর মতো ডেডিকেশন আমার নেই। আমি দিনের পর দিন স্যাঁকা পাঁউরুটি খেয়ে চিরঞ্জিতের মতো চেহারা রাখতে পারব না। ওই অধ্যবসায় আমার নেই। আমি এতেই খুশি। আজও হাসনাবাদ থেকে দিঘা, ফলতা থেকে কোচবিহার — বহু মানুষ আমাকে ভালবাসে। শীতকালের বহু রাতে তারা আমার জন্য অপেক্ষা করে। এ ছাড়া আমেরিকাতেও দেখেছি আমাকে ওখানকার বাঙালিরা চেনে। আর কী চাই বলুন তো জীবনে। আমি সত্যিই খুব হ্যাপি।
টাচউড। আসলে এত অভিনেতার ইন্টারভিউ করি, কাউকে আপনার মতো এত হ্যাপি দেখি না। এটা অভিনয় নয় তো?
একদম অভিনয় নয়। আমি জীবনে সব পেয়ে গেছি। খুব স্বপ্ন ছিল অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে কথা বলব। ‘ওপেন টি বায়োস্কোপ’য়ের মিউজিক লঞ্চে ট্রেলর দেখে অমিতাভজি আমাকে বললেন, ‘‘হে ইউ, বেস্ট অব লাক।’’ আমার কাছে ওর থেকে বড় মোমেন্ট কী হতে পারে, বলুন?
একটা সময় মিঠুনদার ছবি দেখতাম ভিডিয়োতে আড়াই টাকা দিয়ে। সেই মিঠুনদা একবার আমাকে আনতে নিজের মার্সেডিজ পাঠিয়েছিল। মার্সেডিজটায় উঠে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম।
বুঝতে পারছি আপনার ইমোশনটা…
হ্যাঁ, আর আমার মা একটা কথা বলেছিল, যেটা আমি আজও মানি। মা বলত, এক থালা ভাত হজম করতে পারিস আর মানুষ একটু কথা শোনালে সেটা হজম করতে পারিস না? আমার কাছে জীবনে সফল হওয়ার এর থেকে বড় কোনও মন্ত্র নেই।
অনেকের কাছে শুনেছিলাম, আপনার নাকি সে রকম কোনও বন্ধুই নেই ইন্ডাস্ট্রিতে?
বিশ্বনাথের অনেক বন্ধু আছে। কিন্তু ‘পল্টু’র হয়তো তেমন বন্ধু নেই। পল্টু নিজের জীবন নিয়ে খুশি। পল্টু আর প্রেম করতে চায় না। সে তার বউকে নিয়ে খুব খুশি। তার দু’টো বাচ্চা, তাদেরকে মানুষ করাটা পল্টুর স্বপ্ন। পল্টু তার নিজের ভাইকে ভাল করে রাখতে চায়। আর একটা কথা বলি?
আপনার ইন্টারভিউ, আপনি তো বলবেন...
আমি না অত সাহেবি মারপ্যাঁচ বুঝি না। আমি ডাস্টিন হফম্যানকে চেনার আগে তুলসী চক্রবর্তীকে চিনেছি। আমি অড্রে হেপবার্নকে দেখার আগে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে দেখেছি।
আমি এই ভাবেই সাধারণ মেজাজে জীবনটা কাটাতে চাই। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ অন্যদের জন্য থাক, আমার ‘বর্ণপরিচয়’ হলেই হবে। আর ‘বর্ণপরিচয়’টা ঠিক থাকলে একদিন ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ ঠিক বুঝে নেব।
আজকে তো কোনও এক বসিরহাটে কেউ একজন বিশ্বনাথ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। তাকে কী উপদেশ দেবেন?
বলব, ধৈর্য রাখো। নিজেকে তৈরি করো আর আমার মায়ের কথাটা মনে রেখো। ‘ভাত হজম করে দিচ্ছিস অনায়াসে, একটু লোকের কথা হজম করতে পারবি না?’ একদিন দেখবে সময় পাল্টাবেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy