তাঁর হাতিয়ার, খাঁটি বাংলা উচ্চারণের ইংরেজি কলকলানি আর ‘হনুমান টুপি’! বাঙালিয়ানার এই সিলমোহরটুকু নিয়েই দেশে-দেশে ঘুরছেন জনৈক ‘বেঙ্গলি আন্টি’।
কিংবা ইংরেজি-বাংলার মিশেলে, নতুন বছরে ‘পিএনপিসি’ বা পরনিন্দা-পরচর্চা কমানোর শপথ নিচ্ছেন গোলগাল আহ্লাদি এক বঙ্গললনা। নেটদুনিয়া তথা ইউটিউব, ফেসবুকে ঝড় তুলেছে বাঙালির এ হেন অবতার।
বাঙালিয়ানা নিয়ে এমন ফুরফুরে হাসি-মস্করা আর কলকাতার পাড়ার রোয়াকে, ট্রাম-বাসে আটকে নেই। সে এখন দেশ-বিদেশে সর্বত্রগামী। বাঙালি বলতেই নেতাজি, স্বামীজিগোছের ভাবমূর্তি একদা লোকের মনে পড়ত। দিদি-অবতারটিও অনেক দিন চলছে। এই ডিজিটাল আঙ্গিকের জমানা বাঙালিয়ানা-চর্চার নতুন মাঠ খুলে দিয়েছে।
বছর দুই আগের পয়লা বৈশাখেই বাঙালির ‘সর্বরোগহর’ এক মলম-প্রীতি নিয়ে মজাদার গান বেঁধে নজর কাড়েন মুম্বইবাসী শাওন দত্ত। ইংরেজি লিরিক, কিন্তু গায়কী বাঙালি। এর পরে বাঙালির শীতকাতুরেপনা, পেটের রোগের ব্যারাম থেকে মাছের ঝোল, আলুপোস্ত, চিংড়ি-ইলিশ, পিঠে-পায়েস প্রীতি নিয়ে ‘বাংরেজি’ গানে পরপর বাঙালিয়ানার ভিডিয়ো-ইস্তাহার। শাওন হাসছেন, ‘‘আমার মরাঠি, কোঙ্কনি, পার্সি বন্ধুরাও এখন মাছের ঝোল, কষা মাংসর প্রেমে পড়েছে!’’ বিদেশ ভ্রমণরত বাঙালি মাসিমা বা পিসিমাটি নববর্ষে বাঙালিকে শাওনেরই উপহার। অধুনা দিল্লিতে রকমারি নেট-বিজ্ঞাপন তৈরিতে ব্যস্ত দেবীপর্ণা চক্রবর্তী ওরফে দেবীও ভালই জনপ্রিয়। বাঙালির বিচিত্র বাতিক থেকে নানা কিসিমের বাংলা অপশব্দও তাঁর দৌলতে নেটদুনিয়ায় সাড়া ফেলেছে। বাঙালি খানা নিয়ে ভিডিয়োয় লুচির মহিমায় উত্তর ভারতের পুরি-ভাটুরাকে দুরমুশ করছেন দেবী। দেখে বহু বিশিষ্ট বাঙালিও সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মারকুটে ব্যাটিং দেখার উত্তেজনায় হাততালি দিচ্ছেন।
হাসছেন বিপণন তথা বিজ্ঞাপন বিশেষজ্ঞ রাম রায়ও। ‘‘পাগড়িধারী গুঁফো মহারাজা বা মাখনের ব্র্যান্ডের ঝুঁটিওয়ালা মেয়েটার মতো বিজ্ঞাপনী চরিত্রদের মনে পড়ছে। তবে আজকের ভিডিয়োগুলোর আঞ্চলিক মেজাজটা তখন ছিল না।’’ গুজরাতি, পঞ্জাবি, তামিলভাষী— সকলের জন্যই অবশ্য নেটপাড়ায় নতুন খোরাক জন্ম নিচ্ছে। রামের কথায়, ‘‘বাংলা জানে, বোঝে এমন বাজারটাও ছোট নয়। বিজ্ঞাপন, বিপণনের দাবি মেনেই এ সব ঘটছে। আবার অ-বাংলাভাষীরাও তা উপভোগ করছেন।’’
এ বাঙালি কিন্তু নিজেকে নিয়ে হাসতে জানে। নেটে ‘দ্য বং সেন্স’ বা ‘বংগাই’-এর খোঁজ করলেই বাঙালিয়ানার গন্ধমাখা নিখাদ বিনোদন। ল্যাদখোর বাঙালি মেয়ের সঙ্গে মায়ের চিরকেলে খিটিমিটি, দেওয়ালে টিকটিকি দেখে খুদে পড়ুয়ার ফাঁকিবাজি কিংবা ছুটি না পেয়ে অফিসে বসের উপরে চোটপাট— এ সবই নেট-রসিকতার অঙ্গ। চেনা গান-সিনেমা নিয়ে ঠাট্টা বা কলকাতার নতুন কফিশপ নিয়ে আদিখ্যেতাও বাদ পড়ছে না। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া ‘বংগাই’ কিরণ দত্ত, বাংলা ব্যান্ডের শিল্পী ‘ডিজে বাপন’ ওরফে অনিন্দ্য চক্রবর্তী বা দিল্লির চাকরি ছেড়ে আসা ‘ওয়ান্ডার মুন্না (ইন্দ্রাণী বিশ্বাস) অল্প দিনেই নেটপাড়ার জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। অ্যানিমেশন-শিল্পী উপমন্যু ভট্টাচার্য নিজের খেয়ালেই কলকাতার পথেঘাটের চেনা মুখগুলোর ছবি এঁকে ইনস্টাগ্রামে দিতে শুরু করেছিলেন। কলকাতার খুদে স্কুলপড়ুয়া ও তার মা, কিংবা অসুস্থ নেড়িকুকুরের সেবায় পথশিশুদের জুলজুলে চোখগুলোও দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা বাঙালি মনে মায়া-কাজল বুলিয়ে দিচ্ছে।
বাঙালিয়ানার এই নেট-খিচুড়িতে রাজনীতির মশলাটা অবশ্য এখনও গরহাজির। তবে সর্ষের তেল, মাঙ্কিক্যাপ বা মাছ নিয়ে বাড়াবাড়িটা কারও কাছে ক্লিশে ঠেকছে। লাইক, শেয়ারের বন্যা বইলেও জনপ্রিয়তা ধরে রাখাটা নেটের ‘বং-চরিত্র’দের জন্যও কঠিন লড়াই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy