পাওলি, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ও অনন্যা চট্টোপাধ্যায়
জীবনে বাঁচতে গিয়ে আমরা কখনও কখনও কাউকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করি। আবার কখনও নিজেরাই হয়ে যাই টোপ। শিকার আর শিকারির আশ্চর্য রোমহর্ষক এই সম্পর্ক, যা আমাদের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে।
আর সেই রোমহর্ষক সম্পর্ক নিয়েই পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের পরের ছবি ‘টোপ’। প্রযোজক পবন কানোরিয়া। ছবিতে অভিনয় করছেন পাওলি, অনন্যা চট্টোপাধ্যায়, সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়, চন্দন রায় সান্যাল, মালবিকা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ছোট গল্পের সূত্র ধরে বুদ্ধদেব ফের ফিরছেন তাঁর প্রিয় লোকেশন পুরুলিয়ায়। বুদ্ধদেবের ছবি আর পুরুলিয়ার নিসর্গ ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে।
গল্পের প্রেক্ষাপট ষাট কী সত্তর বছর আগের হলেও চিত্রনাট্যকে সমসাময়িক করে তুলেছেন পরিচালক। বললেন, ‘‘আজকের সময়ে বেঁচে থাকতে গেলে হয় ব্যবহৃত হতে হয়, নয় ব্যবহার করতে হয়। ব্যবহার করার ব্যাপারটা কখনও ব্যক্তিগত, কখনও প্রাতিষ্ঠানিক, কখনও বা রাজনৈতিক। ব্যবহৃত হওয়ার সময়ে যাঁরা মাথা ঝোঁকাতে চান না তাঁদেরকে অনেক সময় দামও দিতে হয় প্রচুর। তবুও তাঁরা মাথা নোয়ান না। শিকার আর শিকারির অবিরাম এই খেলাকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যই আমার এই ছবি। অনেক টানাপড়েনের মধ্যেও আমি কখনও নিজেকে টোপ হিসেবে ব্যবহৃত হতে দিইনি। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে ‘টোপ’ তাই আমার কাছে জরুরি একটা ছবি।’’
বুদ্ধদেব এখন ব্যস্ত ‘টোপ’য়ের চিত্রনাটা গড়তে। বললেন, ‘‘বহু বছর ধরে এই গল্পটা নিয়ে ছবি করব ভেবেছি। কখনও এগিয়েছি, কখনও পিছিয়েছি। মনে হয়েছে না, এখন নয়। এখনই এ ছবি করার সময় আসেনি। ভাবতে ভাবতে এত দিনে মনে হল সঠিক সময় এসেছে এ ছবি করার। শিকার আর শিকারির সম্পর্ক এখন প্রবল। গত দেড় বছর ধরে চিত্রনাট্য নিয়ে তোড়জোড় চলছে। এখনকার সেন্সর বোর্ডে অনেক রকম বিধিনিষেধ আছে। সেগুলো মাথায় রেখে চিত্রনাট্য লিখছি বলেই এতটা সময় লেগে গেল।’’
পাঁচটি শ্রেষ্ঠ ছবির জাতীয় পুরস্কার, দুটি শ্রেষ্ঠ পরিচালকের জাতীয় পুরস্কার সহ অসংখ্য দেশি ও বিদেশি পুরস্কার পাওয়া বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কাছে ছবি করাই হোক বা চিত্রনাট্য লেখাই হোক—সবটা এখনও একটা চ্যালেঞ্জ। শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপার দৌড়ে অনেক এগিয়ে বলেই তাঁর ছবির কাছে দর্শকের প্রত্যাশাও বেশি। বললেন, ‘‘আমার ছবির কাছে দর্শকের প্রত্যাশা অনেক বলেই ভয় পাই। সারা পৃথিবীতে এখন অনেক ভাল ভাল ছবি তৈরি হচ্ছে। কেবল সিনেমা করার জন্য সিনেমা তৈরির কোনও মানে নেই। যদি না সে ছবি সময়কে পেরিয়ে থেকে যায়।’’
এ ছবির মুখ্য শিকারির চরিত্রে বুদ্ধদেব প্রথমে নেবেন ভেবেছিলেন সঙ্গীত পরিচালক শান্তনু মৈত্রকে। কারণ ওঁর মুখের মধ্যে নানা ধরনের ভাবের প্রকাশ ঘটানো সম্ভব বলেই তাঁর মনে হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি। শান্তনু যেহেতু আগে কখনও অভিনয় করেননি তাই তিনি কোনও উচ্চবাচ্য করেননি। মুখ্য চরিত্রে এসেছেন সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়।
কে এই সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়? ইন্টারনেট দেখতে দেখতেই ওঁকে আবিষ্কার করেন পরিচালক। ছাব্বিশ বছর ধরে ইউরোপ ও আমেরিকায় নাটক বিষয়ে অধ্যাপনা করেছেন, নিউ ইয়র্কে নাটক নিয়ে পড়াশোনা করেছেন সুদীপ্ত। সম্প্রতি দেশে ফিরে একটি নাটকের দল গড়েছেন যার নাম ‘স্পেকটঅ্যাকটর’। এবং পাশাপাশি অধ্যাপনাও করছেন। শিকারির চরিত্রে বুদ্ধদেব তাঁকে নিয়েছেন একটা কারণেই। তা হল শান্তনুর মতো সুদীপ্তর মুখেও আছে নানা ভাবতরঙ্গের খেলা। কোনও নির্দিষ্ট ইমেজে আটকে থাকে না তাঁর মুখ। অন্য দিকে সুদীপ্ত বললেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত শিরদাঁড়া সোজা করে চলা মানুষ বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। তাই তাঁর সঙ্গে কাজ করতে এত ভাল লাগছে। আমি তো কলকাতায় ভু্ঁইফোঁড়। কিন্তু উনি চিত্রনাট্য শোনাবার পর আমাকে চরিত্রটা নিয়ে স্বাধীন ভাবে ভাবার সুযোগ দিয়েছেন। এটাই অনেক বড় পাওনা।’’ শিকার আর শিকারির মেলবন্ধনের এই গল্পে পাওলি রয়েছেন মাদারির খেল দেখানো দলের একটি বাচ্চার মায়ের ভূমিকায়। কেমন লাগছে বুদ্ধদেবের এই ছবিতে কাজের প্রস্তাব পেয়ে? পাওলি বললেন, ‘‘আমি এর আগে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের পরিচালনায় দুটো শর্ট ফিল্মে অভিনয় করেছি। এখন ফিচার ছবিতে কাজ হবে। ওঁর মতো বিভিন্ন পুরস্কার বিজয়ী পরিচালকের ছবিতে কাজ করার সুযোগ পেয়ে ভাল তো লাগছেই। শর্ট ফিল্ম যখন করি তখনও শ্যুটিং হয়েছিল পুরুলিয়ায়। এ বারও শ্যুটিং হবে সেই পুরুলিয়ায়।’’
ছবিতে এক রক্ষিতার চরিত্রে অভিনয় করছেন অনন্যা চট্টোপাধ্যায়। ‘‘বিয়ের পর এটা আমার প্রথম কাজ। এর আগে ‘আনোয়ার কা আজিব কিসসা’ ছবিতে আমি বুদ্ধদেবদার সঙ্গে কাজ করেছি। ওঁর সঙ্গে তার ফলে একটা বন্ডিংও তৈরি হয়েছে। চরিত্রটাও খুব ইন্টারেস্টিং,’’ বললেন অনন্যা। ‘অপরাজিতা তুমি’, ‘গণেশ টকিজ’য়ে অভিনয় করা চন্দন রায় সান্যাল বলিউডের শিল্পী। তাঁকে দেখা যাবে এক পোস্টম্যানের চরিত্রে। ‘‘আমি কলেজে পড়ার সময় থেকেই বুদ্ধদেবদার ছবি দেখছি। ‘উত্তরা’, ‘কালপুরুষ’ আমার প্রিয় ছবি।
মনে হচ্ছে ‘টোপ’য়ে কাজ করতে গিয়ে একটা নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হব। যেমনটা আগে হইনি,’’ বললেন চন্দন।
পুরুলিয়ার পটভূমিতে এ ছবি লেন্সবন্দি করবেন সিনেমাটোগ্রাফার অসীম বসু। আবহসঙ্গীত রচনা করছেন বুদ্ধদেব-কন্যা অলকানন্দা দাশগুপ্ত। সহকারী পরিচালনায় থাকছেন সোহিনী দাশগুপ্ত। এবং সম্পাদনায় অমিতাভ দাশগুপ্ত। শ্যুটিং শুরু হবে ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে।
শিকার ও শিকারির মেলবন্ধনের এই গল্পে কী ভাবে বুদ্ধদেবের নিজস্ব নির্মাণশৈলী মিশে যায় সেটাই চ্যালেঞ্জ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy