রাজ চক্রবর্তী। —ফাইল চিত্র।
কসবা এলাকায় পরিচালক তথা ব্যারাকপুরের তৃণমূল বিধায়ক রাজ চক্রবর্তীর অফিস। এই অফিসেই কখনও তিনি নতুন ছবির চিত্রনাট্য শোনেন। কখনও বাড়ির বাজারের তালিকা তৈরি করেন। ভোর ৬টা থেকে শুরু হয় রাজের দিন। অফিস থেকে সন্ধে সাড়ে ৭টার মধ্যে বাড়ি। তার পর ছেলে ইউভানের সঙ্গে একটু খেলাধুলো, স্ত্রী শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটিয়ে ঘুম। যদিও ইদানীং তিনি ব্যস্ত তাঁর প্রথম ওয়েব সিরিজ় ‘আবার প্রলয়’-এর প্রচার নিয়ে। তারই এক ফাঁকে সম্প্রতি এক দুপুরে নিজের অফিসে আনন্দবাজার অনলাইনকে সময় দিলেন পরিচালক। মোবাইলের রেকর্ডার চালু হওয়ার আগেই তাঁর আগাম সতর্কবাণী, ‘‘রাজনীতি নিয়ে কিন্তু আমি এই সাক্ষাৎকারে কোনও কথা বলব না।’’ রাজের নিস্তব্ধ অফিসে শুরু হল ইন্টারভিউ।
প্রশ্ন: ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই বলেন রাজের মতো ভাল মানুষ হয় না। কারও নামে কখনও নেতিবাচক মন্তব্য করেন না, নিন্দা করেন না। আপনি কি সত্যিই এমন?
রাজ: কারও সম্পর্কে খারাপ কথা কেন বলব? এমন কোনও দায়বদ্ধতা তো নেই! চারিদিকে নেতিবাচক পরিবেশ। তার মাঝে নিজেকে পজ়িটিভ রাখার চেষ্টা করি। আমি কারও উপকার না করতে পারি, অন্তত অপকার করব না। নিজেকে বড় করার জন্য অন্যকে ছোট করতে চাই না। সব সময় আমাকেই সেরা হতে হবে তার তো কোনও মানে নেই। মাঝারি মানের হয়েও তো থাকতে পারি। কিন্তু কাজের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিত। জ্ঞানত আমি কারও সম্পর্কে কোনও খারাপ কথা বলিনি।
প্রশ্ন: কী বলছেন! আপনার নিজেকে মাঝারি মানের মনে হয়?
রাজ: আমি তো মাঝারি মানেরই একটি ছেলে। আগে তার থেকেও নীচে ছিলাম। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে আমি। এখনও তেমনই আছি। ছবি পরিচালনা করা আমার পেশা। আমরা সবাই কিন্তু গড়পড়তা। আমরা যখনই মাঝারি মানের ঊর্ধ্বে উঠতে শুরু করব, তখনই অন্যকে ছোট করতে হবে। আমাদের কাজ অনেক সময় বড় হতে পারে। কিন্তু মানুষগুলো আমরা সাধারণই।
প্রশ্ন: মধ্যবিত্ত ভাবনাচিন্তাগুলো কি এখনও আছে?
রাজ: আরে আমি এখনও তেমনই আছি। এখন হয়তো বাইরে থেকে দেখে আমায় একটু ঝাঁ-চকচকে মনে হয়। কিন্তু এখনও মায়ের সেই ছেলেটিই আছি। বাজারে গিয়ে হয়তো আলু, পেঁয়াজ, উচ্ছে কিনতে পারি না। কিন্তু সেই তালিকা আমিই করে দিই। সব দাম নখদর্পণে।
প্রশ্ন: শুভশ্রী জীবনে আসার পর কি আপনার জীবনবোধ পাল্টেছে?
রাজ: আমার জীবনটাই পাল্টে গিয়েছে। শুভশ্রী আসার আগে আমার জীবনে শুধুমাত্র কাজই গুরুত্ব পেত। তবে এখন আমার জীবনে পরিবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এখন কাজ করি পরিবারের জন্য। আগে অনেক বেশি আবেগপ্রবণ ছিলাম। অনেকের উপর সহজে ভরসা করে ফেলতাম। এখন শুধু বৌয়ের উপর ভরসা করি। আগে সহজেই খারাপ লেগে যেত। এখন তেমনটা হয় না। এখন আরও গঠনমূলক ভাবনাচিন্তা করি। সারা দিন কাজের পর বাড়ি গিয়ে শান্তি পাই। বৌ আছে। মা আছে। জীবনে বৌ আমার সবার প্রথমে। এখন আমার আর কাউকে দরকার নেই।
প্রশ্ন: আপনাদের সম্পর্কের শুরুর দিকে অনেকেই ভেবেছিলেন যে সম্পর্কটা টিকবে না, সেটাও কি আপনার কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল?
রাজ: মানুষ কী ভাবছেন তা নিয়ে আমরা কখনও মাথা ঘামাইনি। এখনও তা নিয়ে ভাবি না। আমরা জানতাম আমরা কী করছি। যদিও এখন এই সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে গিয়েছি আমরা। বিয়ের পর পাঁচ বছর কেটে গিয়েছে। এই সেপ্টেম্বর হলে ছেলের তিন বছর বয়স হয়ে যাবে। আর এক জন আসছে। আর এ সব ভাবার অবকাশ নেই।
প্রশ্ন: আপনার পরিচালিত প্রথম ওয়েব সিরিজ়ের সহ-প্রযোজকও তো স্ত্রী শুভশ্রী...
রাজ: সহ-প্রযোজক নয়। আমার বৌ এই সিরিজ়ের প্রযোজকই।
প্রশ্ন: স্ত্রী শুভশ্রী এখন নতুন প্রযোজক, আপনি কিছু টিপ্স দিচ্ছেন?
রাজ: আমার উপদেশের ওর কোনও প্রয়োজন নেই। উল্টে আমায় টিপ্স দেয় ও। আমার তো মনে হয় শুভশ্রী খুব ভাল প্রযোজক হবে। বুদ্ধিমতি, লক্ষ্য স্থির। ভাল কাজ করবে। ছোট ছোট ভাল কাজ করার ইচ্ছা আছে ওর। যখন ও আর অভিনয় করবে না তখন ওর অভিজ্ঞতা তো নতুনদের এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। শুভশ্রী আমাদের বাড়ির লক্ষ্মী।
প্রশ্ন: আপনার পরিচালিত অন্যতম জনপ্রিয় ছবি ‘প্রলয়’। ওয়েব প্ল্যাটফর্মের জন্য ‘আবার প্রলয়’ তৈরি করলেন কেন?
রাজ: আমি নিজের কাজ নিয়ে পরীক্ষা করতে সব সময় ভালবাসি। ২০১১ সালে প্রথম তৈরি করেছিলাম ‘প্রলয় আসছে’। সেটা ছিল ছোট পর্দার জন্য। সেটা ৩০টা পর্বের গল্প ছিল। তার পরেই মনে হয়েছিল এটা বড় পর্দার জন্য তৈরি করব। ২০১৩ সালে যখন বরুণ বিশ্বাসকে নিয়ে ‘প্রলয়’ তৈরি করি সেটাও দর্শকের ভাল লাগে। এখন তো ওটিটির যুগ। ওটিটিতে ভাল কিছু করতে চাইছিলাম। তাই ‘আবার প্রলয়’ তৈরি করলাম। অনেকটা আমার মতো কাজ। ভরপুর এন্টারটেনমেন্ট আছে। অ্যাকশন, প্রেম, ভাল গল্প সব কিছু। নজরকাড়া সংলাপ। সবাই তো গুরুগম্ভীর বিষয় তৈরি করে। আমি না হয় শুধুই মনোরঞ্জনের জন্য তৈরি করলাম ওয়েব সিরিজ়।
প্রশ্ন: বক্স অফিসে চলবে কি না, সেই দ্বিধা থেকে ওয়েবে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেননি বলছেন?
রাজ: না না। তা হলে তো অন্য ছবি তৈরি করব। এটা আমি ওটিটির জন্যই করতে চেয়েছিলাম।
প্রশ্ন: সিরিজ়ের প্রথম ঝলক আসার পর তো ঋত্বিক চক্রবর্তীর লুক নিয়েও বিস্তর সমালোচনা হয়েছে। এত বছরেও ‘রিমেক’ তকমা ভাঙা গেল না?
রাজ: দেখুন, এক সময় আমি রিমেক ছবি তৈরি করেছি, তাই মানুষ বলেছেন। এতে তো অন্যায়ের কিছু নেই। কেউ এ সব নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। তাঁরা উপভোগ করতেন। এগুলো ভাবায় না। তবে ঋত্বিকের লুক নিয়ে যাঁরা আলোচনা করছেন, তাঁদের বলব পুরো কাজটা দেখতে। তবে সবাই কিন্তু সমালোচনা করেননি। ১০ লক্ষ মানুষের মাঝে ১০০ জনের মন্তব্যকে বেশি গুরুত্ব দিতে চাই না।
প্রশ্ন: ‘চ্যালেঞ্জ’ থেকে ‘পরিণীতা’— ধীরে ধীরে আপনার কাজের ধারা বদলেছে। এটা কি সচেতন সিদ্ধান্ত?
রাজ: সচেতন নয়। আমার প্রথম ছবি ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’ তৈরি করতে গিয়ে যে বিশ্বাস নিয়ে কাজ করতাম, আজও সেই বিশ্বাস নিয়েই কাজ করি। সব কাজ মন দিয়ে সততার সঙ্গে করেছি। তাই ইন্ডাস্ট্রিতে ২৩ বছর পরেও এখনও কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। এখন মানুষের জীবনধারা বদলেছে। সুতরাং সেই ভাবে আমার গল্প বলার ধরনও পাল্টে গিয়েছে।
প্রশ্ন: টলিপাড়ায় ২৩ বছর কাজ করছেন। কোনও প্রযোজক, অভিনেতা, পরিচালকদের সঙ্গে আপনার খারাপ সম্পর্ক এমনটা শোনা যায় না। সকলের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখেন কী ভাবে?
রাজ: সুসম্পর্ক বজায় রাখা সব থেকে সহজ কাজ। কিছু ভাবতে হবে না। সম্পর্ক খারাপ করলে অনেক বেশি ভাবতে হয়। কোনও জটিলতা নেই। আমার ওই ‘জিলিপির প্যাঁচ’ একদম পছন্দ নয়।
প্রশ্ন: সেই জন্য এখনও রুদ্রনীল ঘোষ, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়েরা আপনার বন্ধু?
রাজ: আমরা সবাই পরিশ্রম করে বড় হয়েছি। ওরা আমার শুরুর দিকের বন্ধু। রুদ্রনীল হল শিল্পী। পরমের জ্ঞান, পড়াশোনাও দারুণ। আর রুদ্রনীল সফল না হলে আমি সত্যিই দুঃখ পেতাম।
প্রশ্ন: আপনাদের পরিবারে তো আর কয়েক দিন পর নতুন সদস্য আসছে। আপনি কি কোনও ছুটি নেবেন?
রাজ: তেমন কোনও পরিকল্পনা নেই। শুভশ্রী নিজে এখনও চুটিয়ে কাজ করছে। ডিসেম্বরে ডেট আছে। ওই সময়টা অবশ্যই নিজেকে হালকা রাখতে হবে। এখনও ইউভানের জন্মের সময়টা মনে পড়ছে। যদিও তখন লকডাউন ছিল। ভাই বা বোন আসার পর ইউভানের প্রতিক্রিয়া কী হবে সেটা দেখতে চাই।
প্রশ্ন: অনেকেই মনে করেন তারকা-সন্তানরা সহজে অনেক কিছু পেয়ে যান বলে তাঁদের বিপথে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। ইউভানকে সকলে চিনে গিয়েছে, এগুলো আপনাকে ভাবায়?
রাজ: কারা এ সব ভাবেন জানি না। তবে এমনটা একদমই নয়। প্রথমত ‘তারকা’ সন্তান বলে কিছু হয় না। সন্তানের নামের আগে তারকা তকমা জুড়ে দেওয়াটা ঠিক নয়। আমি এগুলো নিয়ে সত্যিই কিছু ভাবি না।
প্রশ্ন: এখন তো আপনি বিধায়কও। রাজনীতি নিয়ে কি বরাবরের আগ্রহ ছিল?
রাজ: না। রাজনীতি আমায় কখনও সে ভাবে টানেনি। তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমার সব সময় পছন্দের এক জন মানুষ। অনেক ছোট বয়স থেকে রাজনীতির খবর রাখতাম। তবে মাঠে নেমে লড়ব ভাবিনি। ভাগ্য যেখানে নিয়ে যায়। ব্যারাকপুরের মানুষ আমার দায়িত্বে। আমি তাঁদের জন্য ভাবার চেষ্টা করি। দলের লোক এবং অন্য দলের লোক আমায় ভালবাসেন। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ আমায় এই সুযোগ দেওয়ার জন্য।
প্রশ্ন: আগামী দিনে কি শুভশ্রীকেও দেখা যাবে রাজনীতির মঞ্চে?
রাজ: পাগল! একটা বাড়িতে এক জন রাজনীতির লোক থাক। সেটাই ঠিক আছে। রাজনীতি আমাদের পেশা নয়। সামলানো কঠিন। আমরা কখনও চাইব না বাড়ির আর কেউ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হোক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy