Advertisement
০১ নভেম্বর ২০২৪
পঞ্চাশ? তো কী!

ছবি এতটা কবিতা

সিনেজগতে বরাবর তরুণদেরই জয়জয়কার। অথচ এ সপ্তাহের বিলবোর্ড বলছে মধ্যবয়সেও তারুণ্যের ঝলক দেখিয়ে যাচ্ছেন দুই ৫০ প্লাস। শাহরুখ খান। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়।ছবি জুড়ে দু’জনের ছায়া যেন সারাক্ষণ ঘোরাঘুরি করে গেল! প্রথম জন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। দ্বিতীয় জন জীবনানন্দ দাশ।ইছামতী নদী, পাণিতর গাঁ-এর মাথায়, তার আশেপাশে ক্যামেরা রোল করলেই যেন ভেসে ওঠে দুর্গা-অপুর নিশ্চিন্দিপুর।

লিখছেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৬ ০০:০৬
Share: Save:

ছবি জুড়ে দু’জনের ছায়া যেন সারাক্ষণ ঘোরাঘুরি করে গেল!

প্রথম জন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। দ্বিতীয় জন জীবনানন্দ দাশ।

ইছামতী নদী, পাণিতর গাঁ-এর মাথায়, তার আশেপাশে ক্যামেরা রোল করলেই যেন ভেসে ওঠে দুর্গা-অপুর নিশ্চিন্দিপুর। কার্তিক-অঘ্রানের শ্বাসমাখা মাঠঘাট। সোনালি ডানার চিল...!

ছবি এতটা কবিতা হয়ে বাংলা সিনেমায় শেষ কবে এসেছে!

এক-এক সময় মনে হচ্ছিল, পরিচালক গৌতম ঘোষ বোধহয় তাঁরই পুরনো ছবি ‘পার’, ‘দখল’, ‘পদ্মানদীর মাঝি’ বা ‘মনের মানুষ’-এর মতো ছবিগুলোর ‘ফ্রেমিং’ পুনর্নির্মাণ করছেন। পরক্ষণেই ভুল ভাঙে।

মনে হয়, এ তারও এক্সটেনশন। বর্ধিত রূপ। যখন দেখি—

কাঁটাতারের গায়ে বিন্দু বিন্দু জলকণা ফুটেছে, তার ওপরে মৃত কিশোরের হাত...দূরে সীমান্তরক্ষীর দল ধোঁয়াশায় দাঁড়িয়ে...বাইপাসের ধারে পড়ে থাকা নিকাশি পাইপের মস্ত হাঁ-এর পাশে ধরা ব্যস্ত শহরের কোলাজের মাঝে ফুটে ওঠে উদভ্রান্ত প্রৌঢ়...‘লো-অ্যাঙ্গেল ক্যামেরা’য় ধরা!... কিজলস্কির ‘আ শর্ট ফিল্ম অ্যাবাউট কিলিং’-এর প্রথম দৃশ্যটা যেমন।

আর এই সব ছবির গায়ে যখন গান লেগেছে, তখন?

খাঁ খাঁ করা বাড়িতে গাছের কোটরে মাথা দিয়ে ছিন্নমূল বৃদ্ধ গাইছেন... ‘আমায় বোলো না গাহিতে বোলো না...’! শূন্য করে দেয় মন। শুনশান শ্মশান ঘাটের মতো। কোনও কোনও সময় ধন্ধ লাগে, এ কোনও কাহিনিচিত্রই দেখছি তো, নাকি মুঠো মুঠো তথ্যচিত্র বানানো চিত্রপরিচালক গৌতম ঘোষের কোনও ডকু-ফিচার?

এক বার নয়। অসংখ্য বার।

ক্যামেরার এই কাব্যময়তা, তার ভাবালুতা (আবার রূঢ় বাস্তবতাও) অনেকটাই ধরা তার কাহিনিতে।

যার চারাটা পোঁতা হয়ে যায়, যে পরিবারকে ঘিরে কাহিনি (সায়ন্তনী পূততুন্ড), সেই পরিবারের কর্তা মুন্তাসির চৌধুরী বাদল (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়) আর তাঁর মেয়ে রূপসা (সাঁঝবাতি) পর্দায় এলেই।

বাদল ইস্কুল মাস্টার। সীমান্তের দেবহাটা-য়। শিক্ষিত পরিবার।

কবিতা লেখেন। গান করেন। দেশভাগ তাঁকে কুরে কুরে খায়। বাদল দাদা-নানার পুরনো চিঠি জমিয়ে রাখেন। তার মধ্যেও ভাসমান ভাগাভাগির করুণ গল্প। বাদল ডুব দেন তাতে। কন্যা রূপসাকে তিনি ডাকেন চম্পক ঈশ্বরী। বাদলের বউ লায়লা (কুসুম শিকদার)। বাদলের হাবভাব-চালচলন, কথা, গান সবেতেই ভাবালু আবেশ, নিরন্তর কাতরতায় মোড়া। তেমনই তাঁর মেয়ে।

বাবার দেওয়া আতসকাচ নিয়ে চম্পক ফুলের রেণুর ভেতরে, তারও ভেতরে দেখতে পায়। চম্পকের ভাবনার চলন যেন পাখির মতো ডানা ঝাপটায় আকাশে। কিশোরী চম্পকের মাঝেমধ্যে শরীরও খারাপ হয়। মেয়ের শরীর খারাপের জন্যই তাকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য চোরাপথে কলকাতায় চলে আসেন বাদল আর লায়লা।

গল্পের শুরু দেশভাগ নিয়ে। তার পর ছিটমহল। তুঘলকি খেয়ালে জন্ম নেওয়া যে ছিটমহলে এক উদ্ভট বিভেদরেখা মেনে বছর বছর ধরে বাধ্য হয়ে বাস করে চলেছে দুই দেশের মানুষ।

যাদের কারও ঘর ‘ইন্ডিয়া’তে, তো গোসলঘর দু’হাতে দূরে হয়েও, বাংলাদেশে। একটা কাঠের খুঁটি, কী নদীর আঁকাবাঁকা জলের রেখা বলে দেয় কোথায় কোন বাংলার শেষ, কোন বাংলার কোথায় শুরু। দেশভাগের নামে রাষ্ট্রীয় খামখেয়ালিপনা নিয়ে যতটা খেদ, ক্ষোভ, তার নায়ক র‌্যাডক্লিফ সাহেবকে নিয়ে যতটা ঠাট্টা এ ছবির সংলাপে-সংলাপে চলেফেরে, বাংলা সিনেমায় শেষ কবে কোথায় এমনটা হয়েছে? কিন্তু কাহিনি যত গড়ায় এই দেশভাগ-ছিটমহল ছাপিয়ে, এমনকী ধর্মের ভেদরেখাকেও সরিয়ে এই গল্প হয়ে যায় সাধারণ মানুষের ‘আইডেনটিটি ক্রাইসিস’-এর গদ্য।

পোষ না মানা শিকারি পাখি ‘শঙ্খচিল’-কে রূপক ধরে কাহিনির শেষ উড়ান এখান থেকেই।

‘মনের মানুষ’-এর প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, তার পর এই ‘শঙ্খচিল’ দেখতে দেখতে, তাঁর প্রস্তুতি পর্বের ঝাঁঝটা অনুভব করতে করতে কেবলই মনে হয়, স্টারডম ইমেজটা থেকে নিজেকে সরিয়ে, কতটা নিংড়ে দিলে চরিত্রকে এতটা আত্তীকরণ করা সম্ভব?

লালনের পর ‘বাদল’ হয়ে ওঠার চ্যালেঞ্জটা কিন্তু ছিল সম্পূর্ণ আলাদা রসায়নের। বাদল অনেকাংশেই দেখা চরিত্র। আবার তার এলিমেন্ট, ফিচার, শেড বলতে কীই’বা আছে!

বাদল শিক্ষিত, স্বপ্নালু একজন গড় মানুষ। নায়ক হয়েও যাকে নায়কোচিত হলে চলে না। ব্যস। তার মধ্যেও যে রিদম্, যে পাল্স তাকে ধরে ধীরে ধীরে নিজেকে বাদল-এ বদলেছেন প্রসেনজিৎ। এ দিক থেকে দেখলে ‘বাদল’-কে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জার্নিটায় লালনের চেয়েও ‘রিস্ক’ ছিল আরও বেশি। শুধু এক-দু’বার... বাদল নয়, ‘বুম্বা’য় পেল তাঁকে!— নদীর পারে ‘তেলের শিশি ভাঙল বলে’ (এত্ত ভরাট টান টান সংলাপে ভরা স্ক্রিপ্টে এমন বহুল ব্যবহৃত কবিতা কেন?) আবৃত্তি কিংবা একেবারে শেষ পর্বে নিজের নাম শুধরে দিয়ে ‘মুন্তাসির চৌধুরী বাদল’ বলার সময়...।

আগাগোড়া অনবদ্য কিন্তু কুসুম শিকদার! সিনেম্যাটিক লাইসেন্স দিতে গিয়ে গৌতম ঘোষ অনেক সময় তাঁর নায়িকাদের সূক্ষ্মতায় ‘ছাড়’ দিয়ে বসেন। যাতে শহুরেপনা খোলসটা যেন পুরোপুরি যায় না। ‘পদ্মানদীর মাঝি’-র রূপা গঙ্গোপাধ্যায়, ‘মনের মানুষ’-এর পাওলি, এমনকী ‘পার’-এর শাবানা আজমিকে নিয়েও এমন ইতিউতি কথা উড়েছে।

কুসুম সেখানে একশোয় দুশো। ক্লোজ শটেও তাঁর ভাঙনের দাগ যেমন স্পষ্ট, তেমনই তাঁর মায়াভরা উচ্ছ্বাস, ম্লান হাসির রেখাও। অনবদ্য! ভীষণ সহজাত, স্বতঃস্ফূর্ত সাঁঝবাতির ‘চম্পক’ও। শুধু আর একটু যদি মেঠো হত ওর গলা!

এক রাশ তুখড় অভিনয়ের ভিড়ে কিছুতেই ভোলার নয় দীপঙ্কর দে, মামুনুর রশিদ, প্রিয়াংশু চট্টোপাধ্যায়, ঊষসী চক্রবর্তীকে।

শেষে শুধু একটাই ঠোক্কর, সীমান্তরক্ষীরা মানবদরদী হতে হতে যে ভাবে একেবারে মিনির কাবুলিওয়ালার মতো ভিজে-ভিজে কোমলতাতে গলে পড়লেন, ছিটমহলের রোজের কাহিনি কি তেমনই? নাকি এ কোনও ব্যতিক্রমী? দলছুট? হঠাৎ পাওয়া গল্প?

এখানে কিন্তু একটু মেলোড্রামার বেহালা বাজল! অবশ্য কে বলতে পারে, এই বেহালার আড়ালটুকু না থাকলে ওই তুঘলকিরাজকে হয়তো বা এমন করে কষে থাপ্পড় মারাটা যেত না!

হতে পারে এও কোনও সিনেম্যাটিক লাইসেন্স!

আরও পডুন
বুড়োরা এখন ছোকরা

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE