রাঘব উদয় (বাঁ দিকে) ও অনিল কুমার। পিটিআইয়ের ছবি।
জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দৌড়চ্ছেন তিন জন। প্রথম দু’জন খালি গা। পরনে কালো ফুল প্যান্ট। যিনি ধাওয়া করছেন, তার পোশাকও কা লো। তৃতীয় জন যে নায়কগোছের কেউ, বুঝতে খুব অসুবিধা নেই।
হঠাৎ একটা কাট।
দ্বিতীয় দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে, সাদা একটা হেলিকপ্টার দাঁড়িয়ে। পাশে বিশাল জলাধার। ফটফট ঘুরছে তার পাখা। ওড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কপ্টারটিতে ওঠার সময় তিন জনের মধ্যে একটু হাতাহাতি হল।
আবার কাট। এ বার সাদা কপ্টারটা জলাধারের খুব নীচ দিয়ে উড়ছে। কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে পড়ল। জল থেকে উচ্চতা তখন প্রায় ৫০ ফুট। আচমকাই খালি গা দু’জনের জলে ঝাঁপ। একসঙ্গে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কালো শার্টও। কপ্টার উড়ে গেল অন্য দিকে। তিন জনের উপরে ক্যামেরা ক্লোজ করল। জলের মধ্যে দু’জন খাবি খাচ্ছেন। আর এক জন সাঁতরে যাচ্ছেন পাড়ের দিকে।
আপাত দৃষ্টিতে ফিল্মের কয়েকটা দৃশ্য। তবে সেটাই ঘোর বাস্তব হয়ে গিয়েছে আজ দুপুরে। যে দু’জন জলে খাবি খাচ্ছিলেন, রাত পর্যন্ত তাঁদের খোঁজ মেলেনি। ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যে চ্যানেলে চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ। আজ দুপুরে বেঙ্গালুরুর কাছে ‘মস্তি গুড়ি’ নামে এক ছবির শ্যুটিং করতে গিয়ে জলে তলিয়ে গিয়েছেন দুই কন্নড় অভিনেতা— রাঘব উদয় ও অনিল কুমার। কন্নড় ছবির জনপ্রিয় তারকা দুনিয়া বিজয় অবশ্য সাঁতরে পাড়ে উঠতে পেরেছেন। এক মৎস্যজীবীর সাহায্যে। এবং গোটা ঘটনাই বন্দি হয়ে রয়েছে ক্যামেরায়। জানা গিয়েছে, আজ ছিল ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যের শ্যুটিং। সেখানে স্টান্ট দিতে গিয়েই এই মর্মান্তিক কাণ্ড।
গোটা দেশে হইচই পড়ে গিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, আগাম সতর্কতা না নিয়ে নির্মাতারা কেন শ্যুটিং করছিলেন? ছবির শ্যুটিং ইউনিটের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করেছে কর্নাটক পুলিশ।
যে জলাধারে আজ শ্যুটিং হচ্ছিল, সেটি আসলে একটা বাঁধ। নাম থিপ্পাগোন্ডানাহাল্লি। বেঙ্গালুরু শহরের প্রায় ৩৫ কিলোমিটার পশ্চিমে, রামনগর জেলায়। জলাধারের গভীরতা যথেষ্ট। অথচ পুলিশের দাবি, নায়ক বিজয় ছাড়া অন্যদের লাইফ জ্যাকেট ছিল না। শুধু তা-ই নয়, দক্ষিণী ছবির ওই দুই জনপ্রিয় ভিলেনের সাঁতারের ন্যুনতম জ্ঞানটুকুও নাকি ছিল না। তা সত্ত্বেও লাইফবোট রাখা হয়নি। একটা নৌকো শুধু দূরে দাঁড় করানো ছিল। কিন্তু যান্ত্রিক ত্রুটির দরুণ সে-ও সময়ে উদয়-অনিলের কাছে পৌঁছাতে পারেনি। পাশাপাশি জলাধারের রক্ষণাবেক্ষণকারী সংস্থা বিডব্লিউএসএসবি-র তরফে আরও মারাত্মক অভিযোগ আনা হয়েছে। জলাধারে শ্যুটিংয়ের কোনও অনুমতিই দেওয়া হয়নি নির্মাতাদের। শুধু আশপাশের জঙ্গল আর বাগানে যাওয়ার অনুমতি ছিল। আজ সকাল থেকে সেখানে কিছু শ্যুটিং হয়ও। দুপুরের দিকে বিডব্লিইউএসএসবি-কে জানানো হয়, শ্যুটিং শেষ। শুনে সংস্থার প্রতিনিধিরা ফিরে গিয়েছিলেন।
তার পরেই হেলিকপ্টার নিয়ে জলাধারের উপরে শ্যুটিং শুরু হয় বলে অভিযোগ। এমনকী, দুর্ঘটনার কয়েক মিনিট আগে এক চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে উদয় নিজের ভয়ের কথাও জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘সাঁতার জানি না। অত উঁচু থেকে জলে ঝাঁপ আগে দিইনি। ঝুঁকি নিয়েই শ্যুট করতে যাচ্ছি।’’
প্রায় চল্লিশ বছর আগে একই ধরনের ঘটনা দেখেছিল পশ্চিমবঙ্গ। কলকাতার গঙ্গাবক্ষে লঞ্চের উপর শ্যুটিং করছিলেন অভিনেত্রী কেয়া চক্রবর্তী। ছবির নাম ‘জীবন যে রকম।’ এক অন্ধ মহিলার চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে কেয়া জলে পড়ে তলিয়ে যান। তখনও প্রশ্ন উঠেছিল, আগাম সতর্কতা না-নিয়ে কেন নদীতে শ্যুটিং হচ্ছিল? ১৯৭৭-এর সেই ঘটনা নিয়ে সম্প্রতি ছবি করেছেন দেবেশ চট্টোপাধ্যায়। ছবির নাম ‘নাটকের মতো।’ নায়িকা পাওলি দাম। ছবির ফাইট ডিরেক্টর শান্তনু পাল জানালেন, পাওলিও সাঁতার জানতেন না। কিন্তু ফলতার গঙ্গায় কেয়ার ওই পড়ে যাওয়ার দৃশ্য তোলার সময় দড়ি, ক্রেন-সহ সুরক্ষার নানা ব্যবস্থা মজুত ছিল। পাওলির আশপাশে ছিলেন প্রচুর সাঁতারু। ছিল লাইফবোটও।
এ দিকে ‘মস্তি গুড়ি’র ইউনিটের লোকজন জানিয়েছেন, কোনও মহড়া না-দিয়েই আজকের স্টান্ট দৃশ্য তোলা হচ্ছিল। যা ভয়ঙ্কর ঝুঁকির কাজ বলে মনে করছেন দেবেশ। ‘‘নদীর যে জায়গায় আমরা শ্যুট করেছিলাম, সেখানে আগে অনেক বার গিয়ে রেকি করে আসা হয়েছিল। জোয়ার-ভাটা কখন হয়, কখন জাহাজ যায়, এমন সব কিছু। আচমকা কোনও দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে।’’— বলছেন তিনি। দেবেশের প্রতিক্রিয়া, ‘‘দক্ষিণী ছবির বাজেট অনেক বেশি। এই ব্যাপারগুলো ওরা মাথায় রাখে। তা সত্ত্বেও এ ভাবে ঝুঁকি নিয়ে কেন শ্যুটিং হচ্ছিল, ভেবে পাচ্ছি না।’’ অভিনেতা কৌশিক সেনও জানাচ্ছেন, টালিগঞ্জের ছবিতে এখন অনেক সতর্কতা নিয়ে কাজ করা হয়। সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের জুলফিকার ছবিতে জলের উপরে কৌশিকদের শ্যুট করতে হয়েছে। ‘‘লাইফবোট, লাইফজ্যাকেট নিয়ে শ্যুট করেছি’’— বলেন তিনি।
অনিল-উদয়দের কপালে সেটুকুও জুটল না কেন, তা ভেবে তোলপাড় সারা দেশের ফিল্মি মহল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy