Advertisement
১১ মে ২০২৪

মঞ্চে আন্তিগোনে, দর্শকের আঙিনাতেও পা নাটকের

কেবল সংস্কৃতি-চর্চা ও বিনোদনের চৌহদ্দির মধ্যে আটকে নেই অরণ্যশহরের নাটক। গত কয়েক বছর ধরে সামাজিক দায়বদ্ধতার বার্তা দিতে একের পর এক মননশীল নাটক প্রযোজনা করে চলেছে ঝাড়গ্রাম শহরের একাধিক নাট্যগোষ্ঠী। ‘ঝাড়গ্রাম কথাকৃতি’র সাম্প্রতিক নাটক ‘আন্তিগোনের পরে’-তে অত্যাচার ও প্রতিবাদ সম্পর্কে এক দিকে যেমন রয়েছে বিবিধ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা, প্রতিবাদীর মৃত্যুর পরেও প্রতিবাদ যে শেষ হয় না, সেই বার্তাও দিয়েছেন নাট্যকার দেবলীনা দাশগুপ্ত পাল।

চলছে নাটকের মহড়া। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।

চলছে নাটকের মহড়া। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।

কিংশুক গুপ্ত
ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৫ ০০:১১
Share: Save:

কেবল সংস্কৃতি-চর্চা ও বিনোদনের চৌহদ্দির মধ্যে আটকে নেই অরণ্যশহরের নাটক। গত কয়েক বছর ধরে সামাজিক দায়বদ্ধতার বার্তা দিতে একের পর এক মননশীল নাটক প্রযোজনা করে চলেছে ঝাড়গ্রাম শহরের একাধিক নাট্যগোষ্ঠী।

‘ঝাড়গ্রাম কথাকৃতি’র সাম্প্রতিক নাটক ‘আন্তিগোনের পরে’-তে অত্যাচার ও প্রতিবাদ সম্পর্কে এক দিকে যেমন রয়েছে বিবিধ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা, প্রতিবাদীর মৃত্যুর পরেও প্রতিবাদ যে শেষ হয় না, সেই বার্তাও দিয়েছেন নাট্যকার দেবলীনা দাশগুপ্ত পাল। নাটকটির নির্দেশক তথা কথাকৃতির মুখ্য সংগঠক কুন্তল পালের কথায়, “সফোক্লিসের কালজয়ী এই নাটকের শেষে প্রতিবাদী তরুণী আন্তিগোনে আত্মহত্যা করেছিলেন। জনগণের কণ্ঠরোধ করার প্রচেষ্টা আবহমান কাল ধরে চলে আসছে। কন্ঠরোধকারীর ভূমিকায় কখনও থাকে সম্রাট, কখনও সামন্তপ্রভু, কখনও আবার রাষ্ট্র। আন্তিগোনের সময়ে ‘ক্রেয়ন’ শুধু তাদের প্রতীক নন, বরং এই চরিত্রটি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের পরাকাষ্ঠার প্রতীক। মূল নাটকে প্রতিবাদের অস্ত্র হিসেবে আন্তিগোনে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানেই কি শেষ হয় প্রতিবাদ?”
কুন্তল জানাচ্ছেন, তাঁদের ‘আন্তিগোনের পরে’ নাটকের সূত্রপাত এখান থেকেই। নাট্যকার দেবলীনা দাশগুপ্ত পাল বলেন, “আমাদের নাটকে আন্তিগোনে অশরীরী। টাইরেসিয়াসরা যদি প্রফেটের ভূমিকা ছেড়ে সংগঠক হয়ে ওঠেন, তা হলে সত্যিই কি অশরীরী আন্তিগোনেদের সঙ্গে জীবিত ক্লীবসম প্রজাদের এক অলৌকিক মেলবন্ধন সম্ভব হয়ে উঠতে পারে! সেই মেলবন্ধনে অত্যাচার কি নতজানু হয়? এই প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজার তাগিদেই এই প্রযোজনা।”
২০০৬ সালে ঝাড়গ্রাম কথাকৃতির পথচলা শুরু। গত ন’বছরে এই নাট্যসংস্থার ঝুলিতে একের পর এক মঞ্চসফল নাটক রয়েছে। হয়তো কিছুটা রাজনৈতিক বক্তব্যও উঠে আসছে সমকালীন নাটকগুলিতে। কুন্তল ও দেবলীনারা অবশ্য জানাচ্ছেন, কেবল মাত্র ভালবেসেই তাঁরা অরণ্যশহরের নাটকের উত্তরাধিকার বহন করে চলেছেন। আর্থিক সমস্যার কারণে মহানগরের কোনও মঞ্চে নাটকগুলির মঞ্চায়ন সম্ভব হয় না। তবুও নিজেদের কথাগুলো নিজেদের মতো করে বলার জন্যই নাটকই তাঁদের হাতিয়ার। আর সেটা প্রতিটি নাট্যকর্মীর আন্তরিক ও চূড়ান্ত নিষ্ঠার কারণে সম্ভব হচ্ছে।

‘আন্তিগোনে’রূপী দেবরূপা রায় ও ‘ক্রেয়ন’-এর চরিত্রের অভিনেতা সাগর রায় বলেন, “কখনও কখনও নিজেদের কথাগুলো নিজেদের মতো করে বলতে ইচ্ছে করে। সেই ভাবনাগুলো যখন অনেক দর্শকের ভাবনার সঙ্গে মিলে যায়, তখনই নাটকের সার্থকতা।”

ঝাড়গ্রামে নাট্যচর্চার ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ। ষাট-সত্তরের দশক থেকেই বিশু সেন, বিজু মিত্র, বঙ্কুবিহারী রায়, নারায়ণ ভট্টাচার্য, কুমারেশ বিশ্বাস, শ্রীকান্ত পাল, দিব্যেন্দু হোতার মতো বিশিষ্টজনের হাত ধরে অরণ্যশহরে নাট্যচর্চার উন্নত ধারা শুরু হয়েছিল। ১১টি নাটকের দল একের পর এক মঞ্চসফল নাটক উপহার দিয়েছে। এখন অবশ্য হাতে গোনা কয়েকটি নাটকের দল অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। শহরের সব চেয়ে পুরনো নাটকের দল ‘আনন্দন’-এর বয়স ৩৬ বছর। এর প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক সঞ্জীব সরকার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাটকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে নিজের শহরে নাট্যচর্চা করেন। প্রতি বছর শীতে তিন দিনের নাট্যমেলার আয়োজন করেন। প্রতি বছর একটি করে নতুন নাটক মঞ্চস্থ করেন তাঁরা।

গত বছর ‘আনন্দন’-এর বাল্যবিবাহ বিরোধী কর্মশালাভিত্তিক নাটক ‘কালশৈশব’ দর্শকদের মধ্যে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। সঞ্জীববাবুর কথায়, “বর্তমান প্রজন্মের মধ্যেও নাটক নিয়ে যথেষ্ট আগ্রহ ও ভালবাসা রয়েছে। না হলে এত বছর আমাদের পক্ষে টিঁকে থাকা সম্ভব হতো না। তবে আর্থিক সমস্যাটা চিন্তায় ফেলে।” অরণ্যশহরের বিশিষ্ট নাট্যকর্মী প্রদীপ চক্রবর্তী ও তাঁর নাটকের দল ‘প্রয়াস’-এর উদ্যোগে প্রতি বছর অঙ্গন নাট্যোত্সব হয়। ঝাড়গ্রাম কথাকৃতিও তিন দিনের ‘নাট্য মিলনী’র আয়োজন করে। শহরের নাটকের দলগুলির বার্ষিক এই সব উত্সবে কলকাতা ও জেলার ভাল দলগুলির নাটক দেখার সুযোগ হয়। ঝাড়গ্রামের ‘রূপক’ নাট্যগোষ্ঠীর তপন সেন রায়ের মতো নাট্যপ্রেমীরা নাট্যচর্চা অব্যাহত রেখেছেন। আবার ‘কুরকুট’-এর উপল পাহাড়ি ও তাঁর সহযোগীরা স্পেস থিয়েটর বা অঙ্গন নাটক নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে চলেছেন।

উপল পাহাড়িদের কুসংস্কার বিরোধী অঙ্গন নাটক ‘আঁধার মানুষ’, পণপ্রথা, বাল্যবিবাহ ও নারী পাচার নিয়ে ‘তিনটি মেয়ের গল্প’-এর মতো অঙ্গন নাটকগুলি গ্রামেগঞ্জে জনপ্রিয় হচ্ছে। এবার বন ও বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ বিষয় নিয়ে কুরকুটের নতুন প্রয়োজনা ‘ফুলমণি ও তার ছোট্ট বন্ধু’ এই পুতুল নাটকটি প্রস্তুতির পথে। উপল পাহাড়ি বলেন, “মানুষ টিভি সিরিয়াল ছেড়ে কেন নাটক দেখবেন, সেটাও ভাবতে হবে। সে জন্য আমরা এমন বিষয়বস্তু নির্বাচন করি, যেগুলি গ্রামাঞ্চলের মানুষের কাছে আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠতে পারে। এতে দু’টো কাজই হচ্ছে। সামাজিক বার্তা দেওয়ার পাশাপাশি, মানুষকে নাটকমুখী করা যাচ্ছে।”

অরণ্যশহরের বর্তমান প্রজন্মও যে নাটক নিয়ে ভাবছেন, তার উদাহরণ পার্থিব রায়। ঝাড়গ্রাম শহরের এই তরুণ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক নিয়ে স্নাতকস্তরে পড়াশোনা করছেন। কলকাতার বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব গৌতম হালদারের ‘নয়ে নাটুয়া’ নাটকের দলে নিয়মিত অভিনয় করছেন। কিন্তু অরণ্যশহরের স্থানীয় নাটকের দলগুলির নিজস্ব প্রযোজনাগুলি উত্কৃষ্ট মানের হলেও সে ভাবে বাইরে প্রচার হচ্ছে না, আক্ষেপ রয়েই গিয়েছে উদ্যোক্তাদের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE