৮ ডিসেম্বর ২০১০। বুধবার। রবীন্দ্র ভবন। কোচবিহার।
মামুলি একটা টিশার্ট পরা রোগা-পাতলা, একমাথা উসকো-খুশকো চুলের এক ছেলে আমাকে বলল, ‘‘স্যর, প্লিজ আমাকে কলকাতায় নিয়ে চলুন।’’
কাজের সূত্রে সারা বাংলা ঘুরতে হয় আমাকে। ওই বছরের প্রথম দিকে আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছিল। বাংলায় একটা ট্যালেন্ট শো করলে কেমন হয়! যেখানে সারা বাংলা থেকে আসা মানুষ নিজেদের প্রতিভা দেখাবে— গান হোক, বাজনা হোক, নাচ হোক কিংবা জিমন্যাস্টিক।
চ্যানেল তো রাজি হয়ে গেল আইডিয়া শুনে। কিন্তু শোয়ের প্রোডিউসর পাব কোথা থেকে! ধরলাম বুম্বাদাকে (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়)। ব্যস, শুরু হল ‘টক্কর’। তার অডিশন নিতে ডিসেম্বরে এসে পৌঁছেছি উত্তরবঙ্গে। অডিশনের ফাঁকে রাস্তার দোকানে চা খেতে নেমেছিলাম।
সেখানেই আমার প্রথম আলাপ মানিকের সঙ্গে। বললাম, ‘‘কলকাতায় নিয়ে তো যেতে পারি। কিন্তু তুমি কী করতে পারো?’’
‘‘স্যর, আমি টিউবলাইট ভাঙতে পারি।’’
‘‘মানে?’’
‘‘আমি মাথা দিয়ে টিউবলাইট ভাঙতে পারি।’’
কথাটা সামান্য। কিন্তু ছাপ্পান্ন নম্বর কনটেস্টেন্টের স্টিকার লাগানো ছেলেটার চোখে একটা অন্যরকম স্পার্ক দেখলাম। অসমের মানিক পালকে নিয়ে এলাম কলকাতায়।
সেই মানিকই এ বারের ‘ইন্ডিয়া’জ গট ট্যালেন্ট’য়ের বিজয়ী। টিভিতে খবরটা দেখেই যেন সাড়ে চার বছর আগে ফ্ল্যাশব্যাকে চলে গেলাম।
রিয়েলিটি অনুষ্ঠানে প্রতিযোগীদের ভাল করে জেনে নেওয়া বাধ্যতামূলক। অনেক খুঁটিনাটি ব্যাপার জানলে সেটা শোয়ের টিআরপি-র কাজে লাগে। সে জন্যই ‘টক্কর’য়ের সময় মানিকের সঙ্গে অনেক কথা হত। কথায় কথায় জেনেছিলাম, অসমে কাটানো ওর ছোটবেলা, স্কুলে যাওয়া, টিফিনের সময় বাবার চায়ের দোকানে বসা, যাতে বাবা সে সময় বাড়ি গিয়ে খেয়ে আসতে পারে। তখনই শুনেছিলাম, কী ভাবে নিজের চোখের সামনে দেখেছিল তিন উগ্রপন্থীর গুলিতে বাবাকে ঝাঁঝরা করে দেওয়া।
‘‘আমার ইচ্ছে করে সব উগ্রপন্থীকে গুলি করে মেরে ফেলি। সব ক’টাকে...,’’ বলছিল মানিক। কিন্তু সে দিন চোখের মণিতে যে রাগ দেখেছিলাম, সেটা ভাষায় বর্ণনা করতে পারব না। আমার মাথায় ঘুরছিল কী করে সেই রাগটা কোনও ক্রিয়েটিভ দিকে চালিয়ে দেওয়া যায়। বললাম, ‘‘মানিক, মনে রাখিস প্রতিশোধে কারও কোনও উপকার হয় না। বরং তোর প্রতিভা দিয়ে দর্শককে হা করিয়ে দে না!’’
বললাম তো বটে। কিন্তু ওকে নিয়ে আমার অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টররা তখন পড়েছে আর এক মুশকিলে। অত টিউবলাইট পাব কোথা থেকে! একদিন ডেকে বললাম, ‘‘তোর টিউবলাইটের জোগান তো আর দিতে পারছি না!’’ সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘‘তা কী করব?’’
সুদর্শনের কাছে পাঠালাম ওকে। সেখানে দিব্যেন্দু ওকে দড়ি দিয়ে বিভিন্ন কসরত দেখালো। অবাক করে দিয়ে ক’দিনেই তুলে নিল সে সব কসরত। দিব্যেন্দু ওকে যা বলে সেটাই ও করে দেয়। দড়ি নিয়ে যা খুশি করতে পারে মানিক। তবে সেটাই চমকের একমাত্র কারণ ছিল না।
আমরা ‘টক্কর’য়ে অবাক হয়ে দেখতাম বছর আঠেরোর ছেলেটা কী পরিণত। শোয়ের জাজ চিরঞ্জিতও বলতেন সে কথা। অনেক উৎসাহ দিতেন ওকে। মাস চারেকে মানিক বদলেও গিয়েছিল অনেকটা। বুঝে নিয়েছে রাগ পুষে রেখে কোনও লাভ নেই। বরং মনের মধ্যে জমে থাকা সেই রাগকে নিংড়ে দিতে হবে স্টেজে। তখনও কিন্তু ওর মা চালাচ্ছেন বাবার সেই ছোট্ট চায়ের দোকান। সে সব কথা নিজে থেকে কখনও কখনও বলতও। কিন্তু কখনও চোখের কোণে জল দেখিনি। হয়তো মনের আগুনে তা শুকিয়ে গিয়েছে। তৈরি হয়েছে ডেডিকেশন ।
খুব বেশি মিশুকে ছিল না মানিক। রাতে অনেক বার দেখেছি একা একা পায়চারি করত ক্যাম্পাসের মধ্যে। পরের দিন ওর শ্যুট থাকার কথা মনে করিয়ে দিলেই সঙ্গে সঙ্গে ঘুমোতে চলে যেত। কুড়িতে পা না দেওয়া সেই ছেলে তখনই বুঝে গিয়েছিল কাল ওকে ফ্রেশ হয়ে স্টেজে নামতে হবে। এর জন্যই মনে হয় জীবন সব থেকে বড় শিক্ষক।
২০১১-র এপ্রিলে ‘টক্কর’য়ের চ্যাম্পিয়ন হল মানিক। আমরা আশ্চর্য হইনি। সেটাই স্বাভাবিক ছিল।
তা বলে কষ্টটা কি কমেছে ওর! প্রাইজমানি পেতে কিছু দিন দেরি হয়। তখনও তো রোজগার বলতে মায়ের চায়ের দোকান। শুকনো মুখে ঘুরত। প্রাইজের টাকাটা পেয়েই চলে গেল মুম্বই।
‘ইন্ডিয়া’জ গট ট্যালেন্ট’য়ের মতো অনুষ্ঠানেও যে সেরার পুরষ্কারটা ছিনিয়ে নেবে, সেটা ভাবিনি আমি। তবে ওর ভবিষ্যৎ যে উজ্জ্বল তা জানতাম। এপ্রিল ২০১১ থেকে জুলাই ২০১৫— এই চার বছরে কথা হয়েছে কয়েক বার। ফেসবুকে চ্যাট হয়েছে অনেক। এই তো সে দিন ফাইনালের আগে কল করেছিল। ‘‘দাদা, আমি পারব তো?’’ আমি বললাম, ‘‘তোকে যে পারতেই হবে, মানিক। মায়ের কষ্ট তুই ছাড়া কে মেটাবে!’’
খবরে দেখলাম, ৫০ লাখ টাকা আর একটা মারুতি সেলেরিও গাড়ি পেয়েছে মানিক। দিন কয়েকের মধ্যে মুম্বইতে ফ্ল্যাট কিনে মাকে নিয়ে যাবে। ভাল লাগল। ‘টক্কর’ই তো ওকে প্রথম ধাপটা দিয়েছিল।
আরও উঁচুতে ওঠ মানিক। যেমনটা তুই দড়ি ধরে উঠিস। তোর জন্য আরও বড় কিছু যে অপেক্ষা করছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy