ফিরোজা বেগম
১৯৩০—২০১৪
ছেলেবেলা থেকেই তো শুনে আসছি ফিরোজা বেগমের গান।
নজরুলগীতি শিখতে গিয়ে তাঁর গানের সান্নিধ্যে বারবারই এসেছি। কিন্তু দেখা হয়নি। এপার আর ওপার বাংলার মাঝখানের তফাতের জন্য।
ফিরোজা বেগমকে প্রথম দেখলাম ১৯৭৫ সালে। সেই সময় রবীন্দ্রসদনে খুব আড়ম্বর করে নজরুল জয়ন্তী হত। সেখানে প্রথিতযশা শিল্পীদের সঙ্গে গাইতেন উদীয়মান শিল্পীরাও।
সেই আসরে আমি উন্মুখ হয়ে থাকতাম বড় বড় শিল্পীর গান শুনব বলে। পূরবী দত্ত, ডা. অঞ্জলি মুখোপাধ্যায়, সুকুমার মিত্র, ধীরেন বসু, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় এঁদের গাওয়া নজরুলগীতি তখন দারুণ জনপ্রিয়। এমনই এক সময়ে এলেন ফিরোজা বেগম। তাঁকে দেখার ইচ্ছে আমার ছিলই। শুনেছিলাম যেমন রূপ, তেমন ব্যক্তিত্ব, আভিজাত্য তেমনই তাঁর গান।
সেই নজরুল জয়ন্তী উৎসবে উনি বসেছিলেন উইংসের পাশে। আলো-আঁধারিতে দেখলাম ওঁর কানে হিরের দুলের দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ছে মুখমণ্ডলে। ফর্সা গলায় একগাছি মুক্তোর হার। সাজের মধ্যে কোথাও কোনও আতিশয্য নেই। পরনে ছিল খুব হাল্কা রঙের একটা ঢাকাই শাড়ি। কাছে গিয়ে প্রণাম করে পরিচয় দিতে বললেন, “ও তুমি সুমিত্রার মেয়ে। খুব ভাল। কার কাছে নজরুলগীতি শেখো?” আমি তখন পূরবী দত্তের ছাত্রী। সে কথা বলায় তিনি আরও যেন খুশি হলেন। বললেন, “খুব ভাল শিক্ষক পেয়েছ। কাজীদার গান যত পারো শেখো আর ছড়িয়ে দাও।”
তার পর উনি মঞ্চে উঠলেন। গাইলেন একের পর এক তাঁর গাওয়া জনপ্রিয় নজরুলগীতি। বড় বড় যন্ত্রীরা বসে আছেন চারিদিকে। সে এক সুরেলা, মোহময় পরিবেশ। বরাবরই আমার মনে হয় ওঁর কণ্ঠে এক ধরনের স্বাভাবিক, স্বতঃস্ফূর্ত প্রবাহ আছে। সেই সাবলীলতা যে কোনও নজরুলগীতির ছাত্রছাত্রীর কাছেই শিক্ষণীয়।
অনেকেই মনে করেন নজরুলগীতি মানে কালোয়াতি, সুরের মারপ্যাঁচ। কিন্তু ফিরোজা বেগম কোনও দিনই সে পথ মাড়াননি। নদীর মতো প্রবাহে মসৃণ ভাবে গান গাইতেন। আর তারই ফলে নজরুলের গান তাঁর গায়কিতে একটা মৌলিকতার স্পর্শ পেয়েছে। যাই হোক, যে দিন ওঁকে প্রথম মঞ্চে দেখলাম মনে হয়েছিল কোনও এক রাজরানী মঞ্চ আলো করে বসে আছেন। শ্রোতারা মুগ্ধ বিহ্বল। কারও মুখে কোনও কথা নেই।
কাজী নজরুলের কাছে সরাসরি গান শিখেছিলেন বলে নজরুলগীতিতে তাঁর ‘অথেনটিসিটি’টা পাওয়া যায়। সুরকার কমল দাশগুপ্তের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার ফলে তাঁরা দু’জন পরষ্পরের পরিপূরক হয়ে উঠেছিলেন। কমল দাশগুপ্ত ছিলেন নজরুলের প্রিয় শিষ্য। নজরুলের অনুমতি নিয়ে তাঁর রচিত বেশ কিছু গানে সুর দিয়েছিলেন কমল। নজরুল একবার ‘চক্রবাক’ বলে একটি কবিতা কমলকে পড়তে দেন। কমল সেই কবিতাকে তিন ভাগে ভাগ করে আলাদা আলাদা ভাবে সুর দিয়েছিলেন। তারই মধ্যে একটি গান ছিল ‘মনে পড়ে আজ সে কোন জনমে’। এই গান ফিরোজা বেগমের কণ্ঠে মধুর রূপ পায়।
আবার আধুনিক গানেও ফিরোজার একটা আলাদা জায়গা ছিল। প্রণব রায়ের লেখা ‘এমনি বরষা ছিল সে দিন’ গানটিতে সুর দিয়েছিলেন কমল দাশগুপ্ত। সেই গান অপূর্ব গেয়েছিলেন ফিরোজা বেগম। পরবর্তী কালে আমি যখন গানটাকে রেকর্ড করি, ফিরোজা বেগমের গায়কিকে আত্মস্থ করেই গাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। ফিরোজা বেগমের গলায় কিছু কিছু গান আছে যা শুধু তাঁর কণ্ঠেই মানায়। এর মধ্যে ‘মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর’ কিংবা ‘ওরে নীল যমুনার জল’ গান দুটো ঠিক সেইরকমই যা শুধু ফিরোজা-কণ্ঠেই ভাল লাগে।
ওঁর সঙ্গে সেই ১৯৭৫ সালের পর বহুবারই দেখা হয়েছে আমার। শেষ দেখা হয়েছিল জিডি বিড়লা সভাঘরে। সে দিন উনি ছিলেন শ্রোতার আসনে। গান গাইবার মতো শারীরিক অবস্থা ছিল না। কিন্তু কী আশ্চর্য ব্যক্তিত্ব তখন ওই অশীতিপর বয়সেও ওঁকে ছেয়ে ছিল। কাছে গিয়ে প্রণাম করেছিলাম। সেই আমার শেষ প্রণাম।
ওঁকে যত বার দেখেছি তত বারই মুগ্ধ হয়েছি। মুগ্ধ হয়েছি ওঁর ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণতায়। ওঁর আভিজাত্যে। ওঁর নদীর মতো সুরের প্রবাহে।
এখন নজরুলগীতির গায়কি নিয়ে আমরা খুব বিভ্রান্ত। চর্চাও কমে এসেছে। তেমন দিনে ফিরোজা বেগমের চলে যাওয়া মানে নজরুলগীতির শেষ অথেনটিক শিল্পীকে হারানো। এর পর আর কোনও শিল্পী রইলেন না যাঁর পায়ের কাছে বসে সত্যিকারের নজরুলগীতি শেখা যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy