Advertisement
০৬ মে ২০২৪
Rupam Islam On Bapi Das

বাপিদা আমার হাতে পতাকা তুলে দিয়ে গেলেন: রূপম ইসলাম

ফুসফুসের ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই শেষ। রবিবার শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন মহীনের অন্যতম ঘোড়া তাপস দাস ওরফে বাপিদা। আনন্দবাজার অনলাইনে স্মৃতিচারণ রূপম ইসলামের।

Image of Tapas Das Bapi.

মহীনের অন্যতম ঘোড়া প্রয়াত তাপস দাস। ছবি: সংগৃহীত।

রূপম ইসলাম
রূপম ইসলাম
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০২৩ ১৭:৩৬
Share: Save:

বাপিদা, মণিদা, বুলাদা... এঁরা যখন পথচলা শুরু করেছিলেন, তখন মহীনের একেবারে গোড়ার দিক। ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’-র সাত জন আদি সদস্যের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন তাপস দাস ওরফে বাপিদা। এঁদের যে সাঙ্গীতিক উচ্চারণ, তা তো শুধু সঙ্গীতশিল্পীদের জোটবাঁধা নয়, সেই একজোট হওয়ার নেপথ্যে ছিল রাজনৈতিক চেতনা, অবস্থান ও বিপ্লব। সেই সময়ের আন্তর্জাতিক পটভূমি এব‌ং আমাদের দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি জন্ম দিয়েছিল শ্রেণি সংগ্রামের। সেই বোধটাই প্রতিফলিত হয়েছিল নানা রকম সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে নান্দনিকতার উৎকর্ষ সন্ধানের কাজটা করেছিলেন হাতেগোনা যে ক’জন, তাঁদের মধ্যে বাপিদার কথা স্মরণ করতেই হয়। ওই পরিস্থিতি এবং ওই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে গতে বাঁধা ছক থেকে বেরিয়ে ভাবতে পেরেছিলেন বাপিদা ও মহীনের অন্যরা। বাপিদা সেই ছকভাঙা শিল্পীদের অন্যতম। তিনি ছকে চলতেন না, ভাঙতেন। তবে তা করতেন বাকিদের সঙ্গে নিয়ে।

বাপিদার সঙ্গে যত বার আমার কথাবার্তা হয়েছে, তা আদ্যোপান্ত রাজনৈতিক কথা, সমাজসচেতনতার কথা। শুধুমাত্র শিল্প নিয়েই যে আলাপ-আলোচনা হয়েছে, তা নয়। শিল্প তো আর আকাশে ভেসে থাকে না! সেই বোধটা যাঁরা তৈরি করেন নিজেদের কাজের মাধ্যমে, ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’-র সদস্যরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। বাংলা সঙ্গীতের ইতিহাসে এক এক জন স্তম্ভ তাঁরা। তাঁদের যে আমি স্নেহের পাত্র হয়ে উঠতে পেরেছি, এটা আমার জীবনের একটা বড় সহায়। নবীন শিল্পী হিসাবে আমার মণিদার (গৌতম চট্টোপাধ্যায়, মহীনের ঘোড়াগুলি) সঙ্গে আলাপ হয়। মণিদা আমার গান গাইতেন, সকলকে দিয়ে আমার গান গাওয়াতেনও। এক জন নবীন শিল্পীর ক্ষেত্রে যে সেটা কতটা বড় পাওনা, তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়।

Image of rupam Isalm and Tapas Das.

রূপম ইসলাম (বাঁ দিকে) এবং প্রয়াত তাপস দাস। ছবি: সংগৃহীত।

‘ফসিলস’ হিসাবে আত্মপ্রকাশের মঞ্চেও আমি মণিদার সঙ্গে গান গেয়েছি। সেটা ১৯৯৯ সালের ঘটনা। তার পর হঠাৎ মণিদা চলে গেলেন। তবে যে উত্তরাধিকারের পরম্পরা শুরু হয়েছিল, সেটা থেকে গেল। মহীনের আব্রাহাম মজুমদারের সঙ্গে আমি ‘ফসিলস’-এর অ্যালবামে কাজ করেছি। বুলাদার (প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়, মহীনের ঘোড়াগুলি) সঙ্গে তো যোগাযোগ ছিলই। ওঁর এবং রঞ্জন ঘোষালের (মহীনের ঘোড়াগুলি) সাক্ষাৎকারও নিয়েছি আমি। তাঁদের সকলের আশীর্বাদধন্য আমি। একেবারে শেষে যাঁর আশীর্বাদ ও ভালবাসা পেলাম, তিনি বাপিদা।

বাপিদার সঙ্গে যোগাযোগ আমার হঠাৎই। তার পর থেকে ‘ফসিলস’-এর সব বড় বড় কনসার্টেও তো বাপিদা থাকতেনই, পাশাপাশি অশক্ত শরীরে ‘রূপম একক’ অনুষ্ঠানেও নিয়মিত থাকতেন তিনি। এটা ২০১১-২০১২-র সময়ের কথা। বাপিদা যেমন আমাদের অনুষ্ঠানে থেকেছেন, অনুষ্ঠান দেখেছেন, তেমন তা নিয়ে নিজের জোরালো মতামতও প্রকাশ করেছেন। আজও সমাজমাধ্যমের পাতায় ঘোরাফেরা করছে বাপিদার তেমন কিছু পোস্ট।

এক জন ছকভাঙা প্রবীণ শিল্পী যেন নবীন প্রজন্মের অন্য এক শিল্পীর মধ্যে সেই ছকভাঙা শিল্পসত্তা খুঁজে পেয়েছিলেন। এটা ভেবেই আমার বার বার মনে হয়েছে, বাপিদা যেন আমার হাতে একটা পতাকা তুলে দিচ্ছেন। তিনি সোচ্চারে বলেছেন, বাংলা রক সঙ্গীত বলতে যে গান তিনি শুনতে চান, তা কোথাও গিয়ে ‘ফসিলস’-এই পাচ্ছেন। এটা অনেকটা উত্তরাধিকার প্রদানের মতো একটা বিষয়। একক অনুষ্ঠান দেখে এসেও বাপিদা লিখেছেন, বাংলা ভাষা যদিও কারও কাছ থেকে শিখতে হয়, তা হলে রূপমের কাছ থেকে শিখতে হবে। এগুলির জন্য তাঁকে কম বিদ্রুপ সহ্য করতে হয়নি। তারও সমুচিত জবাব দিয়েছেন যোদ্ধার মেজাজেই। গুরুজন, সমর্থক এবং অভিভাবকের মতো আমার জীবনে ছিলেন বাপিদা। এটা আমার সঙ্গীত জীবনের বিরাট পাওনা।

এ তো গেল সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। শেষের দিকে আমি বাপিদার কাছ থেকে যা পেয়েছি, সেটা কতটা নিজের জীবনে প্রয়োগ করতে পারব জানি না। তবে ভরপুর চেষ্টা করব। মারণরোগের সঙ্গে এই লড়াইয়ে কিন্তু কোনও দিন নতিস্বীকার করেননি বাপিদা। তিনি বরাবর আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে তিনি ফিরবেন। আমার বই ‘গান সমগ্র ২’-এর ভূমিকা লেখার জন্য বাপিদাকে অনুরোধ করেছিলাম। তিনি লেখা শুরুও করেছিলেন। সেই লেখা কত দূর এগিয়েছে, আমি জানি না। কিন্তু তিনি সব সময় বলতেন, ‘‘আমি বাড়ি ফিরেই ওটা শেষ করব।’’ বাপিদা আমার গান শুনতে চেয়েছিলেন বলে হাসপাতালেও গিয়েছিলাম গিটার নিয়ে। গেয়েছি অনেক গান তাঁর কেবিনে বসেই। এর পরে আরও বড় করে নিজের বাড়িতে গানের আসর আয়োজন করার ইচ্ছা ছিল বাপিদার। তখন হয়তো ভাল ভাবে শ্বাসও নিতে পারছেন না তিনি, তা সত্ত্বেও তাঁর মানসিক শক্তি ছিল অদম্য।বাপিদা বলেছিলেন, এই যুদ্ধ তিনি জিতবেনই। আমি বলেছিলাম— তাঁর ইচ্ছে হলেই আবার গিটার নিয়ে চলে আসব।

সে সুযোগ আর পেলাম না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rupam Islam Bapi Das Moheener Ghoraguli
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE