Advertisement
১১ মে ২০২৪

হল-এ ফিরছে দর্শক, সিনেমাওয়ালাদের মুখে হাসি

এ এক আশ্চর্য সমাপতন। মাসখানেক আগের এক শুক্রবারে সাবেক সিনেমা হল মালিকদের দুর্গতির কাহিনি উঠে এসেছিল পর্দায়। বাস্তবে সেই সিনেমাওয়ালাদের একাংশের মুখে হাসি ফুটেছে এত দিনে। হাসি ফুটিয়েছেন টালিগঞ্জের এক ‘প্রাক্তন’ জুটি।

সাবেক সিনেমা হল-এ ভাল ব্যবসা দিচ্ছে ‘প্রাক্তন’। ব্যারাকপুরে তোলা নিজস্ব চিত্র।

সাবেক সিনেমা হল-এ ভাল ব্যবসা দিচ্ছে ‘প্রাক্তন’। ব্যারাকপুরে তোলা নিজস্ব চিত্র।

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০১৬ ০৯:৩৫
Share: Save:

এ এক আশ্চর্য সমাপতন। মাসখানেক আগের এক শুক্রবারে সাবেক সিনেমা হল মালিকদের দুর্গতির কাহিনি উঠে এসেছিল পর্দায়। বাস্তবে সেই সিনেমাওয়ালাদের একাংশের মুখে হাসি ফুটেছে এত দিনে। হাসি ফুটিয়েছেন টালিগঞ্জের এক ‘প্রাক্তন’ জুটি।

বাণিজ্যিক বাংলা ছবির বাজারে বেশ কিছু দিন ধরেই খরা। চার বছর আগে জিৎ-অভিনীত ‘আওয়ারা’র পরে আর বড় হিট নেই। গত বছর ‘জামাই ৪২০’ আর ‘শুধু তোমারই জন্য’ মাঝারি সাফল্য পেয়েছিল। বড় হিট বলতে ‘বেলাশেষে’। সেটা সমান্তরাল শহুরে ছবি, তার দর্শক আলাদা। তাঁরা মূলত মাল্টিপ্লেক্সে যান। বাণিজ্যিক ছবির মরা বাজারে সিঙ্গল স্ক্রিন হলগুলোর অবস্থা সেখানে ক্রমেই পড়তি। এ রাজ্যে সিঙ্গল স্ক্রিন হল-এর সংখ্যা কমতে কমতে ৩৫০-এ এসে ঠেকেছে। তার মধ্যে বাংলা ছবি চালানোর সংখ্যা আরওই মু়ষ্টিমেয়। কিন্তু হিসেবটা খানিক বদলে দিচ্ছে নন্দিতা রায়-শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়দের ‘প্রাক্তন’। হলমালিকরা হঠাৎই কিছুটা অক্সিজেন পেয়ে গিয়েছেন এই ছবিকে ঘিরে।

কী রকম? রিষড়ার ‘জয়ন্তী’, কোচবিহারের ‘নিউ সিনেমা’ আর কলকাতার ভবানীপুরের ‘ইন্দিরা’ হলের মালিক জগমোহনের উদাহরণই দেখা যাক। ক’বছর আগে জয়ন্তী হল-এর ড্রেস সার্কেলটা কাচ দিয়ে ঘিরে এসি বসিয়েছিলেন। তাতেও ভিড় বাড়েনি। এ বার ‘প্রাক্তন’-এর সুবাদে জগমোহনজির টেনশন বেড়ে গিয়েছে। ‘‘হল-এ অনেক দিন বাদে এত ভদ্রলোক পাবলিক দেখছি! অনেকে ফ্যামিলি নিয়ে আসছেন। কর্মচারীদের বলে দিয়েছি, বাড়তি ফিনাইল, ব্লিচিং দিয়ে বাথরুম সাফাই করতে!’’

কামারপুকুরের কাছে অখ্যাত ময়নাপুরে ‘শ্রীধর টকিজ’-এর ঝাঁপ বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। মালিক এখন খেপে উঠেছেন ‘প্রাক্তন’ দিয়ে ফের হল খোলাতে। বুকার কিঙ্কর হাজরা বলছেন, ‘‘হাসনাবাদের ‘মিতালি’তে বইটা খারাপ চলছে না। আপার ক্লাসের বই হলেও প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা আছে, মফস্সলেও লোকে খারাপ নিচ্ছে না।’’ প্রাক্তন-এর পরিবেশক সংস্থার প্রোগ্রামিং ম্যানেজার দেবাশিস সেনগুপ্তকে ফোন করে-করে পাগল করে দিচ্ছেন জগদ্দলের এক হল-মালিক। তাঁর দু’টি হল। ‘রজনী’তে হিন্দি ছবি চলে। আর ‘শ্রীকৃষ্ণ’য় ‘এ’-মার্কা ছবি। দু’টি হলই এ বার ‘বাংলা বইটা’ চালানোর জন্য মরিয়া। মালিক আত্মবিশ্বাসী, ‘‘এ বই লোকে দেখবেই! হলের ইমেজটাও উঁচুতে উঠবে।’’

অথচ গত কয়েক বছরে টালিগঞ্জের ছবি মানেই বড়-বড় জাহাজডুবির কাহিনি। পুজো বা বড়সড় ছুটি না-থাকলে কদাচিৎ লোকে ছবি দেখতে আসেন। জিৎ-দেবদের মতো হেভিওয়েট তারকাদের ছবি টেনেটুনে ১০০-১৫০টা হলে রিলিজ করে। শহুরে মাল্টিপ্লেক্স ও সিঙ্গল স্ক্রিন মিলিয়ে বাকিদের দৌড় বড়জোর ৩০-৪০টা প্রেক্ষাগৃহে। মুক্তির পরে হলের সংখ্যাও দ্রুত কমতে থাকে। তিন-চার হপ্তার মধ্যে ছবি হয় উঠে যায়, নইলে প্রযোজকের খুঁটির জোরে দু’একটা জায়গায় টিকে থাকে।

শিবু-নন্দিতারই ‘বেলাশেষে’ গত বছর টালিগঞ্জের সব থেকে বড় হিট ছিল। সে-ছবি মোটে ৪৫টি হলে মুক্তি পেয়েছিল। অতনু রায়চৌধুরী প্রযোজিত ‘প্রাক্তন’ কিন্তু ১০১টি প্রেক্ষাগৃহে রিলিজ করেছে। আর সব মিলিয়ে তিন সপ্তাহ পার করেও ৯০টির বেশি প্রেক্ষাগৃহ ধরে রেখেছে তারা। দু’কোটি টাকার ছবি তিন সপ্তাহে লাভের অঙ্কে দ্বিগুণ ছাপিয়ে গিয়েছে। ‘প্রাক্তন’-এর পরিবেশক পিয়ালি ফিল্মস-এর কর্ণধার অরিজিৎ দত্তের কথায়, ‘‘এটা ঠিকই, শহুরে মাল্টিপ্লেক্সে কালেকশনের ধারাবাহিকতা প্রাক্তন-কে এগিয়ে রেখেছে। কিন্তু গ্রামে-মফস্সলের সিঙ্গল স্ক্রিনের পারফরম্যান্স খারাপ নয়। দর্শকেরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল এমন অনেক হল-এর কপালেই এ বার কিছুটা হলেও শিকে ছিঁড়েছে।’’

মাল্টিপ্লেক্সে সাধারণত ১৫০-২০০র বেশি দর্শক ধরে না। তুলনায় সাবেক সিনেমা হল ভরানোর কাজটা অনেক কঠিন। কলকাতায় মিত্রা, প্রিয়া, জয়া, নবীনা-র মতো গুটিকয়েক হল ছাড়া সে-ভাবে লোকই হয় না। শিয়ালদহের প্রাচী সিনেমার মুখপাত্র শ্যামল দত্তের কথায়, ‘‘৮০০ লোকের হল। বেশ ক’বছর ধরে ৩০০ টিকিট বিক্রি হলেই আমরা বর্তে যাই।’’ এই পটভূমিতে প্রাক্তনের সৌজন্যে কোনও কোনও হলে ‘হাউসফুল’ বোর্ড অবধি দেখা গিয়েছে। বেহালার ‘অশোকা’র কর্তা প্রবীর রায় বা লেকটাউনে ‘জয়া’র ম্যানেজার অভিজিৎ দে বলছেন, ‘‘পুজোর সময়কার ব্যোমকেশ-ফেলুদার মতোই ভাল ব্যবসা করছে ‘প্রাক্তন’।’’ হাতিবাগানে মিত্রা-র কর্ণধার দীপেন্দ্রকৃষ্ণ মিত্রর হিসেব, ‘‘এ ছবি নাগাড়ে ৫০-৬০ শতাংশ আদায় বজায় রেখেছে। পুজো-বড়দিন ছাড়া বাংলা ছবি যা সচরাচর করে উঠতে পারে না।’’ একই পাড়ায় স্টার থিয়েটারে কালেকশনের হার আরও খানিক বেশি।

আর শহরতলিতে? মহিষাদলের হলে নন-এসি সিটগুলোর টিকিট হয়তো বিক্রি হচ্ছে না। গুসকরার ‘বিদ্যাসাগর’ বা বালুরঘাটের ‘সত্যজিৎ মঞ্চ’তেও এসি নেই। কিন্তু হলের কর্মীরা জানাচ্ছেন— অন্য সময়ে যেখানে ২০ শতাংশ টিকিটও বিক্রি হয় না, সেখানে ‘প্রাক্তন’ গড়ে ৪০ শতাংশ ব্যবসা দিচ্ছে। মালদহের ‘রূপকথা’য় প্রাক্তন-এর দৌড় চতুর্থ সপ্তাহে পা রেখেছে। হলটির লিজধারী মালিক অশোক ধানুকার কথায়, ‘‘এত বড় হলে সপ্তাহে লক্ষ টাকার ব্যবসাও কম নয়। অন্য সময়় ১০ হাজার টাকারও টিকিট বিক্রি হয় না।’’

এই সাফল্যের ব্যাখ্যা নিয়েই এখন চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে টালিগঞ্জে। প্রযোজক ফিরদৌসুল হাসানের মতে, ‘‘অনেক দিন বাদে টালিগঞ্জের সুসময় এল! বলতেই হবে, এ ছবি বাংলার আমদর্শকের নাড়ি অনেকটা ছুঁতে পেরেছে।’’ এর আগে আপাত ভাবে শহুরে দর্শকের ছবি বলে মনে হলেও অঞ্জন দত্তের ‘বং কানেকশন’, সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘অটোগ্রাফ’, ‘বাইশে শ্রাবণ’, অনীক দত্তের ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ গ্রামে-মফস্‌সলে লড়াই করেছিল। ‘প্রাক্তন’ সেই চেষ্টাটাই আরও জোরদার করেছে। তার সাফল্যে অন্য বাংলা ছবি নিয়েও নানা মহলে আগ্রহ বাড়ছে। আজ মুক্তি পেতে চলা বাংলা ছবি ‘ষড়রিপু’র জন্যও পরিবেশকদের কাছে হলমালিকদের ফোন আসতে শুরু করেছে।

শহুরে এলাকার ছোট পুকুর থেকে বড় পুকুরে পৌঁছতে না-পারলে যে বাংলা ছবির ভবিষ্যৎ ঝরঝরে তা জোর গলায় বলছেন, ‘প্রাক্তন’-এর প্রধান জুটি প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণাও। ‘সিনেমাওয়ালা’ কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়েরও সেটাই মত। তাঁর কথায়, ‘‘সবার ভাল লাগার মতো ছবি তো চাই-ই! সঙ্গে পুরনো সিনেমা হলের স্বাস্থ্য না-ফেরালে ইন্ডাস্ট্রি বাঁচবে না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE